2023 Durga Puja | দূর্গা নয় এখানে পূজিত হন 'অসুর'! রাজ্যের বেশ কিছু অংশে 'খলনায়ক' দূর্গা 'নায়ক' মহিষাসুর!

Thursday, December 21 2023, 2:33 pm
highlightKey Highlights

২০২৩ দূর্গা পূজাতে গোটা বঙ্গে পূজিত হন দেবী দূর্গা। তবে বেশ কয়েক গ্রামে হয়না দুর্গা পূজা উদযাপন, তৈরী হয়না দুর্গা পূজা প্যান্ডেল। সেখানে পুজো করা হয় 'অসুর'কে।


গোটা বছর সকল বাঙালি অপেক্ষা করেন এই শারদোৎসবের জন্য। বিসর্জনের পর থেকেই শুরু হয়ে যায় পরের বছর দুর্গোৎসবের দিন গোনা। ২০২৩ দূর্গা পূজা (2023 Durga Puja) এও বর্তমানে সেজে উঠেছে শহর কলকাতা থেকে শুরু করে গোটা বঙ্গ। আজ, ১৯সে অক্টোবর, মহাপঞ্চমী থেকে দেবী দুর্গার পুজোতে আরো মেতে উঠবেন সকলে। তবে বঙ্গের এমন জায়গাও রয়েছে যেখানে 'মহিষাসুরমর্দিনী' দেবী দুর্গাকে নয়, বরং পুজো করা হয় অসুরকে!

পুরুলিয়া জেলায় শারদোৎসবে দেবী দুর্গাকে নয় পুজো করা হয় অসুরকে 
পুরুলিয়া জেলায় শারদোৎসবে দেবী দুর্গাকে নয় পুজো করা হয় অসুরকে 

ছোট বেলার থেকেই সকল বাঙালি, হিন্দুরা জানে যে, মহিষাসুরকে বধ করে, অশুভ শক্তির নাশ করে শান্তি ছড়িয়ে দেন দেবী দূর্গা। পূজিত হন দেবী। তবে পুরুলিয়া জেলা (Purulia District) তে দেখা যায় অন্য দৃশ্য। সেখানে তৈরী হয়না দুর্গা পূজা প্যান্ডেল (Durga Puja Pandal), হয়না  দুর্গা পূজা উদযাপন (Durga Puja Celebration)। বরং যখন গোটা বাংলা দেবী দুর্গার পুজো করে তখন এখানে পূজিত হয় 'অসুর'। পুরুলিয়া জেলা (Purulia District) এর কাশিপুর থানার ভালাগোড়া গ্রামে অসুর 'খলনায়ক' নয় 'নায়ক' হিসেবে পরিচিত। এই গ্রামে আরাধনা করা হয় মহিষাসুরকে। নবমীর দিনে আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তামাম মানুষ 'হুদুড়' দুর্গা পুজো করেন।  করা হয় স্মরণ সভাও। এই হুদুড় দুর্গাপুজো নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী প্রচলিত।

সাঁওতাল খেরওয়াল জনগোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা হল হুদুড় (Hudur Durga)। হিন্দু ধর্ম মতে 'হুদুড়' হলো মহিষাসুর। কথিত আছে, 'হুদুড়' নামে সেখানে এক প্রবল বলশালী রাজা ছিলেন। তার বলের কারণে যখন চারিদিকে আর্যদের দাপট, তখন 'হুদুড়'কে তারা পরাজিত করতে পারছিলেন না। কিন্তু রাজাকে বাগে আনতে এক চাল চালে আর্যরা। গুপ্তচরের মাধ্যমে আর্যরা জানতে পারে যে রাজা হুদুড় নারী বৎসল। তাই আর্যরা রাজাকে হত্যা করার জন্য এক সুন্দরী নারীকে রাজার আশ্রিতা করে পাঠান। রাজা হুদুড় সেই গুপ্তচর নারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহের প্রস্তাবও দেন। তাতে রাজিও হন সেই নারী। এরপর কৌশল মতো সাত দিন তাঁরা একত্রে বসবাস করে কিন্তু অষ্টম দিন রাতে ছলনার আশ্রয় নিয়ে ওই নারী রাজাকে হত্যা করেন। আর ঠিক সেই সময়ই কৌশল মতো আর্যরা রাজ্য আক্রমণ করে। প্রজারা ভয়ভীত হয়ে ধর্মগুরুর স্মরণাপন্ন হলে তিনি সকল প্রজাকে নদীতে স্নান করে নারী বেশ ধারণ করে। কারণ আর্যরা নারীদের আক্রমণ করে না। ফলে প্রজারা নারী বেশ ধারণ করে নৃত্য করতে করতে পালাতে সক্ষম হন এবং প্রাণে রক্ষা পান। এই নাচকেই বলা হয় দাঁশাই বা ধাসাই নাচ।

রাজ্যের কিছু অংশে হয়না দুর্গা পূজা উদযাপন, হয় হুদুড় দুর্গা পুজো
রাজ্যের কিছু অংশে হয়না দুর্গা পূজা উদযাপন, হয় হুদুড় দুর্গা পুজো

অন্যদিকে আবার মানা হয়, মহিষাসুরকে নীতিহীন যুদ্ধে পরাস্ত করে আর্যাবর্ত নামে আর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আর্যপক্ষ যখন বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছিল সেই সময় সাঁওতাল, মুণ্ডা, কোল, কুরমি, মাহালি, কোড়া-সহ খেরওয়াল গোষ্ঠীর আদিবাসীরা তাঁদের বশ্যতা স্বীকার না করে নিজেদের মান বাঁচানোর উদ্দেশ্যে নারীর ছদ্মবেশে দাঁশাই বা ধাসাই নাচ ও কাঠি নাচের মাধ্যমে অন্তরের দুঃখ নিয়ে আনন্দের অভিনয় করতে করতে সিন্ধুপাড় ছেড়ে অসম, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও দক্ষিণ ভারতের বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। বলে হয়, সেই মহান রাজার নিধন ও দেশ হারার বেদনা বুকে নিয়ে সেই থেকেই আদিবাসীরা দুর্গা পূজা উদযাপন (Durga Puja Celebration) না করে তাঁদের পিতৃপুরুষ মহিষাসুরের স্মরণে ‘হায় রে হায় রে’ শব্দযোগে আজও দাঁশাই নাচ ও কাঠিনাচ করে চলে।

এই পুজো সম্পর্কে জেলার বিজ্ঞান মঞ্চের জেলা সম্পাদক ডা নয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন, কর্ণাটকের মহীশূর রাজ্যের অধিপতি ছিলেন মহিষাসুর। তিনি প্রবল বলশালী রাজা ছিলেন। তাদের মূল জীবিকা ছিল লোহা গলানো। পাশাপাশি তারা মহিষ পালনও করতেন। বলা হয় মহিষাসুর গাছের প্রতি যত্নশীল ও প্রকৃতির পুজারী ছিলেন। আর্যরা যখন ভারতে আসে তখন তারা মহিষাসুরের সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠতে না পেরে অনার্য সম্প্রদায়ের এক সুন্দরী রমণীকে প্রলোভন দেখিয়ে মহিষাসুরের কাছে পাঠায়। সাত দিন ধরে ওই রমণী মহিষাসুর এর সঙ্গে ছলা কলা করে কাটানোর পর অষ্টম দিনে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে মেরে ফেলে। এটিই মূল ঘটনা। এটি মূলত আর্য অনার্যদের লড়াই।

অন্যান্য বছরের পুজোর মতো ২০২৩ দূর্গা পূজাও দুঃখে কাটাবেন বিশিষ্ট কিছু সম্প্রদায়ের মানুষরা 
অন্যান্য বছরের পুজোর মতো ২০২৩ দূর্গা পূজাও দুঃখে কাটাবেন বিশিষ্ট কিছু সম্প্রদায়ের মানুষরা 

পুরুলিয়া জেলা (Purulia District) এর এই অঞ্চলের আদিবাসী সাঁওতাল খেরাওয়াল সম্প্রদায়ের মানুষরা তাদের রাজার মৃত্যুর কারণে নবমীর দিনে হুদুড় তথা মহিষাসুরের পুজো করেন। এই পুজোয় হুদুড় নায়ক এবং দুর্গা খলনায়িকা। সাঁওতালি দাঁশাইয়ের বিধি অনুযায়ী, ওইসময় পাঁচদিন দেবী দুর্গার মুখ দর্শন বন্ধ ছিল। এখনও অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী শোকপালন করতে গিয়ে ওই দিনগুলিতে বাড়ি থেকে বের হন না। তাঁরা মনে করেন, দুর্গোৎসবের মতো উৎসবকে ‘সাম্রাজ্যবাদী’র তকমা দিয়ে প্রকৃত ইতিহাস চাপা দেওয়ার চেষ্টায় উচ্চবর্ণীয় পণ্ডিতরা ধর্মের রং মিশিয়ে মহিষাসুরকে অশুভ শক্তি হিসাবে মিথ্যা প্রচার করেন। ২০২৩ দূর্গা পূজা (2023 Durga Puja) তেও একই প্রথা মানা হচ্ছে, সেখানে এবারও তৈরী হয়নি দুর্গা পূজা প্যান্ডেল (Durga Puja Pandal)।

পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতেও আজও পূজিত হন অসুর
পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতেও আজও পূজিত হন অসুর

কেবল পুরুলিয়াতেই নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতেও আজও পূজিত হন অসুর। কারণ, এখানকার পূজারিরা আজও মনে করেন যে তথাকথিত ‘খলনায়ক’ অথচ তাঁদের কাছে দেবরূপী অসুরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল। এখনও তাঁদের বিশ্বাস, হুদুড় দুর্গা তথা মহিষাসুরকে কোনও প্রকৃত যুদ্ধের মাধ্যমে পরাস্ত করা হয়নি। নীতিহীন যুদ্ধে পরাস্ত করে তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল। এমনকি অনেকে দুর্গার বদলে মহিষাসুরকে আসল দেবতা মনে করে সপ্তমীর দিন তাঁকে স্মরণ করে শহিদ দিবস পালন করে থাকেন। দুর্গোৎসবের দিনগুলি তাদের কাটে শোকে, চোখের জলে, হাহাকারে।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File