Dr. MS Swaminathan | ভারতের কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব এনে বাঁচিয়েছিলেন লক্ষাধিকের প্রাণ! প্রয়াত ভারতীয় সবুজ বিপ্লবের জনক,ডাঃ এমএস স্বামীনাথ!

Thursday, October 5 2023, 1:34 pm
highlightKey Highlights

২৮সে সেপ্টেম্বর ৯৮ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন ভারতীয় সবুজ বিপ্লবের জনক,ডাঃ এমএস স্বামীনাথ। দেশ তথা বিশ্বের অন্যতম কৃষিবিজ্ঞানীর জীবনী সম্পর্কে পড়ুন।


দেশ জুড়ে শোকের ছায়া। প্রয়াত ভারতীয় সবুজ বিপ্লবের জনক (Father of Indian Green Revolution) ডাঃ এমএস স্বামীনাথন (Dr. MS Swaminathan)। ২৮সে সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা বেজে ২০ মিনিটে চেন্নাইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ডাঃ এমএস স্বামীনাথন (Dr. MS Swaminathan)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানীর প্রয়াণে সোশ্যাল মাধ্যমে শোক বার্তা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi)।

ডাঃ এমএস স্বামীনাথনের জীবনী । Biography of Dr. MS Swaminathan :

Trending Updates

এমএস স্বামীনাথনকে বলা হয় ভারতীয় সবুজ বিপ্লবের জনক (Father of Indian Green Revolution)। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তারপরে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাল গবেষণা সংসদ (International Rice Research Institution) (IRRI)-এর ডিরেক্টর জেনারেল পদে ছিলেন তিনি। খাদ্যসঙ্কটের সমস্য়া মোকাবিলা করতে স্বামীনাথন তৈরি করেছিলেন উচ্চ ফলনশীল বীজ। ভারতের পরিবেশের সঙ্গে কোন ধরনের বীজ মানিয়ে নিতে পারবে তা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার ফসল ওই ধরনের বীজ। ভারতে খাদ্যসঙ্কট মোকাবিলার ক্ষেত্রে কৃষিবিজ্ঞানী এবং উদ্ভিদ-জিনের গবেষক এমএস স্বামীনাথনের কাজ স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

ডাঃ এমএস স্বামীনাথনের প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা । Early Life and Education of Dr. MS Swaminathan :

১৯২৫ সালের ৭ই অগাস্ট মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কুম্বাকোনামে জন্মগ্রহণ করেন ডাঃ এমএস স্বামীনাথন। জেনারেল সার্জন এম কে সাম্বাসিভান এবং পার্বতী থাঙ্গাম্মাল সাম্বাসিভানের দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন তিনি। বাল্যকালেই পিতাকে হারান কৃষিবিজ্ঞানী। স্বামীনাথন নেটিভ হাই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং পরে কুম্বাকোনামের ক্যাথলিক লিটল ফ্লাওয়ার হাই স্কুল থেকে তিনি ১৫ বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন লাভ করেন। ছোটবেলার সঙ্গেই তাঁর যোগ কৃষির সঙ্গে। স্বামীনাথনের পরিবার যুক্ত ছিল কৃষিকাজের সঙ্গে। তারা চাল, আম, নারকেল , কফির মতো নানান শস্য উৎপাদন করতেন। ফলে ছোটবেলার থেকেই স্বামীনাথন ফসলের দামের ওঠানামা তার পরিবারের উপর প্রভাব ফেলে এবং কীটপতঙ্গ ফসলের পাশাপাশি আয়েরও ক্ষতি করতে পারে। তাঁর বাবা-মা চেয়েছিলেন তিনি ডাক্তারি পড়ুক। সে কথা মাথায় রেখে তিনি প্রাণিবিদ্যা নিয়ে উচ্চশিক্ষা শুরু করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ এবং সমগ্র উপমহাদেশে চালের অভাবের প্রভাব প্রত্যক্ষ অনুভব করেন। তখনই তিনি ভারতে পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য তার জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি কেরালার ত্রিভান্দ্রামের মহারাজা কলেজে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন । এরপর তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এই সময়ে তাকে কৃষিবিদ্যার অধ্যাপক কোটাহ রামাস্বামীও শিখিয়েছিলেন। এরপ ১৯৪৭ সালে তিনি জেনেটিক্স এবং উদ্ভিদ প্রজনন অধ্যয়নের জন্য নয়াদিল্লিতে ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে চলে যান। তিনি ১৯৪৯ সালে সাইটোজেনেটিক্সে উচ্চ পার্থক্য সহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সামাজিক চাপের ফলে তিনি সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যার মাধ্যমে তিনি ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসে নির্বাচিত হন। তবে একই সময়ে, নেদারল্যান্ডে জেনেটিক্সে ইউনেস্কোর ফেলোশিপের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে তার জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়। ফলে তিনি সেই পথেই হাঁটেন।

প্রশাসক এবং শিক্ষাবিদ হিসেবে ডাঃ এমএস স্বামীনাথন । Dr. MS Swaminathan as Administrator and Educationist:

১৯৭২ সালে, স্বামীনাথন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (ICAR) এর মহাপরিচালক এবং ভারত সরকারের একজন সচিব হিসাবে নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৭৯ সালে তাঁকে প্রধান সচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হয় যা তৎকালীন সময়ে একজন বিজ্ঞানীর জন্য বিরল ঘটনা বলে বিবেচিত ছিল। পরের বছর তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনে স্থানান্তরিত করা হয়। আইসিএআর-এর মহাপরিচালক হিসাবে, তিনি প্রযুক্তিগত সাক্ষরতার জন্য জোর দেন, এর জন্য সারা ভারতে তিনি কেন্দ্র স্থাপন করেন। তৎকালীন সময়ে খরা এবং দরিদ্রদের অপুষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি আবহাওয়া এবং ফসলের ধরণের ওপর লক্ষ্য রাখার জন্য বিশেষ দল গঠন করেন। দুই বছরের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে তাঁর স্থানান্তরের ফলে প্রথমবারের মতো ভারতের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারী ও পরিবেশের পরিচয় ঘটে।

এরপর ১৯৮২ সালে তিনি ফিলিপাইনে ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (IRRI) এর প্রথম এশিয়ান মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। এখানে তাঁর মেয়াদকালে তিনি যে অবদান রেখেছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন "উইমেন ইন রাইস ফার্মিং সিস্টেমস" (Women in Rice Farming Systems) পরিচালনা করা। এর জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন ফর উইমেন ইন ডেভেলপমেন্ট স্বামীনাথনকে "উন্নয়নে নারীর একীকরণে অসামান্য অবদানের জন্য" তাদের প্রথম পুরস্কার দেয়। এছাড়াও আইআরআরআই-তে তাঁর ভূমিকার জন্য তাঁকে দেওয়া হয় 'বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার' (World Food Award)। ১৯৮৪ সালে তিনি যথাক্রমে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের সভাপতি ও সহ-সভাপতি হন।

ভারতীয় সবুজ বিপ্লবের জনক-ডাঃ এমএস স্বামীনাথন । Dr. MS Swaminathan, Father of Indian Green Revolution :

১৯৫০ এর দশকে, আলুর উৎপত্তি এবং বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্বামীনাথনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ছিল একটি অন্যতম অবদান। তিনি অটোটেট্রাপ্লয়েড এবং এর কোষ বিভাজন আচরণের উত্স ব্যাখ্যা করেছিলেন। পলিপ্লয়েড সম্পর্কিত তাঁর অনুসন্ধানগুলিও উল্লেখযোগ্য ছিল। ১৯৫২ সালে স্বামীনাথনের থিসিস, "সোলানাম, বিভাগ টিউবেরিয়ামের নির্দিষ্ট প্রজাতির পার্থক্য এবং পলিপ্লয়েডির প্রকৃতি" (Differentiation and the Nature of Polyploidy in Certain Species of Solanum, Section Tuberium) ছিল কৃষিবিজ্ঞানে অন্যতম অবদান। এর দ্বারা বন্য প্রজাতি থেকে চাষকৃত আলুতে জিন স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়াও আলুর জাত উন্নয়নে, হিম-প্রতিরোধী আলু তৈরিতে, আলুর জেনেটিক বিশ্লেষণ করতে, আলুর ফলন এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করেন।

আলু ছাড়াও ডাঃ এমএস স্বামীনাথন (Dr. MS Swaminathan) ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে হেক্সাপ্লয়েড গমের সাইটোজেনেটিক্স নিয়ে প্রাথমিক গবেষণা করেছিলেন। গবেষণার বিষয় ছিল, উদ্ভাবিত গম ও ধানের জাতগুলি সবুজ বিপ্লব। পাশাপাশি কার্বন ফিক্সেশন ক্ষমতা সহ ধান চাষের প্রচেষ্টা, বিশ্বের প্রথম উচ্চ-ফলনশীল বাসমতির উন্নয়নেও স্বামীনাথনের ভূমিকা ছিল।

রেডিয়েশন মিউটেশন অধ্যয়নের জন্য তিনি একটি ' কোবল্ট-৬০ গামা গার্ডেন' স্থাপন করেন। হোমি জে. ভাভা, বিক্রম সারাভাই (Vikram Sarabhai), রাজা রমনা (Raja Ramanna), এমআর শ্রীনিবাসন (Srinivasan) এবং অন্যান্য ভারতীয় পরমাণু বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি স্বামীনাথনের এই গার্ডেন, ট্রম্বেও(যা পরে ভাভা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টারে পরিণত হয়েছিল কৃষি বিজ্ঞানীদের পারমাণবিক শক্তির সংস্থান হিসেবে সুবিধা প্রদান করে।

স্বামীনাথন আইএআরআই-তে নিউক্লিয়ার রিসার্চ ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভারতে আধা-শুষ্ক ক্রান্তীয় অঞ্চলের জন্য আন্তর্জাতিক শস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনে এবং প্রচারে ভূমিকা পালন করেছিলে। তিনি চীন, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইরান এবং কম্বোডিয়ায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ও বিকাশে সহায়তা করেছেন এবং গবেষণা সহায়তা প্রদান করেছেন।

পুরস্কার এবং সম্মান । Awards and honors :

স্বামীনাথন ১৯৬৫ সালে চেকোস্লোভাক একাডেমি অফ সায়েন্সেস থেকে মেন্ডেল মেমোরিয়াল (Mendel Memorial Medal) মেডেল পান। এরপরে তিনি ১৯৭১ সালে জার্মান ম্যাগসেসে পুরস্কার (German Magsaysay Award), ১৯৮৬ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন ওয়ার্ল্ড সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড (Albert Einstein World Science Award) সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি প্রথম বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার লাভ করেন, পরিবেশগত অর্জনের জন্য টাইলার পুরস্কার (১৯৯১), ফোর ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড (২০০০) এবং আন্তর্জাতিক ভৌগলিক ইউনিয়নের প্ল্যানেট অ্যান্ড হিউম্যানিটি মেডেল (২০০০) লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ফিলিপাইনের অর্ডার অফ দ্য গোল্ডেন হার্ট , ফ্রান্সের অর্ডার অফ এগ্রিকালচারাল মেরিট, নেদারল্যান্ডের গোল্ডেন আর্কের অর্ডার এবং কম্বোডিয়ার সাহামেত্রেই রয়্যাল অর্ডারে ভূষিত হন। চীন তাকে "পরিবেশ ও উন্নয়নের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য পুরস্কার" দিয়ে ভূষিত করে।

ভারতীয় সবুজ বিপ্লবের জনক (Father of Indian Green Revolution) এর প্রাপ্ত প্রথম জাতীয় পুরষ্কারগুলির মধ্যে একটি হল ১৯৬১ সালে শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার। এরপরে তিনি পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ এবং পদ্মবিভূষণ পুরস্কারের পাশাপাশি এইচকে ফিরোদিয়া পুরস্কার, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত, তিনি ৩৩টিজাতীয় এবং ৩২টিআন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৪ সালে, ভারতের একটি কৃষি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক স্বামীনাথনের নামে একটি বার্ষিক পুরস্কারের নামকরণ করে, যার নাম 'ড. কৃষিতে নেতৃত্বের জন্য এমএস স্বামীনাথন পুরস্কার' ('Dr. MS Swaminathan Award for Leadership in Agriculture')।

স্বাধীনতার পরের কয়েক দশক, দেশের প্রতিটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য ভারতকে বিদেশের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হত। কিন্তু, গত শতাব্দীর ছয় ও সাতের দশকে ভারতীয় সবুজ বিপ্লবের জনক (Father of Indian Green Revolution) ডাঃ এমএস স্বামীনাথন (Dr. MS Swaminathan) এর জন্য সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছিলো। প্ল্যান্ট জেনেটিক্সের ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজই ভারতের কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছিল। ডাঃ এমএস স্বামীনাথনের জন্যই টেকসই কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য সুরক্ষা বাস্তবায়িত হয়েছিল দেশে।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File