Gandhi Jayanti | 'জাতি ও অহিংসার জনক'! গান্ধীজির শ্রদ্ধার্ঘ্যে একই দিন পালন 'আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস'!
২রা অক্টোবর, গান্ধীজির জন্ম দিবসে ভারত জুড়ে পালন হয় গান্ধী জয়ন্তী। তবে এই দিবসকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে ২০০৭ সাল থেকে দিনই পালন করা হয় আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস।
আজ, ২ রা অক্টোবর,গান্ধী জয়ন্তী (Gandhi Jayanti)। জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর (Mohandas Karamchand Gandhi) ১৫৪তম জন্মদিবস। এদিন গোটা ভারত জুড়ে ন্যাশনাল হলিডে হিসেবে পালিত হয়। পাশাপাশি নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সমাজসেবার মাধ্যমে গান্ধীজিকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। গান্ধীজির দেশ এবং দেশের স্বাধীনতার প্রতি অবদান সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার থাকে না। তবে কেবল ভারতের জন্যই নয়, গোটা বিশ্বে তাঁর অহিংসা বাণী এবং সুপ্রভাব অনস্বীকার্য। যার ফলে গান্ধী জয়ন্তী (Gandhi Jayanti) এর দিনটিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য এবং গান্ধীজিকে সম্মান জানানোর জন্য এই দিনেই, ২রা অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস (International Day of Non-Violence) বা ইন্টারন্যাশনাল ডে অব নন ভায়োলেন্স ।
মহাত্মা গান্ধীর জন্ম ও শিক্ষা । Birth and education of Mahatma Gandhi :
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী জন্ম গ্রহণ করেন ১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর গুজরাটের পোরবান্দরে । পিতা ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান এবং মাতা পুতলিবা করমচাঁদ ছিলেন প্রণামী বৈষ্ণব গোষ্ঠীর। মহাত্মা গান্ধী পোরবন্দর ও রাজকোটেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন তিনি। কোন রকমে গুজরাটের ভবনগরের সামালদাস কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরিবারের ইচ্ছা ছিল মোহনদাস বড় হয়ে আইনজীবী হবেন। যার ফলে ১৮ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে যান। এরপর ১৮৯১ সালে লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়তে যান। বার অ্যাট ল`ডিগ্রি অর্জন শেষে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং মুম্বাই শহরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
'মহাত্মা' গান্ধী । 'Mahatma' Gandhi :
১৯১৫ সালের ৯ই জানুয়ারী গান্ধী বিলেত থেকে ভারতে ফিরে আসেন। এইজন্য ওই দিনটিকে 'প্রবাসী ভারতীয় দিবস' হিসাবে পালন করা হয়। ভারতে ফিরে আসার পর তাঁর তৎকালীন সম্মানিত কংগ্রেস নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর ক্রমশ তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গে। এক জন শিক্ষিত ব্রিটিশ আইনজীবী হিসেবে, গান্ধী প্রথম তাঁর অহিংস শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের মতাদর্শ প্রয়োগ করেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নিপীড়িত ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। ভারতে ফিরে আসার পরে কয়েক জন দুঃস্থ কৃষক এবং দিনমজুরকে সাথে নিয়ে বৈষম্যমূলক কর আদায় ব্যবস্থা এবং বহু বিস্তৃত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে আসার পর গান্ধী সমগ্র ভারতব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারী স্বাধীনতা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণ, জাতির অর্থনৈতিক সচ্ছলতা সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার শুরু করেন। কিন্তু এর সবগুলোই ছিল স্বরাজ অর্থাৎ ভারতকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনীতিবিদ, ভারতের আজাদী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিদের অন্যতম একজন প্রভাবশালী নেতা।
মেঘনাদ সাহার জীবনী সম্পর্কে পড়ুন : পদার্থবিদ্যাতে দেখিয়েছিলেন নয়া পথ! ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে দেশকে স্থান দিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা!
গান্ধীর প্রথম অর্জন আসে ১৯১৮ সালের 'চম্পারণ বিক্ষোভ এবং খেদা সত্যাগ্রহে'র (Champaran Demonstration and Kheda Satyagraha) মাধ্যমে। জমিদারের লাঠিয়ালদের মাধ্যমে অত্যাচার, গ্রামগুলোতে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করা, মদ্যপান ও অস্পৃশ্যতা, দুর্ভিক্ষ সকল বিষয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেন গান্ধী। একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে অসংখ্য সমর্থক ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের একত্রিত করেন গান্ধীজি। তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ জরিপ চালিয়ে গ্রামের মৃত্যুর হার এবং গ্রামবাসীদের ভয়াবহ দুর্ভোগের উপাত্ত সংগ্রহ করেন। গ্রামবাসীদের কাছে বিশ্বস্ত হবার পর তিনি গ্রাম পরিষ্কার করার পাশাপাশি স্কুল ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন এবং গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকদের সামাজিক নির্যাতন এবং কুসংস্কারমুক্ত হবার আহ্বান জানান। কিন্তু অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ রাজ। তবে গান্ধীজির মুক্তির দাবিতে জেলের বাইরে হাজার হাজার সমর্থক জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
জমিদারদের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত বিক্ষোভ ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দান এবং জমিদাররা ব্রিটিশ সরকারকে কৃষকদের আরও বেশি ক্ষতিপূরণ এবং চাষাবাদের বিষয়ে তাদের আরো নিয়ন্ত্রণ প্রদানে ব্রিটিশ শাসককে রাজি করান গান্ধীজি। এই সময়ই জনগণ গান্ধীজিকে বাপু (পিতা) এবং মহাত্মা (মহৎ হৃদয়) উপাধি দেয়। খেদায় ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতার সময় কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করেন সর্দার প্যাটেল। তিনি খাজনা আদায় বন্ধ এবং সকল বন্দীদের মুক্তি দান করেন। এর ফলে গান্ধীর সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতের স্বাধীনতার পর তিনি আর আনুষ্ঠানিক রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। বরং রাজনীতি থেকে তিনি অবসর গ্রহন করেছিলেন। মূলত কংগ্রেস পার্টি ফেডারেশন স্কিমের ক্ষমতা মেনে নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হলে গান্ধী দল থেকে নিজের সদস্যপদ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর মহান দর্শন ও কর্মময় জীবন স্থান-কালের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলে। তবে ১৯৪৮ সালের ৩০সে জানুয়ারি ভারতে থমকে যায় সব। থেমে যায় 'মহাত্মা'র সকল বাণী। দিল্লীর বিরলা ভবন (বিরলা হাউস)এ রাত্রিকালীন পথসভার সময় গুলি করে হত্যা করা হয় গান্ধীজিকে। ১৯৪৯ সালের ১৪ নভেম্বর বাপুর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
গান্ধী জয়ন্তী ও আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস । Gandhi Jayanti and International Day of Non-Violence :
প্রতি বছর ২রা অক্টোবর গান্ধীজিকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর জন্ম দিবসে গান্ধী জয়ন্তী (Gandhi Jayanti) পালিত হয়। এটি ভারতের অন্যতম একটি জাতীয় সরকারি ছুটির দিন, এই দিনটি ভারতের সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়। এদিন সারা ভারত জুড়ে প্রার্থনা পরিষেবা এবং শ্রদ্ধার মাধ্যমে গান্ধী জয়ন্তী পালিত হয়। বিশেষ করে নতুন দিল্লির রাজ ঘাটে, গান্ধীর স্মৃতিস্তম্ভে, যেখানে তাঁকে দাহ করা হয়েছিল, সেখানে সকলে শ্রদ্ধা অর্পণ করে। কলেজ, স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি বিভিন্ন শহরে প্রার্থনা সভা, স্মরণ অনুষ্ঠান করে এই দিনটি উদ্যাপন করে থাকে। এদিন অহিংস জীবন ধারাকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীর প্রচেষ্টাকে তুলে ধরে বিদ্যালয় এবং সম্প্রদায়ের সেরা প্রকল্পগুলির জন্য পুরস্কার প্রদান করা হয়।
তবে ২০০৭ সালে গান্ধীজির জন্মদিবস অর্থাৎ গান্ধী জয়ন্তী (Gandhi Jayanti) গোটা বিশ্বে বিষেশ মর্যাদা লাভ করে। ২০০৭ সালের ১৫ই জুন রাষ্ট্রসংঘ ঘোষণা করে, ২রা অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালন করা হবে আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস (International Day of Non-Violence) বা ইন্টারন্যাশনাল ডে অব নন ভায়োলেন্স । ব্রিটিশের কবল থেকে ভারতকে মুক্ত করতে সারা জীবন নানা রকম আন্দোলন করেছেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পিছনে যাঁদের যাঁদের অবদান ছিল, তাঁদের মধ্যে গান্ধীর অবদান সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়। তবে কেবল ভারতেই নয় গোটা বিশ্বেও তিনি প্রচার করে অহিংসা, শান্তির বাণী। তাঁর দর্শন বিভিন্ন দেশ ও জাতিকে দেখিয়েছে আলোর পথ। জুনিয়র মার্টিন লুথার কিং (Martin Luther King Jr), নেলসন ম্যান্ডেলা (Nelson Mandela), দলাইলামা (Dalai Lama) থেকে শুরু করে অং সান সু চি'র (Aung San Suu Kyi) মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতির গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও অধিকার কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছে গান্ধীর মহান দর্শন।
আরও পড়ুন : ভিনগ্রহীদের জন্য বেজে চলেছে ভারতীয় গান! মহাকাশে না গিয়েও এখনও ছাপ রয়েছে কেশরবাঈ কেরকারের!
গান্ধীজির সম্মানে এবং বিশ্বে তার অহিংসার বাণীর সুপ্রভাবকে শ্রদ্ধা জানাতে ২০০৭ সালে ২রা অক্টোবরে গান্ধী জয়ন্তী (Gandhi Jayanti) পালনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস (International Day of Non-Violence) বা ইন্টারন্যাশনাল ডে অব নন ভায়োলেন্স পালনের প্রস্তাব দেয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রেজুলেশন A/RES/61/271 অনুসারে এই দিনটি শিক্ষা এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে অহিংসার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার এবং শান্তি, সহনশীলতা, বোঝাপড়া এবং অহিংসার সংস্কৃতির আকাঙ্ক্ষাকে পুনর্নিশ্চিত করার একটি উপলক্ষ।
- Related topics -
- দেশ
- জীবন ও জীবনী
- জীবনী সাহিত্য
- ভারত
- রাষ্ট্রসংঘ