জীবন ও জীবনী

সুরের রাণী লতা মঙ্গেশকরের জীবন কাহিনী | The life story of Lata Mangeshkar, the queen of melody

সুরের রাণী লতা মঙ্গেশকরের জীবন কাহিনী | The life story of Lata Mangeshkar, the queen of melody
Key Highlights

লতা মঙ্গেশকর ছিলেন ভারতের একজন স্বনামধন্য গায়িকা। তিনি এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন এবং তার গাওয়া মোট গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি।

পরিচিতি ও পরিবার | Lata Mangeshkar's acquaintance and family

ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের অন্যতম বহুমুখী গায়িকা ছিলেন লতা মঙ্গেশকর, তাই 'ভারতের নাইটিঙ্গেল' নামেও অভিহিত করা হয়েছে তাঁকে।  লতা মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে শাস্ত্রীয় গায়ক ও নাট্য শিল্পী পণ্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকর এবং শেবন্তীর কোল আলো করে ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। অনেক ছোট বয়স থেকেই স্বনামধন্য গায়িকা নিজের বাবার কাছেই গান শেখা শুরু করে দিয়েছিলেন।  

সঙ্গীত শিক্ষার শুরু | The beginning of Lata Mangeshkar's music education

পাঁচ বছর বয়সে লতাকে তাঁর বাবার লেখা নাটকে অভিনেত্রী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। তাঁর সকল ভাইবোন - মীনা, আশা, ঊষা এবং হৃদয়নাথ সঙ্গীত জগতের সঙ্গে জড়িত এবং সকলেই দক্ষ গায়ক এবং সঙ্গীতশিল্পী। ১৯৪২ সালে, তাঁর পিতার অকাল মৃত্যু ঘটলে তাঁর কাঁধে পরিবারের জন্য জোগানের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়।  তখন পণ্ডিত দীনানাথের এক বন্ধু মাস্টার বিনায়ক মঙ্গেশকর তাদের পরিবারের যত্ন নেন এবং তাঁকে বড়ি মা  ছবিটিতে অভিনয় করার জন্য প্রস্তাবও দেন। পরবর্তী সময়ে, ১৯৪৯ সালে, তিনি বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে যান, এবং সেখানে তিনি ওস্তাদ আমান আলী খানের কাছে হিন্দুস্তানি সঙ্গীত শিখতে শুরু করেন।

বিশ্বখ্যাতি | Lata Mangeshkar is world famous

শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে কার অবদান সবচেয়ে বেশি ? 

এই প্রশ্নটির উত্তর পাওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৮৬ সালে এক নমুনা সমীক্ষার ব্যবস্থা করা হয় ‘ ইন্ডিয়া টু – ডে ‘ পত্রিকার মাধ্যমে। দেশের সকল প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পাঠক – পাঠিকারা ভোট দেয়, ফলে দেখা যায়  কিংবদন্তী সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের নাম সবার শীর্ষে । সেখানে ভীমসেন যোশী, মকবুল ফিদা হুসেন , রাজকাপুর , সত্যজিত রায় ও  অমিতাভ বচ্চনের মতো বিশিষ্ট শিল্পীরাও স্থান পেয়েছেন লতার নিচের সারিতে। 

প্রায় সব সিনেমা আড়াই ঘণ্টার হয়ে থাকে, এবং প্রতি ছবিতে মোটামুটি কুড়ি পঁচিশ মিনিট থাকে গানের অংশ । নারী কন্ঠে গানের অংশও থাকে তার অর্ধেক সময় জুড়ে অর্থাৎ প্রায় দশ বারো মিনিটের মত। ঐ কিছুমাত্র সামান্য সময়ের মধ্যেই এক অসামান্য প্রভাব বিস্তার করে গায়িকার মন দোলা দক্ষতা যা দিয়ে তিন প্রজন্মের শ্রোতাদেরকে মুগ্ধ করে রেখেছেন । 

কর্মজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা | Lata Mangeshkar's various career experiences

প্রায় আট দশকের কর্মজীবনে, লতা মঙ্গেশকর বলিউডের অভিনেত্রীদের পর্দার সামনে অভিনয় করে গাওয়া গানের কণ্ঠস্বর দিয়েছিলেন।  তিনি এক হাজারেরও বেশি হিন্দি এবং ৩৬ টি আঞ্চলিক ছবিতে ৫০০০ টিরও বেশি গান গেয়েছেন। ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতে তার অভূতপূর্ব প্রভাব ছিল। ১৯৪২ সাল থেকে, লতা তার মন-দোলা দক্ষতা দিয়ে সঙ্গীতের সীমানা পিছনে ঠেলে দেন। লতা মধুবালা থেকে ঐশ্বর্য্য পর্যন্ত বহু অভিনেত্রীদের জন্য গান গেয়েছেন।  তাঁর প্রতিভার জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিত, তিনি ভিন্ন ধরণের অ্যালবাম রেকর্ড করেছিলেন; যেমন: গজল, পপ, ইত্যাদি।

লতা মদন মোহন, আর ডি বর্মণ, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল এবং এ আর রহমান সহ বেশ কিছু কিংবদন্তি সঙ্গীত পরিচালকের সাথে কাজ করেছিলেন। তিনি লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের জন্য ৭০০ টিরও বেশি গান গেয়েছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে নসীব  সিনেমার  'মেরে নসিব মে 'এবং আশা  সিনেমার 'শীশা হো ইয়া দিল হো'। গাতা রাহে মেরা দিল, এবং পিয়া তোসে এই গানগুলি ১৯৬৫ সালে এস ডি বর্মনের জন্য রেকর্ড করেছিলেন।

 লতা আর ডি বর্মনের প্রথম এবং শেষ গান গেয়েছিলেন - ১৯৬১ সালে ছোটে নবাব সিনেমায় এবং কুছ না কাহো: যা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। এ.আর রহমানের সাথে তাঁর সহযোগিতায় ২০০১ সালে লাগান সিনেমাযর ' ও পালানহারে ' এবং ২০০৬ সালে রঙ দে বাসন্তী সিনেমায়  ' লুকা চুপি '-র মতো জনপ্রিয় গানগুলি তৈরি হয়েছিল।  বছরের পর বছর ধরে বহু কালজয়ী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।

পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে, লতা মঙ্গেশকর LM মিউজিক নামে তাঁর নিজস্ব সঙ্গীত লেবেল চালু করেন।  এর সাম্প্রতিক রিলিজ (মার্চ ২০১৯) হল সৌগন্ধ মুঝে ইস মিত্তি কি গানটি, গানটি ময়ূরেশ পাই- এর রচিত, যা ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং ভারতের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল।

 পুরস্কার এবং স্বীকৃতি | Awards & Honors of Lata Mangeshkar

লতা মঙ্গেশকর নিজের আট দশকের দীর্ঘ কর্মজীবনে বেশ কিছু পুরস্কার এবং প্রশংসা পেয়েছিলেন। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ১৯৭৪ সালে রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তিনি অনেক পুরস্কার পান যার মধ্যে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৫ টি বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার, এছাড়াও চারটি ফিল্মফেয়ার সেরা মহিলা প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে ও দুটি ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডও পান সকলের প্রিয় ভারতের নাইটেঙ্গেল। 

 লতা মঙ্গেশকর ১৯৮৯ সালে 'দাদাসাহেব ফালকে' পুরস্কারেও ভূষিত হন। আবার ২০০১ সালে, তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান 'ভারতরত্ন' লাভ করেন।  ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে তার সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার "অফিসার অফ দ্য লিজিয়ন অফ অনার" প্রদান করে।

এগুলির সাথে, লতা মঙ্গেশকর ১৯৭৪ সালে গিনেস রেকর্ডে ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করা শিল্পী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ভারত সরকার তাকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর ৯০ তম জন্মদিনে 'জাতির কন্যা' পুরস্কারে সম্মানিত করে।

প্রখ্যাত গায়িকা সম্পর্কিত "লতা মঙ্গেশকর: একটি মিউজিক্যাল জার্নি" শিরোনামের বইটিতে ১৯৪০ এর দশক থেকে বর্তমান দিন পর্যন্ত হিন্দি সঙ্গীতের রানী হিসাবে সঙ্গীতজগতে কাটানো তাঁর জীবনের গল্প, সংগ্রাম, সাফল্য এবং রাজত্বের সাথে জড়িত অনেক অজানা তথ্য রয়েছে।

আঞ্চলিক সঙ্গীতে অবদান | Lata Mangeshkar's contribution to regional music

লতা মঙ্গেশকর ১৯৫৫ সালে মারাঠি সিনেমা রাম রাম পাভনে-এর জন্য প্রথমবার নিজে সঙ্গীত রচনা করেন।  পরবর্তীতে ১৯৬০-এর দশকে, তিনি 'আনন্দ ঘানের' ছদ্মনামে নিম্নলিখিত মারাঠি চলচ্চিত্রগুলির জন্য সঙ্গীত রচনা করেন।

  • ১৯৫০ – রাম রাম পাভনা
  •  ১৯৬৩– মারাঠা তিতুকা মেলভাভা
  •  ১৯৬৩ – মোহিত্যাঞ্চি মঞ্জুলা
  •  ১৯৬৫– সাধি মানসে
  •  ১৯৬৯ – তাম্বাদি মাতি

তিনি 'সাধি মানসে' ছবির জন্য মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন।  একই ছবির গান " আইরানিচ্যা দেভা তুলা" সেরা গানের পুরস্কার পেয়েছে।

লতা মঙ্গেশকর চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন | Lata Mangeshkar has produced four films

  • ১৯৫৩– ভদাল (মারাঠি)
  • ১৯৫৩ – ঝাঁঝার (হিন্দি), সি. রামচন্দ্রের সাথে সহ-প্রযোজনা
  • ১৯৫৫ – কাঞ্চন গঙ্গা (হিন্দি)
  • ১৯৯০– লেকিন... (হিন্দি)

বাংলা ভাষায় তিনি রেকর্ড করেছিলেন ২০০টি গান, যা আজও শ্রোতা মহলে প্রশংসিত হয়। তাঁর গাওয়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বাংলা গান হল: চঞ্চল মন আনমনা হয়, নিঝুম সন্ধায়, কে যেনো গো ডেকেছে আমায়, আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাবো, ইত্যাদি। 

এসব ছাড়াও তিনি হিন্দি গানের ক্ষেত্রে নিজের সুরের জাদু যেভাবে অধিষ্ঠিত করে গেছেন তা বহু কাল ধরে সকলের হৃদয় ছুঁয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও অনন্য হয়ে থাকবে।

মৃত্যু | Death of Lata Mangeshkar

শেষ বয়সে সঙ্গীত সম্রাজ্ঞীর শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা দেখা দেয়। সে কারণে ১১ নভেম্বর, ২০১৯-এ লতা মঙ্গেশকরকে দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ব্রীচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তারপর, তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও, তার অবস্থায় তেমন প্রসার ঘটেনি।

২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গায়িকা লতা মঙ্গেশকর করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আইসোলেশনে বেশ কিছু দিন ছিলেন, শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

উপসংহার | Conclusion

লতা নিজেকে এমন এক উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছেন যে  আজ থেকে শত- শত বৎসর পরেও হয়তো এই উপ-মহাদেশের কোনো না কোনো প্রান্তে কিংবা ইউরোপ-আমেরিকায় কাউকে না কাউকে হঠাৎ গেয়ে উঠতে দেখা যাবে লতার গানের কোনো কলি ।

প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions

লতা মঙ্গেশকর কে ?

লতা মঙ্গেশকর হলেন ভারতের একজন স্বনামধন্য গায়িকা ।

লতা মঙ্গেশকর এর জন্ম কোথায় হয় ?

লতা মঙ্গেশকর এর জন্ম হয় ইন্দোর, মধ্যপ্রদেশ।

লতা মঙ্গেশকর কবে জন্মগ্রহণ করেন ?

লতা মঙ্গেশকর ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন ।

লতা মঙ্গেশকর এর পিতার নাম কী ?

লতা মঙ্গেশকর এর পিতার নাম দ্বীননাথ মঙ্গেশকর।

লতা মঙ্গেশকর এর মাতার নাম কী ?

লতা মঙ্গেশকর এর মাতার নাম শিবন্তী মঙ্গেশকর ।

লতা মঙ্গেশকর কবে ভারতরত্ন পান ?

লতা মঙ্গেশকর ২০০১ সালে ভারতরত্ন পান ।

লতা মঙ্গেশকর কবে পদ্মভূষণ পান ?

লতা মঙ্গেশকর ১৯৬৯ সালে পদ্মভূষণ পান ।

লতা মঙ্গেশকর কবে মহারাষ্ট্রভূষণ পান ?

লতা মঙ্গেশকর ১৯৯৭ সালে মহারাষ্ট্রভূষণ পান।

লতা মঙ্গেশকর কবে মারা যান ?

লতা মঙ্গেশকর ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে মারা যান ।