World Hepatitis Day | মায়ের হেপাটাইটিস হলে রোগে আক্রান্ত হবে শিশুও! হেপাটাইটিস কীভাবে প্রতিরোধ করবেন জানুন!
২৮শে জুলাই বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। লিভারের প্রদাহ জনিত রোগের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রকার। যার মধ্যে কেবল দুটি প্রকার প্রতিরোধের জন্যই রয়েছে টিকা।
গোটা বিশ্বে প্রায় ২৯৬ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B) আক্রান্ত। হেপাটাইটিস (Hepatitis) একটি ভাইরাল সংক্রমণ যা লিভারে প্রদাহ ঘটিয়ে মেটাবলিজমের (Metabolism) প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দেয়। এই রোগের দুটি প্রচলিত ভ্যারিয়ান্ট বা রূপ হল হেপাটাইটিস বি এবং সি (Hepatitis C)। মূলত হেপাটাইটিসের এই দুই ভ্যারিয়েন্ট প্রসবের সময় একজন হেপাটাইটিস সংক্রমিত মা থেকে তার সন্তানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে হেপাটাইটিস নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রতি বছর ২৮শে জুলাই বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস (World Hepatitis Day)।
বিশ্ব হেপাটাটিস দিবসের ইতিহাস । History of World Hepatitis Day :
বিশ্বকে হেপাটাইটিস মুক্ত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) বা হু (WHO) একটি প্রচার শুরু করেছিল। যার ফলে ২০০৮ সালের ১৯সে মে প্রথম বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালিত হয়। উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালে আমেরিকান চিকিৎসক বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ (Baruch Samuel Blumberg) হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন। যার জন্য তিনি পেয়েছিলেন নোবেল (Nobel) সম্মানও। ফলে ২০১০ সাল থেকে এই নোবেলজয়ী চিকিৎসকের জন্মদিনে অর্থাৎ ২৮শে জুলাইয়ে বিশ্ব হেপাটাটিস দিবস পালন করা শুরু করা হয়। প্রসঙ্গত, কেবল হেপাটাটিস বি এর আবিষ্কারই নয়, হেপাটাইটিস বি-র জন্য একটি পরীক্ষা ও টিকাও উদ্ভাবন করেছিলেন স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ।
বিশ্ব হেপাটাটিস দিবসের তাৎপর্য্য । Significance of World Hepatitis Day :
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কেবল ভারতেই (India) হেপাটাইটিস বি এবং সি-এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বহু। বর্তমানে আনুমানিক ৪০ মিলিয়ন ভারতীয় এই রোগে সংক্রমিত। যার মধ্যে গর্ভবতী মায়ের থেকে সন্তানের মধ্যে এই সংক্রমণ ছড়ানোর ঘটনাও দেখা যায়। এই সংক্রমণকে অন্যতম ভয়ঙ্কর বলে বিবেচনা করেন চিকিৎসকরা। কারণ এই ভাইরাসের জেরে বড়সড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয় একটি সদ্যজাতকে। ফলে প্রতি বছর এই দিনে জনসাধারণকে হেপাটাইটিসের বিভিন্ন প্রকারের পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক কৌশল, পরীক্ষা এবং চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন করা হয়। এছাড়াও গোটা বিশ্বে হেপাটাটিস নির্মূল করার জন্য এদিন টিকাদান, প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলিতে উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেওয়া হয়।
বিশ্ব হেপাটাটিস দিবস ২০২৩ এর থিম । Theme of World Hepatitis Day 2023 :
প্রতি বছর বিশ্ব হেপাটাটিস দিবস ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য বা থিমের ওপর নির্ভর করে পালন করা হয়। হেপাটাইটিস সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য এ বছরের থিম হচ্ছে 'এক জীবন, এক লিভার' (One Life, One Liver)। প্রতি বছর, দিবসটি বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং এই রজার বিরুদ্ধে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট থিমকে কেন্দ্র করে পালন করা হয়।
হেপাটাইটিসের প্রকার । Types of Hepatitis and Disease Causes, Symptoms :
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসে কেবল হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাই নয়, এর ভিন্ন প্রকার সম্পর্কেও সমাজকে শিক্ষা দেওয়া হয়। হেপাটাইটিস প্রধানত পাঁচ প্রকারের হয়। হেপাটাটিস এ (Hepatitis A), বি (Hepatitis B), সি (Hepatitis C) , ডি (Hepatitis D) ও ই (Hepatitis E)। এই পাঁচ ধরনের ভাইরাল হেপাটাইটিসের মধ্যে পার্থক্য জানা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর দ্বারা আপনি হেপাটাইটিসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং প্রয়োজনে উপযুক্ত চিকিৎসা করতে পারবেন। জেনে নিন ভিন্ন হেপাটাইটিসের সম্পর্কে, কীভাবে এই প্রকারের হেপাটাইটিস হয় এবং এর লক্ষণগুলি কী কী।
হেপাটাইটিস এ । Hepatitis A :
এই প্রকার হেপাটাইটিস সবচেয়ে সাধারণ প্রকার। হেপাটাইটিস-এ সাধারণত দূষিত খাবার বা জলের সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে। এই সংক্রমণ স্বল্পমেয়াদী অসুস্থতা অর্থাৎ লিভারের প্রদাহ সৃষ্টি করে। হেপাটাইটিস- এ এর উপসর্গগুলির মধ্যে ত্বক এবং চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া বা জন্ডিস (Jaundice), গাঢ় প্রস্রাব, বমি বমি ভাব, বমি, পেটে ব্যথা, ক্লান্তি এবং জ্বর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তবে হেপাটাইটিস-এ থেকে রক্ষা পেতে ভ্যাকসিন পাওয়া যায়।
হেপাটাইটিস বি । Hepatitis B :
এই প্রকারের হেপাটাইটিস লিভারের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এটি সাধারণত রক্ত বা অন্যান্য শারীরিক তরলের সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে। হেপাটাইটিস বি-এর লক্ষণগুলির মধ্যে জন্ডিস, গাঢ় প্রস্রাব, বমি বমি ভাব, বমি, পেটে ব্যথা, ক্লান্তি এবং জ্বর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তবে ঠিক মতো চিকিৎসা না করা হলে এই সংক্রমণ দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। হেপাটাইটিস-বি থেকে সুরক্ষার জন্য ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। এছাড়াও এই রোগ প্রতিরোধের জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধও (Antiviral Medicine) পাওয়া যায়।
হেপাটাইটিস সি । Hepatitis C :
হেপাটাইটিস-বি এর মতো হেপাটাইটিস-সি সংক্রমণের সৃষ্টির কারণ, লক্ষণ এক। হেপাটাইটিস-সি লিভারের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং এটি সাধারণত রক্ত বা অন্যান্য শারীরিক তরলের সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে। হেপাটাইটিস সি-এর লক্ষণগুলির মধ্যে জন্ডিস, গাঢ় প্রস্রাব, বমি বমি ভাব, বমি, পেটে ব্যথা, ক্লান্তি এবং জ্বর দেখা যায়। তবে হেপাটাইটিস- এ এবং বি এর মতো হেপাটাইটিস-সি সংক্রমণ রোধ করার জন্য বা চিকিৎসা করার জন্য এখনও পর্যন্ত ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কার হয়নি। তবে এর চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ পাওয়া যায়।
হেপাটাইটিস ডি । Hepatitis D :
হেপাটাইটিসের এই সংক্রমণ সাধারণ নয়, বরং অস্বাভাবিক। যেসকল ব্যক্তি আগের থেকেই হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত তারা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। হেপাটাইটিসের এই সংক্রমণ মূলত রক্ত বা অন্যান্য শারীরিক তরলের সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে। হেপাটাইটিস ডি-এর লক্ষণগুলির মধ্যে জন্ডিস, গাঢ় প্রস্রাব, বমি বমি ভাব, বমি, পেটে ব্যথা, ক্লান্তি এবং জ্বর অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই যোগ হলে বেশি চিন্তা থাকে কারণ একেই হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যাক্তির এই সংকরণ হয়। দ্বিতীয়ত হেপাটাইটিস-ডি এর চিকিৎসার জন্য কোনও ভেকসিন বা টিকা নেই। ফলে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহার করে এবং নিয়মবিধি মেনে এই রোগের বিরুদ্ধে লড়তে হয়।
হেপাটাইটিস ই । Hepatitis E :
হেপাটাইটিসের এই সংক্রমণ লিভারের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এটি সাধারণত দূষিত খাবার বা জলের সংস্পর্শে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। হেপাটাইটিস ই-এর লক্ষণগুলির মধ্যে জন্ডিস, গাঢ় প্রস্রাব, বমি বমি ভাব, বমি, পেটে ব্যথা, ক্লান্তি এবং জ্বর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। হেপাটাইটিস সি,ডি এর মতো ই-এর কোনো ভ্যাকসিন বা নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। হেপাটাইটিসের এই সংক্রমণের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রেও অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
হেপাটাইটিস রোগ প্রতিরোধ । Hepatitis Disease Prevention :
হেপাটাইটিসের কিছু প্রকারের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন থাকলেও একাধিক সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য টিকা নেই। সেক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম মানার সঙ্গে সঙ্গে খেতে হয় ওষুধ। তবে হেপাটাইটিস রোগ প্রতিরোধ করার জন্য আগের থেকেই বেশ কিছু বিষয় মেনে চলতে হয়। জীবনধারা পরিচালনা করতে হয় সঠিকভাবে। যেমন- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, মদ্যপান এড়িয়ে চলা, ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরণ করা।
এছাড়াও পরিষ্কার জল ও খাবার খাওয়া, রক্তের সংস্পর্শে আসা সরঞ্জামগুলি অর্থাৎ সুঁচ এবং হাসপাতালের অন্যান্য সরঞ্জাম একের বেশি ব্যক্তির ব্যবহার না করা, শেভিং সেট, ব্লেড এবং টুথব্রাশ শেয়ার করা এড়ানো,ট্যাটু বা আকুপাংচার করলে তা স্বাস্থ্যকর যায়গা থেকে করানোর মতো নিয়ম মেনে চললে হেপাটাইটিস রোগ থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ফোর্টিস হাসপাতালের (Fortis Hospital) গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট (Gastroenterologist) চিকিৎসক জানান, গর্ভবতী মহিলারা হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসের বাহক হলে সন্তানের মধ্যেও সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি ৯০ শতাংশ থাকে। ফলে সঠিক সময়ে মায়ের চিকিৎসা না করালে শিশুর দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি হতে পারে। পাশাপাশি ৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুর হেপাটাইটিস-সি সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। এক্ষেত্রে প্রজননক্ষম হলেই মহিলাদের হেপাটাইটিস বি এবং সি এর জন্য পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। পরীক্ষার ফল ইতিবাচক হলে শিশুর সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকে। অন্যদিকে, পরীক্ষার ফল নেতিবাচক হলেও সেক্ষেত্রেও আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।