জীবন ও জীবনী

Malala Yousafzai | তালিবানের বন্দুকের সামনেও নামেনি চোখ! জানুন কনিষ্ঠতম নোবেলজয়ী মালালার লড়াইয়ের কাহিনী!

Malala Yousafzai | তালিবানের বন্দুকের সামনেও নামেনি চোখ! জানুন কনিষ্ঠতম নোবেলজয়ী মালালার লড়াইয়ের কাহিনী!
Key Highlights

স্কুল থেকে ফেরার পথে মালালা ইউসুফজাইকে উদ্দেশ্য করে চলে তালিবানের গুলি। তাতেও থামেনি লড়াই। ১২ই জুলাই তাঁর জন্মদিনের দিনকে 'মালালা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ।

বিশ্বের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে এই পাকিস্তানি কন্যার নাম। নারী শিক্ষা ও নারীদের অধিকার নিয়ে লড়াই করার জন্য খেতে হয়েছিল তালিবানের গুলি। বেঁচে ফিরতে পারবেন কি না সেই সংশয় থাকলেও জীবন যুদ্ধে জিতে এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন নারী শিক্ষার অধিকারের যুদ্ধ। ইনি হলেন কনিষ্ঠতম নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাই (Malala Yousafzai)। আজ অর্থাৎ ১২ই জুলাই  মালালার জন্মদিনের দিন তাঁকে এবং তাঁরই মতো লড়াকু কিশোরীদের মনোবল যোগাতে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় 'আন্তর্জাতিক মালালা দিবস' (International Malala Day)।

১৯৯৭ সালে ১২ই জুলাই পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত জেলায় (Swat, Khyber Pakhtunkhwa, Pakistan) একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই এবং তোর পেকাই ইউসুফজাইয়ের কন্যা মালালা ইউসুফজাই। দক্ষিণ আফগানিস্তানের (Afghanistan) বিখ্যাত মহিলা পাশতু কবি ও যোদ্ধা মালালাই-এ-ম্যায়ওয়ান্দের (Malalai-e-Maywande) নামানুসারে তাঁর নামকরণ করা হয় মালালা, যার আক্ষরিক অর্থ "দুঃখে অভিভূত"। বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই ছিলেন একজন একজন কবি, শিক্ষা কর্মী। পাশাপাশি তিনি খুশাল পাবলিক স্কুল নামের একটি স্কুলের চেইন ব্যবসাও করতেন। মালালা ছোটবেলার থেকে তাঁর বাবার কাছেই পড়াশোনা করেন। বাল্যকাল থেকেই পশতু, উর্দু এবং ইংরেজিতে সাবলীল মালালা। জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই এক সাক্ষাৎকারে জানান, ছোটবেলার থেকেই মালালা বাকিদের থেকে ভিন্ন ছিল। রাতের পর রাত জেগে ছেলেবেলা থেকেই রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে বেশ ভালোবাসতো মালালা।

মালালার জীবন বদলে যায় ২০০৭ সাল থেকে। সেই বছর মাওলানা ফজলুল্লাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের সোয়াত উপত্যকা দখল করে তালিবানের একটি শাখা। দেশের কিছু অংশ দখল করতেই  টেলিভিশন দেখা, গান-বাজনা ইত্যাদি বন্ধ ঘোষণা করে তালিবান। বন্ধ করে দেওয়া হয় মেয়েদের লেখাপড়াও। বোমা মেরে একই সঙ্গে ধ্বংস করে দেওয়া হয় প্রায় ১৫০টি স্কুল। ফলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় মালালার। সেই সময় থেকেই ছোট্ট মালালা তালিবানের নিষ্ঠুর শাসন নিয়ে গর্জে ওঠে। জনসমাজে, সংবাদমাধ্যমের সামনেই তালিবান শাসনের বিরুদ্ধে হুঙ্কার মালালার।

তালেবানরা কীভাবে আমার শিক্ষার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়?

মালালা ইউসুফজাই 

তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানে তালিবানের শাসন সম্পর্কে মেয়েদের শিক্ষার ওপরে কী প্রভাব ফেলছে, তা জানাতে উদ্যোগ নেয় বিবিসির উর্দু ওয়েবসাইট (BBC's Urdu Website)। এই উদ্যোগেই সংবাদমাধ্যমের যোগাযোগ হয় মালালার সঙ্গে। প্রায় ১১ বছর বয়স থেকেই তালিবানের অত্যাচার নিয়ে ‘গুল মাকাই’ নামের আড়ালে বিবিসি উর্দু ওয়েবসাইটে 'ডায়েরি' লেখা শুরু করে মালালা। পশতু ভাষায় "গুল মাকাই" র অর্থ হলো "কর্নফ্লাওয়ার"। খুব সহজ ভাষায় লেখা এক কিশোরীর সেই লেখনী দ্বারা গোটা বিশ্ব জানতে পারে তালেবানদের চাপিয়ে দেওয়া অশিক্ষা আর অবহেলার বোঝার ভাঁড় সম্পর্কে। সেই লেখনীতে বারবার স্কুলে আর যেতে পারবেন কি না সেই নিয়ে আশঙ্কা, প্রতি রাতে গোলাগুলির শব্দে ঘুমাতে না পারা, দুঃস্বপ্নের কথা তুলে ধরেন মালালা।

আমি গতকাল সামরিক হেলিকপ্টার এবং তালিবান নিয়ে একটি ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছিলাম। সোয়াতে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে আমি এমন স্বপ্ন দেখছি।  আমি স্কুলে যেতে ভয় পেতাম কারণ মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে তালিবান। এখন ক্লাসে ২৭ নয় মাত্র ১১ জন আসে।

মালালা ইউসুফজাই 

তালিবান শাসন, আর সেই শাসনের জেরে ছোট্ট মালালার জীবনে পড়া প্রভাবের লেখা একসময় বিবিসির ইংরেজি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এরপর ২০০৯ সালে মালালা ও তাঁর বাবাকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় নিউইয়র্ক টাইমস (New York Times)। ২০১১ সালে সোয়াত উপত্যকা থেকে তালেবানকে পিছু হটতে বাধ্য করেন পাকিস্তানি সেনারা। তবে মিঙ্গোরাদের উচ্ছেদ করা হয়। বাস্তুচ্যুত  হন ইউসুফজাইয়ের পরিবার। এরপর মালালাদের গ্রামাঞ্চলে আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে পেশোয়ারে (Peshawar) গিয়ে প্রতিবাদ করেন জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই অর্থাৎ মালালার বাবা। বরাবরই বাবার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন মালালা। তবে এই প্রতিবাদ যেন মালালাকে যুগিয়েছিল এক অদ্ভুত লড়াকু মানসিক শক্তি। এই ঘটনার পরই মালালা ঠিক করেন, দেশকে রক্ষার জন্য রাজনীতিবিদ হবেন তিনি।

আমার একটা নতুন স্বপ্ন আছে..এই দেশকে বাঁচাতে আমাকে একজন রাজনীতিবিদ হতেই হবে। আমাদের দেশে অনেক সংকট রয়েছে। এসব সংকট দূর করতে চাই।

মালালা ইউসুফজাই

তবে সব শেষে ফের একত্রিত হয় মালালার পরিবার। ছোট্ট মালালা ফিরে পান  তাঁর স্কুল। তবে ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও বিগত বছর খানেকে মালালা বুঝতে পেরেছিলেন সমাজের কঠিন বাস্তব। ফলে প্রকাশ্যে তালেবানের বিরুদ্ধে কথা না বললেও নারী শিক্ষার প্রচার নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। একটা সময় গুল মাকাই আত্মপ্রকাশ করে মালালা হিসেবে। সাক্ষাৎকার দিতে থাকেন পাকিস্তানের বিভিন্ন গণমাধ্যমে। কেবল সেই দেশেই নয়, মালালার লেখা নজরকাড়ে গোটা বিশ্বের। তবে এরপরই বাড়তে থাকে প্রাণ সংশয়। তালিবান নৃশংসতার শিকার হন মালালা।

২০১২ সালের ৯ই অক্টোবর স্কুল থেকে ফেরার পথে স্কুলের গাড়িতে থাকা অবস্থায় হামলার শিকার হন কিশোরী মালালা ও তাঁর দুই বান্ধবী। তালিবানের বুলেটের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল মালালার মস্তিষ্কের বাঁ দিকের অংশ। সেই অভিশপ্ত দিনে মালালার সঙ্গে থাকা এক বান্ধবী জানান, যখন তালিবানরা মালালার নাম ধরে ডাকেন তখন চুপ করে থাকেন মালালা। এমনকি তালিবানদের চোখে চোখ রেখে বান্ধবীর হাত শক্ত করে রাখেন তিনি। এরপর যখন মালালার দিকে তালিবান বন্দুক তাঁক করা হয়, তখন নিজের দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে  ফেলেন মালালা। তবে নিমেষের মধ্যেই তালিবানের ছোড়া গুলিতে আহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মালালা।

ঘটনার সময় মালালার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য মালালাকে পাঠানো হয় যুক্তরাজ্যে (UK)। এক সময়ে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকলেও অস্ত্রোপচার করার পর সুস্থ্য হয়ে ওঠেন মালালা। তবে বাদ দিতে হয় তাঁর বাঁ দিকের ‘টেমপোরাল স্কাল বোন’ (Temporal Skull Bone)। এতেই প্রাণরক্ষা হয় তাঁর।  তারপর ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হলে মালালাকে এয়ারলিফ্ট করে ব্রিটেনে (Britain) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই দীর্ঘ চিকিৎসা চলে। তাঁর স্কাল বোনের জায়গায় টাইটেনিয়ামের পাত (Titanium Plate) বসিয়ে দেন চিকিৎসকরা। বর্তমানে মালালার স্কাল বোনের রয়ে যাওয়া অংশটুকু ঠাঁই পেয়েছে মালালার বাড়ির বইয়ের তাকে।

চিকিৎসার পর সুস্থ্য হয়ে ওঠেন মালালা। লেখাপড়া শুরু করেন যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের এজবাস্টন হাইস্কুল ফর গার্লসে (Edgbaston High School for Girls in Birmingham)। ২০১৪ সালে সেই স্কুলের শ্রেণীকক্ষে থাকাকালীনই নোবেল (Nobel Price) পুরস্কার জয়ের খবর পান মালালা। পাকিস্তানের প্রথম ‘জাতীয় যুব শান্তি পুরস্কার’ (National Youth Peace Award) পান মালালা। তাঁর নামে জাতীয় যুব শান্তি পুরস্কারের নামকরণ করা হয় ‘জাতীয় মালালা শান্তি পুরস্কার’ (National Malala Peace Award)। ২০১৩ সালে মালালা তালিবানের শাসনের বিরুদ্ধে নিজের লড়াইয়ের কাহিনী তুলে ধরেন ‘আই অ্যাম মালালা: হাউ ওয়ান গার্ল স্টুড আপ ফর এডুকেশন অ্যান্ড চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে (I Am Malala: How One Girl Stood Up for Education and Changed the World)। সেই বছরই ১২ই জুলাই অর্থাৎ মালালার ১৬তম জন্মদিনে ‘মালালা দিবস’ (Malala Day) ঘোষণা করে জাতিসংঘ (United Nations)। পাশাপাশি নারী শিক্ষার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ওই বছরই গঠন করা হয় মালালা ফান্ড (Malala Fund)। প্রায় এক লাখ সুবিধাবঞ্চিত মেয়েকে পড়াশোনায় সহায়তা করতে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মালালা ফান্ড ও অ্যাপল যৌথভাবে একটি দাতব্য সংস্থা গঠন করার ঘোষণা করা হয়।

২০১৬ সাল থেকে মেয়েদের জীবনের গল্প শুনতে মালালা যান উত্তর আমেরিকা (North America), মধ্যপ্রাচ্য (Middle East), আফ্রিকা (Africa) ও লাতিন আমেরিকার (Latin America) বিভিন্ন দেশে। এরপর ২০১৭ সালে শিশুদের জন্য মালালা লেখেন ‘মালালা’স ম্যাজিক পেনসিল’ (Malala's Magic Pencil) নামে একটি বই। ২০১৮ সালে শরণার্থীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রকাশ হয় মালালার আরেক বই মালালার ‘উই আর ডিসপ্লেসড’ (We Are Displaced)।

ক্রমশ গোটা বিশ্বেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মালালা। নিমন্ত্রণ পান যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (US President Barack Obama) ও তাঁর স্ত্রীর থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের রানি এলিজাবেথের (Queen Elizabeth) কাছ থেকেও।জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনেও মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন মালালা। পরবর্তীকালে কানাডার পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর (Justin Trudeau) হাত থেকে সম্মানসূচক নাগরিকত্বের সনদ গ্রহণ করেন মালালা। ভূষিত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া (Philadelphia) থেকে দেওয়া সম্মানজনক লিবার্টি মেডেল (Liberty Medal) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্মানজনক শাখারভ মানবাধিকার পুরস্কারে (Sakharov Human Rights Award of the European Union)। এমনকি বিখ্যাত টাইম সাময়িকীর করা বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায়ও স্থান পেয়েছিলেন মালালা।

সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (Oxford University) ‘পলিটিকস, ফিলোসফি অ্যান্ড ইকোনমিকস’ (Politics, Philosophy and Economics) বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করেছেন মালালা ইউসুফজাই। আসের মালিকের (Asser Malik) সঙ্গে শুরু করেছেন সংসারও। তবুও থামেনি মালালার লড়াই। ছোটবেলার থেকে নারী শিক্ষা নিয়ে যে লড়াই শুরু করেছিলেন মালালা সেই লড়াই এখনও রয়েছে জারি। বাল্যকালে দেশকে সংকটের হাত থেকে রক্ষা করতে রাজনীতিবিদ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন মালালা। ভবিষ্যতে তিনি হতে চান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।