জীবন ও জীবনী

Biography of Sri Aurobindo Ghose | কর্মযোগী ~ঋষি অরবিন্দ ঘোষ

Biography of Sri Aurobindo Ghose | কর্মযোগী ~ঋষি অরবিন্দ ঘোষ
Key Highlights

শ্রী অরবিন্দ ঘোষ (জন্ম: ১৫ই আগস্ট ১৮৭২ - মৃত্যু: ৫ই ডিসেম্বর ১৯৫০) একজন ভারতীয় দার্শনিক, যোগগুরু, মহর্ষি, কবি এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ছিলেন। তিনি একজন সাংবাদিকও ছিলেন, বন্দে মাতরমের মতো সংবাদপত্র সম্পাদনা করতেন।

ভূমিকা | introduction of Sri Aurobindo Ghose

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোগী ,কবি ,দার্শনিক ও রাজনৈতিক নেতা অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা, চরমপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বৈপ্লবিক সংগ্রামের জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি । স্বাধীনতা পূর্ববর্তী   যুগে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অরবিন্দ ঘোষ   এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

শৈশব | Childhood of Sri Aurobindo Ghose

পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোন্নগর এর ঐতিহ্যশালী প্রাচীন ঘোষবংশের সন্তান ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। ১৮৭২ সালের ১৫ ই আগস্ট এই বীর বিপ্লবী  জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা ছিলেন ডা: কৃষ্ণধন ঘোষ এবং 'জাতীয়তার পিতামহ', রাজনারায়ণ বসু ছিলেন তাঁর মাতামহ। অরবিন্দের মাতা  স্বর্ণলতা দেবী, ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। অরবিন্দ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো 'পদ্ম'।  অরবিন্দ তাঁর জীবনের প্রথম পাঁচটি বছর রংপুরে অতিবাহিত করেছিলেন। ইংরেজী  পদ্ধতিতে সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় নিয়েই অরবিন্দের পিতা ১৮৭৭ সালে  , অরবিন্দ এবং তাঁর দুই অগ্রজ ভাইকে  দার্জিলিংয়ের লোরেটো কনভেন্টে স্কুলে প্রেরণ করেন।

শিক্ষাজীবন | Education life of Sri Aurobindo Ghose

লোরেটো কনভেন্টে দুই বছর অধ্যয়নের পর ১৮৭৯ সালে অরবিন্দ বিলেতের ম্যাঞ্চেস্টার শহরে আসেন ইউরোপীয় শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে। ১৮৮৪ সালে অরবিন্দ ঘোষ লন্ডনের নামকরা বিদ্যালয় সেইন্ট পলস স্কুলে ভর্তি হন যেখানে তিনি গ্রীক, লাতিন , সাহিত্য বিশেষ করে ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছিলেন।  ১৮৮৯ সালে পিতার স্বপ্ন স্বার্থক করে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাশ করেছিলেন শুধু মুখে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র অরবিন্দ ঘোষ। পরবর্তীকালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কিংস কলেজে বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং কিছু মাস বাদে আইসিএস এর লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন ১১তম স্থান লাভ করে। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'ট্রাইপস' লাভ করেন ।

অবশেষে বিলেত ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করেন ১৮৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এবং তার কিছুদিন পর দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়।ভারতের মাটিতে ফিরে এসে অরবিন্দ ঘোষ বরোদায় স্টেস সার্ভিসে যোগদান করেছিলন সার্ভিস এন্ড সেটলমেন্ট বিভাগে, যেখানে পরবর্তীকালে  কোষাগার  এবং অবশেষে সচিবালয়ে গায়কোয়াড়ের জন্য বক্তৃতা লেখার কাজে তাঁকে নিযুক্ত হতে হয়  ।ভারতীয় সংস্কৃতি কে নিয়ে গভীর অধ্যয়ন করেন অরবিন্দ ঘোষ। নিজ উদ্যোগ নিয়ে; সংস্কৃত, হিন্দি এবং বাংলা ভাষার উপর বিশেষ জ্ঞান রপ্ত করেছিলেন। তবে পরবর্তী সময়কালে তাঁকে বারোদা কলেজে ফরাসি ভাষার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয় যেখানে তিনি প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।  পরবর্তীতে  তিনি কলেজের উপাধ্যক্ষের পদে ও নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং  বারোদায় বসবাসকালীন সময়ে ই তাঁর  প্রথম কাব্য সঙ্কলন "The Rishi" প্রকাশিত হয়। ঠিক সেই সময়েই অরবিন্দ ঘোষ ব্রিটিশবিরোধী সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন যেখানে তাঁর  সাথে ভগিনী নিবেদিতা এবং লোকমান্য তিলকের পরিচিতি ঘটে। 

অরবিন্দ ঘোষ  ও ভারতীয় রাজনীতি | Sri Aurobindo Ghose in in Indian politics

অরবিন্দ ঘোষের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক প্রেরণার উৎস ছিল আয়ারল্যান্ড ও রাশিয়ার চলমান বিদ্রোহ ,বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' উপন্যাসে এবং ভারতীয় আধ্যত্মিকতা। বরোদা কলেজে অধ্যাপনাকালে তিনিই মহারাষ্ট্রের ঠাকুর সাহেব নামে জনৈক ব্যক্তি পরিচালিত বৈপ্লবিক 'গুপ্ত সমিতি'র সঙ্গে যুক্ত হন এবং বাংলাদেশে গুপ্ত সমিতি গঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন। মুম্বাইয়ের 'ইন্দু প্রকাশ' পত্রিকায় 'New Lamps for the Old', শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধমালায় কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতৃবৃন্দের  চরমতম দুর্বলতা , অপদার্থতার ও বেইমানির সমালোচনা করে তিনি জাতিকে রক্ত ও অগ্নিস্নানে পবিত্র হয়ে চরম আত্মদানের মাধ্যমে এক বলিষ্ঠ কর্মপন্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি স্পষ্টই বলেন যে কংগ্রেসের লক্ষ্য (কিছু সংস্থার লাভ ,সারা ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন, ভারতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণ ও তার বয়স বৃদ্ধি এবং বিচার ও শাসন বিভাগের  স্বতন্ত্রীকরণ )অবৈধ এবং কর্মপদ্ধতি (আবেদন নিবেদন) নিন্দনীয়।

রাজনৈতিক মতাদর্শ | Political ideology of Sri Aurobindo Ghose

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হলে তিনি বরোদা কলেজের সাড়ে সাতশো টাকা বেতনের  উপাধ্যক্ষের চাকরি ত্যাগ করে বিনা বেতনে কলকাতার 'জাতীয় কলেজে' অধ্যক্ষের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সময় তিনি 'বন্দে মাতরম' পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন (ডিসেম্বর, ১৯০৬) এবং সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঝাঁপ দেন। তাঁর পরিচালনায় 'বন্দে মাতরম' পত্রিকা প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং জাতীয়তাবাদী দলের মুখপাত্রে পরিণত হয়। এই পত্রিকা মারফত তিনি দেশবাসীকে স্বদেশী ও 'স্বরাজ'  এর আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন, নরমপন্থী রাজনীতির দুর্বলতা সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন এবং সরকারি অপশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র কষাঘাত হানেন।ভারতবর্ষে তিনিই সর্বপ্রথম জাতিকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণমুক্ত পূর্ণ 'স্বরাজে'এর মন্ত্রে দীক্ষিত করেন এবং স্বরাজ অর্জনের উপায় হিসেবে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ (স্বদেশী ও বয়কট) ও বিপ্লববাদের কথা বলেন।এদিক থেকে তিনি অহিংস অসহযোগের প্রবর্তক গান্ধীজী এবং সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতিমূর্তি  নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অগ্রদূত।

জাতীয়তাবাদ | Nationalism of Sri Aurobindo Ghose

'দেশ' বলতে অরবিন্দ ঘোষ ,পাহাড়-পর্বত, নদ- নদী প্রভৃতির নিছক কোনও জড় পদার্থকে বোঝেননি; তাঁর কাছে দেশ ছিল চিন্ময়ী মাতৃ স্বরূপা। জাতীয়তাবাদ বলতে তিনি কেবলমাত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিই বোঝেননি ।দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ তাঁর কাছে ছিল ধর্মের শামিল। তাঁর কাছে সনাতন হিন্দু ধর্ম ছিল জাতীয়তাবাদের নামান্তর। জাতির জাতীয়তাবাদ বলতে তিনি বুঝতেন জাতীয় জীবনের পরিপূর্ণতা , প্রাচীন ভারতীয় সত্যযুগের পুনরুত্থান , দূর অতীতের মতো বিশ্ব দরবারে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈদান্তিক আদর্শের পরিপূর্ণতা লাভের জন্য জনগণের আত্ম-স্বাধীনতা। 'বন্দে মাতরম', 'কর্মযোগীন' ও 'ধর্ম 'পত্রিকায় তাঁর এসব আদর্শ ই প্রকাশিত হয়েছে।      

বিপ্লববাদ | Revolutionism of Sri Aurobindo Ghose

কেবলমাত্র প্রকাশ্য গণ আন্দোলন নয় প্রকৃত অর্থেই ঋষি অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন বঙ্গীয় বিপ্লববাদের প্রাণপুরুষ ও মন্ত্রগুরু। তাঁর প্রত্যক্ষ উৎসাহ ,পরামর্শও নেতৃত্বে মানিকতলা বাগানবাড়িতে যুগান্তর দলের প্রধান কর্মকেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং বাংলার বুকে বিপ্লববাদী কার্যকলাপ চলতে থাকে। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আলিপুর বোমার মামলায় তিনি ধৃত হন ।এ সময় তাঁর আইনজীবী চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁকে স্বদেশপ্রেমের কবি, জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ও মানবতার প্রেমিক বলে অভিহিত করেন। 

আধ্যাত্মিকতা | Spirituality of Sri Aurobindo Ghose

জেলখানার অন্ধকারে চিত্তরঞ্জন দাশের দর্শন শ্রীকৃষ্ণ সম প্রতীত  হয় শ্রী অরবিন্দের। ধীরে ধীরে তাঁর  আধ্যাত্মিক বিকাশ পূর্ণতা প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে চলে।উত্তরপাড়া অভিভাষণে  তিনি একজন বিপ্লবী থেকে একজন আধ্যাত্মিক মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার প্রথম বার্তা প্রচার করেন। রাজনৈতিক জীবন পরিত্যাগ করে বিপ্লবী অরবিন্দ ,'ঋষি 'অরবিন্দে রূপান্তরিত হন ১৯১০ সালে  ফরাসি অধিকৃত পণ্ডিচেরিতে বসবাস করা কালীন  তিনি ধর্ম, দর্শন, ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন । পন্ডিচেরিতে একে একে  তৈরি হয় আশ্রম; ঋষি অরবিন্দের সাক্ষাত  হয় শ্রীমার সঙ্গে; প্রকাশিত হয় 'আর্য পত্রিকা'। এইভাবে ক্রমে ক্রমে তাঁর দার্শনিক রচনার সম্ভার বাড়তে থাকে। ১৯২৬ এ প্রতিষ্ঠিত হয় আশ্রম।এই আশ্রমকে কেন্দ্র করে  বিপ্লবীদের আশ্রয় স্থল ও গঠিত হয়েছিল পন্ডিচেরিতে। ফলস্বরূপ, আধাত্মিকতার সাথে সাথে গোপন রাজনৈতিক কার্যকলাপ  ও চলতে থাকত সেখানে।  ঋষি অরবিন্দ তাঁর জীবনের মূল্যবান ৪০ বছর এখানেই অতিবাহিত করেন।

মহাপ্রয়াণ | Death of Sri Aurobindo Ghose

১৯৫০ খ্রীস্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর ঋষি অরবিন্দের মৃত্যু হয় ।

উপসংহার | Conclusion of Sri Aurobindo Ghose

ঋষি অরবিন্দ ছিলেন মানবতার পূজারী।সাধারণ মানুষ এই আত্মত্যাগী বিপ্লবীকে  জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির এক অন্যতম পুরোধা হিসেবে পরিগণিত  করেন।স্বদেশী আন্দোলনের সময়কালে উন্মত্ত বঙ্গভূমি তাঁর অগ্রণী ভূমিকা কখনও অস্বীকার করতে পারে নি। ইতিহাসবিদরা মনে করেন রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের  যোগাযোগ-মাধ্যম  স্থাপন করেছিলেন যে সব দেশনেতারা, অরবিন্দ ঘোষ তাঁদের মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত হন। ইতিহাসবিদ এম কে হালদারের মতে, “অরবিন্দের হাত ধরেই ভারতীয় রাজনীতি ধর্মের লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছিল। সেই থেকেই ধর্ম ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গাঙ্গী উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়।” প্রকৃত ই ,দেশমাতৃকার জন্য নিবেদিত প্রাণ, ত্যাগস্বীকারে বাংলার  যুবসমাজকে ঋষি অরবিন্দ  যে ভাবে অনুপ্রানিত  করেছিলেন, তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে  ইতিহাসের পাতায়।

প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions

অরবিন্দ ঘোষ কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ?

পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোন্নগর এর ঐতিহ্যশালী প্রাচীন ঘোষবংশে অরবিন্দ ঘোষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

অরবিন্দ ঘোষের জন্মতারিখ কী?

১৮৭২ সালের ১৫ ই আগস্ট

অরবিন্দ ঘোষের প্রথম কাব্য সংকলনের নাম কী ?

'The Rishi'

অরবিন্দ ঘোষের রাজনৈতিক প্রেরণার উৎস ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের কোন উপন্যাসটি?

বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ'।

পন্ডিচেরিতে 'অরবিন্দ আশ্রম' কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ?

১৯২৬ সালে এ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

পন্ডিচেরিতে ঋষি অরবিন্দ ঘোষের সাথে কার সাক্ষাৎ হয়?

ঋষি অরবিন্দের সাক্ষাত হয় 'শ্রীমা'র সঙ্গে।

ঋষি অরবিন্দের কবে মহাপ্রয়াণ ঘটে?

১৯৫০ খ্রীস্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর ঋষি অরবিন্দের মৃত্যু হয় ।