জীবন ও জীবনী

Bibhutibhushan Bandopadhyay | লেখনী দ্বারা অমূল্য রতনের সৃষ্টি! নৈসর্গিক কথাশিল্পীর জন্মদিবসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়!

Bibhutibhushan Bandopadhyay | লেখনী দ্বারা অমূল্য রতনের সৃষ্টি! নৈসর্গিক কথাশিল্পীর জন্মদিবসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়!
Key Highlights

১২ই সেপ্টেম্বর বাংলা কিংবদন্তি সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের জন্মদিবস। 'পথের পাঁচালি', 'অপরাজিত', 'চাঁদের পাহাড়'-র মতো সৃষ্টি করেছিলেন অমর, অমূল্য একাধিক উপন্যাস। পড়ুন বিভূতিভূষণের জীবনী সম্পর্কে।

বাংলা সাহিত্যের কথা বললে তাঁর নামটা উঠে আসবে না তা সম্ভব নয়। তাঁর সৃষ্ট গল্প, উপন্যাস কেবল বাংলা সাহিত্যের জন্য বা বাঙালিদের জন্যই নয়, অমর গোটা বিশ্বের জন্য। ইনি, কিংবদন্তি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Bibhutibhushan Bandyopadhyay)। পথের পাঁচালি (Pather Panchali), অপরাজিত (Aparajita) সকলেরই সৃষ্টিকর্তা বিভূতিভূষণ (Bibhutibhushan)। তাঁর অসাধারণ, অতুলনীয় সৃষ্টকেই নিজের প্রতিভার ছোঁয়া দিয়ে গল্পগুলি চলচ্চিত্র আকারে তৈরী করে গোটা বিশ্বের মন জয় করেছিলেন সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray)। আজ, ১২ই সেপ্টেম্বর অপু, দুর্গার সৃষ্টিকর্তা, বাংলার সেই কিংবদন্তি লেখক, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় (Bibhutibhushan Bandopadhyay)এর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ফিরে দেখা তাঁর জীবনীর দিকে।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ব্যক্তি জীবন । Personal Life of Bibhutibhushan Bandyopadhyay :

বাংলার কিংবদন্তি সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১২ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষের বাংলা প্রদেশের চব্বিশ পরগণা জেলার কাঁচরাপাড়ার সন্নিকট, ঘোষপুর-মুড়াটিপুর গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।  প্রখ্যাত মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৃণালিনী দেবীর পঞ্চম পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন বিভূতিভূষণ (Bibhutibhushan)। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রখ্যাত সংস্কৃত বিষয়ক পন্ডিত। মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পান্ডিত্য ও কথকতার জন্য শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিতও হয়েছিলেন।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের শিক্ষা জীবন । Education life of Bibhutibhushan Bandopadhyay :

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের (Bibhutibhushan Bandyopadhyay) শিক্ষার হাতেখড়ি হয় পিতা মহানন্দ মহাশয়ের কাছে। ছোট থেকেই মেধাবী ছিলেন বিভূতিভূষণ। যার ফলে নিজ গ্রামে পাঠশালায় পড়াশোনার পর বনগ্রাম উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসাবে ভর্তি হন তিনি। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে বনগ্রাম হাইস্কুল থেকে এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণও হন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। এরপর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজ, বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে রিপন কলেজ থেকেই বি.এ পরীক্ষায় ডিস্টিংশন সহ উত্তীর্ণ হন বিভূতিভূষণ। তাঁর ছেলেবেলা থেকেই উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ থাকায়, এম.এ ও আইন বিষয়েও পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। যদিও  পরিবারের চাপে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয় বিভূতিভূষণকে।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের বিবাহ জীবন । Marriage Life of Bibhutibhushan Bandopadhyay :

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Bibhutibhushan Bandyopadhyay) প্রথমে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কলেজে বি.এ. তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে পড়ার সময় বসিরহাটের মােক্তার কালীভূষণ মুখােপাধ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীকে বিবাহ করেন। কিন্তু বিয়ের অল্পকাল পরেই গৌরীদেবীর অকালমৃত্যু ঘটে । এই দুর্ঘটনার বহুদিন পরে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ৩ রা ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ছয়গাঁও নিবাসী যােড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা রমা দেবীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হন বিভূতিভূষণ (Bibhutibhushan)। এই দ্বিতীয় বিবাহ বিভূতিভূষণের সাহিত্য জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বাঙালী ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের একমাত্র সন্তান।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কর্ম জীবন । Work Life of Bibhutibhushan Bandopadhyay :

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় হুগলী (Hooghly) জেলার জাঙ্গিপাড়া গ্রামের এক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবন শুরু করেন। পরে সোনারপুরে হরিনাভী স্কুলেও শিক্ষাকতা করেন বিভূতিভূষণ (Bibhutibhushan)। তবে ওই সময়ই বিভূতিভূষণের জীবনে নেমে আসে শোকের ছায়া। মৃত্যু হয় স্ত্রী গৌরী দেবীর। এরপর সন্ন্যাস গ্রহণের পথ বেছে নেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসাবে বাংলা, ত্রিপুরা ও আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন তিনি। সেখান থেকে ফিরে এসে খেলৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে গৃহ শিক্ষক ও সেক্রেটারি হিসাবে কাজ শুরু করেন বিভূতি। খেলৎচন্দ্র ঘোষের সুপারিশেই ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন বিভূতিভূষণ। ভাগলপুরে প্রবাসী হিসাবে বসবাসকালীনই ১৯২৫ সালে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রতন, অমর উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ রচিত করেন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। ভাগলপুরে এভাবে কিছুদিন জীবন পরিচালনার পর ধর্মতলায় খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন বিভূতি। পরে বনগাঁর নিকট গোপালনগর হরিপদ ইনস্টিটিউশনে আমৃত্যু জীবন পর্যন্ত শিক্ষাকতা করতে থাকেন তিনি।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবন । Literary life of Vibhutibhushan Bandopadhyay :

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় 'উপেক্ষিতা' নামক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়েই বিভূতিভূষণ (Bibhutibhushan) তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু করেন। তবে ভাগলপুরে প্রবাসী হিসাবে বসবাসকালীন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ‘পথের পাঁচালী’ রচনা শুরু করেন সাহিত্যিক। ‘পথের পাঁচালী’ লেখা শেষ হয় প্রায় তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে। বিভূতির এই অমূল্য রচনা ১৯২৮-২৯ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যিক সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (Upendranath Gangopadhyay) মাসিক ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে ‘পথের পাঁচালী’। এটিই ছিল বিভূতিভূষণ মহাশয়ের প্রথম ও সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকৃতী যা পরবর্তি কালে চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। 

 এছাড়াও বিভূতিভূষণ (Bibhutibhushan) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘অপরিজিত’ রচনা করেন, যা ছিল পথের পাঁচালী উপন্যাসের পরবর্তী অংশ। এই দুই উপন্যাসের কাহিনীই ছিল তাঁর জীবনকেন্দ্রিক। চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসের কাহিনীর মাধ্যমে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা আজও ব্যাপক জনপ্রিয়।

বাংলা সাহিত্যের আরেক জনপ্রিয় উপন্যাস, কিশোর পাঠ্য ‘চাঁদের পাহাড়’ ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় (Bibhutibhushan Bandopadhyay)। এই উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করেও পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। ২০১৩ সালে চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জি (Kamaleswar Mukherjee) ‘চাঁদের পাহাড়’ চলচ্চিত্র রূপে নির্মাণ করেন, যা বিভূতির উপন্যাসের মতোই জনপ্রিয়তা লাভ করে।

এছাড়াও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Bibhutibhushan Bandyopadhyay) রচিত বিখ্যাত উপন্যাসগুলি হলো- পথের পাঁচালী, অপরাজিত, দৃষ্টি প্রদীপ, আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, বিপিনের সংসার, দুই বাড়ী, ইছামতী, দেবজান, কেদার রাজা, অশনি সংকেত, দম্পতি ইত্যাদি। বিভূতির রচিত গল্প সংকলনের তালিকায় রয়েছে, মেঘমোল্লা, মৌরিফুল, যাত্রা বদল, জন্ম-মৃত্যু, নবাগত, তালনবমী, অসাধারণ, বিধুমাস্টার, উপলখন্ড, জ্যোতিলিঙ্গন, অনুসন্ধান, ছায়াছবি ইত্যাদি। বাঙালি কিংবদন্তি সাহিত্যিক কিশোর-কিশোরীদের জন্যও বহু পাঠ্য রচনা করেছেন, যেমন-  চাঁদের পাহাড়, হিরা মানিক জ্বলে, মরণের ডঙ্কার বাজে ইত্যাদি। এছাড়াও তাঁর রোচিত ভ্রমণমূলক কাহিনীগুলি হলো-  অভিযাত্রিক, স্মৃতির লেখা, তৃনাঙ্গুর, হে অরণ্য কথা কও ইত্যাদি।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা । Awards and Honors received by Bibhutibhushan Bandopadhyay :

বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'ইছামতী' উপন্যাসের জন্য ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার পান। এছাড়াও তাঁর জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বনগাঁ মহকুমার পারমাদান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নাম কিংবদন্তি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের  সম্মানার্থে ‘বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’ (Bibhutibhushan Wildlife Sanctuary) রাখা হয়। এছাড়াও, মার্টিন সেমুর-স্মিথ (Martin Seymour-Smith) তাঁর 'গাইড টু মডার্ন ওয়ার্ল্ড লিটারেচার' (Guide to Modern World Literature) গ্রন্থে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে  "সম্ভবত আধুনিক ভারতীয় ঔপন্যাসিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ" হিসাবে বর্ণনা করেন।

কিংবদন্তি বাংলা সাহিত্যিক, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ জীবনের বেশ কিছু সময় তাঁর অতি প্রিয় পিতৃভূমি ব্যারাকপুর ও তাঁর ভালোবাসার গৌরীকুঞ্জতে কাটিয়েছেন। এসময়েও তিনি সাহিত্য চর্চায় যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি করেছিলেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর তৎকালীন বিহারের ও অধুনা ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলায় ৫৬ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়াণ ঘটে।