Uttarkashi Tunnel Rescue | উত্তরকাশিতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা! বিঘ্নিত হতে পারে শ্রমিকদের উদ্ধারকাজ! স্পর্শকাতর পরিবেশে পরপর নির্মাণ-বৃক্ষনিধনের 'ফলাফল', মত পরিবেশবিদদের!
উত্তরকাশিতে ১৬ দিন ধরে আটকে ৩ জন বাঙালি-সহ ৪১ জন শ্রমিক। পি[ওর পর উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত। এবার উত্তরকাশিতে বৃষ্টি-তুষারপাতের আশঙ্কার কথা জানালো হাওয়া অফিস। পাহাড় -গাছ কাটায় উত্তরাখণ্ডে বিপর্যয় হচ্ছে বলে জানালেন পরিবেশবিদরা।
কেটে গিয়েছে ১৫ দিন। এখনও উদ্ধার করা যায়নি উত্তরকাশী (Uttarkashi) সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গে আটকে পড়া ৪১ শ্রমিককে। আজ, ১৬ তম দিনে আরও বড় আশঙ্কার কথা সামনে এলো। উত্তরকাশীতে বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা জানালো আবহাওয়া দফতর। সেই সঙ্গে রয়েছে বরফ পড়ার সম্ভাবনাও। বৃষ্টি ও তুষারপাত হলে ফের ব্যাহত হতে পারে উদ্ধারকাজ। এমনকি আটকে পড়া শ্রমিকদের বাঁচানোর ক্ষেত্রেও তৈরী হতে পারে ধোঁয়াশা। তাহলে কি প্রকৃতির শাস্তিই পাচ্ছেন শ্রমিকরা?
কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটলো?
কেন্দ্রের প্রত্যাশার চার ধাম প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী এক পথে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনেত্রী যাওয়ার জন্য উত্তরকাশীর সঙ্গে যমুনেত্রীকে জুড়তেই সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছিল। সেই সুড়ঙ্গেই ধস নামে গত ১২ ই নভেম্বর। এই ধসের জেরে ৬০ মিটার ধ্বংসস্তূপের পিছনে আটকে পড়েন ৪১ জন শ্রমিক। সেই থেকেই এখনও পর্যন্ত শিরোনামে উত্তরকাশীর খবর (Uttarkashi News)।এই দুর্ঘটনার পর থেকে নানাভাবে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে। তবে এখনও সাফল্য মেলেনি। দু’সপ্তাহ ধরে বদ্ধ সুড়ঙ্গে আটকে আছেন শ্রমিকেরা। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছে। পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে খাবার, জল এবং অক্সিজেনও।
এখনও পর্যন্ত উদ্ধারকাজ :
১২ তারিখ উত্তরকাশির সুড়ঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটার পরই শুরু হয় উদ্ধারকার্য। ১৩ ই নভেম্বর সুড়ঙ্গে প্লাস্টার, ড্রিল করে উদ্ধার করার চেষ্টার করা হয় শ্রমিকদের।তবে ব্যর্থ হয় সেই পরিকল্পনা। ঝরতে থাকা মাটি, পাথর আটকানোর চেষ্টা করা হয়। এরপর ১৪ইনভেম্বর ব্যবহার করা হয় উদ্ধারের প্ল্যান বি! সেদিন ড্রিল করে পাইপ ঢোকানোর চেষ্টা করা হয় কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। এরপর শ্রমিকদের উদ্ধারকার্যে বিদেশী প্রযুক্তির ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার ফলে ১৫ই ও ১৬ই নভেম্বর দিল্লি থেকে নিয়ে আসা হয় মার্কিনি অগার মেশিন। এই মেশিন দ্বারা ২৪ মিটার পর্যন্ত খোঁড়া সম্ভব হয়। শ্রমিকদের উদ্ধারকাজে দেখা যায় আশার আলো। তবে ১৭-১৮ ই নভেম্বর অগার মেশিনে সমস্যা ধরা পড়ে। বন্ধ করে দেওয়া হয় উদ্ধারকাজ। নিয়ে আসা হয় ব্রেক ও নতুন মেশিন।১৯, ২০, ২১ নভেম্বর এই তিন দিনে বহু প্রচেষ্টা পর ভিতরে প্রবেশ করানো যায় ৬ ইঞ্চির লাইফলাইন পাইপ। সেই পাইপ দ্বারা শ্রমিকদের কাছে পৌঁছায় ক্যামেরা। দেখা মেলে আটকে থাকা শ্রমিকদের। এরপর ২২সে নভেম্বর ফের অগার মেশিনের সাহায্যে ৪৫ মিটার পর্যন্ত পাইপ প্রবেশ করানো হল। তবে অনেকটা এগিয়েও থমকে যায় উদ্ধার কাজ। ২৩ ও ২৪ সে নভেম্বর গার্ডরেল সামনে চলে আসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় অগার মেশিন। মেশিনে কাজ শুরু করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এর দ্বারা একটু একটু করে খননকার্জ হচ্ছিল আর উদ্ধারকারীরা সেই পথে পাইপ ঢোকানোর কাজ চালাচ্ছিলেন। কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর ওই পথেই আবার মেশিনটিকে ফিরিয়ে আনা হত। কিন্তু, তার আগেই মেশিনটি ভেঙে যায়। জানা যায়, ১৫ মিটার পর্যন্ত বাইরে বের করে আনার পর মেশিনের ব্লেড ভেঙে যায় এবং সুড়ঙ্গপথে সেটি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
বর্তমান পরিস্থিতি :
বিদেশে তৈরী অগার মেশিন সুড়ঙ্গপথে ভেঙে পড়ে থাকার কারণে সুড়ঙ্গপথের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ৮০০ মিটার চওড়া এবং ৩২ মিটার লম্বা এই অগার মেশিনের টুকরোগুলি সুড়ঙ্গ থেকে বের করে আনা রীতিমতো চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়। এমনকি এই কাজের জন্য হায়দরাবাদ থেকে বিশেষ প্লাজমা কাটিং মেশিনও নিয়ে আসা হয়। যার সাহায্যে স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, তামা এবং অন্য ধাতুর বস্তু কাটা যায় অনায়াসেই। ইতিমধ্যেই রবিবার বারকোট ও সিল্কিয়ারার মাঝে পাহাড়ের ওপর থেকে শুরু হয়েছে ভার্টিক্যাল ড্রিলিং। এই পদ্ধতিতে পাহাড়ের মাথা থেকে সুড়ঙ্গ পর্যন্ত উল্লম্বভাবে প্রায় ৮৬ মিটার পাথর কাটা হবে। জানা গিয়েছে এখনও পর্যন্ত ৩০ মিটারের বেশি অংশে গর্ত খোঁড়া সম্ভব হয়েছে। বের করে আনা হয়েছে অগার মেশিনের ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া অংশ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে মানুষ দিয়ে পাথর কাটার কাজ। সূত্রের খবর, ভার্টিক্যাল ড্রিলিংয়ের জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে ৫টি হ্যামার। এক একটি হ্যামারের দৈর্ঘ্য ২২ মিটার। প্রতিটি হ্যামারের মুখে লাগানো আছে মোটা লোহার ব্লেড। পাহাড়ের মাথায় ভার্টিক্যাল ড্রিলিংয়ের যন্ত্র যাতে কম সময়ে পৌঁছে দেওয়া যায়, তার জন্য দ্রুত ১১৫০ মিটার দীর্ঘ রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন। পাশাপাশি পাহাড়ের ওপর থেকে লম্বালম্বি কেটে আরও একটি লাইফ লাইন দ্রুত চালু করা হচ্ছে। এভাবে পাহাড় কেটে তৈরি করা ৮৬ মিটার রাস্তাও শেষ হওয়ার মুখে। এই পথেও খাবার, ওষুধ ও অন্য়ান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সুড়ঙ্গে আটকে থাকা শ্রমিকদের পাঠানোর ব্যবস্থা থাকছে। উত্তরকাশী (Uttarkashi)তে সুড়ঙ্গে আটকে থাকা শ্রমিকদের কাছে খাবার, পানীয় জল, ওষুধ, অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে পাইপের মাধ্যমে। ভার্টিক্যাল ড্রিলিং করতে গিয়ে কোনওভাবে যদি সেই সাপ্লাইলাইনের ক্ষতি হয়, তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি রাখা হচ্ছে বলে খবর।
প্রকৃতির পাল্টাঘাত :
ম্যানুয়ালি খনন করে উত্তরকাশিতে আটকে থাকা শ্রমিকদের উদ্ধারকাজ শুরু হতে চলেছে। ফলে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন উদ্ধারকাজের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা। তবে এরই মধ্যে বড় আশঙ্কার কথা জানালো হাওয়া অফিস। আবহাওয়াবিদ জানাচ্ছেন, উত্তরকাশীতে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বরফ পড়ার সম্ভাবনাও। মৌসম ভবন সূত্রে রবিবারই জানানো হয়েছিল, পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবে উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। এ দিনও মৌসম ভবন জানায়, আজ, সোমবার থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হতে পারে সেখানে। সোমবার হালকা থেকে মাঝারি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলেও বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে মঙ্গলবার। ভারী বৃ্ষ্টির পাশাপাশি তুষারপাতের সম্ভাবনাও রয়েছে। পাহাড়ে বৃষ্টি নামলে কার্যতই উদ্ধারকাজ বিঘ্নিত হবে। সঙ্গে ধস নামারও প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। যে অংশের মাটি খনন করা হচ্ছে, তা বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধস নামতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন : ভারতীয়দের জীবন থেকে ৫ বছর ছিনিয়ে নিচ্ছে বায়ু দূষণ! শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টে চাঞ্চল্য!
তবে সুড়ঙ্গে ধস নামা, বৃষ্টি-তুষারপাত এমনকি বারংবার উদ্ধারকাজ ভঙ্গ হয়ে যাওয়া সব ঘটনাই নেহাত দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ পরিবেশবিদদের একাংশ। তাদের মতে উত্তরাখণ্ডের এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রকৃতির উপর যথেচ্ছ অত্যাচার বন্ধ হওয়া উচিত। কারণ চলতি বছরেই বার বার বিপর্যয় নেমে এসেছে উত্তরাখণ্ডে, কখনও জোশীমঠে মাটির অবনমন, কখনও বানভাসি পরিস্থিতি কখনও আবার ভূমিকম্প, তাতে নয়া সংযোজন সুড়ঙ্গ বিপর্যয়। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্গত লাদাখ থেকে অরুণাচলপ্রদেশ পর্যন্ত হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্গত রাজ্যগুলিকে এমনিতেই পরিবেশগত ভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যার ফলে পাহাড়ি এলাকায় উন্নয়নের নামে পাহাড় কেটে রাস্তা বা ইতিউতি নির্মাণের বিরুদ্ধে বরাবরই সরব পরিবেশবিদরা। সামান্য পরিবর্তন ঘটাতে গেলেই বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসার সম্ভাবনা তৈরী হয় এই এলাকায়। পরিবেশবিদদের মতে, মেঘভাঙা বৃষ্টি হোক বা হড়পা বান, অথবা ভূমিকম্প, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে কোনও কিছুই ছোট বা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। বর্তমানে এই এলাকায় একাধিক বিপর্যয়ের নেপথ্যে রয়েছে 'মানুষ'ই!
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাস্তবায়ন শুরু হয় ১২০০০ কোটি টাকার চারধাম প্রকল্প। আর এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘটাতে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের ৮৮৯ কিলোমিটার জায়গা শনাক্ত করা হয়েছে। এর আওতায় কোথাও পাহাড় কেটে রাস্তা, সুড়ঙ্গপথ, বাইপাস, এমনকি উড়ালপুলও গড়ে তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ। ২০০২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশনকে যে সমস্ত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশই পুরাতন বন্য আইনের আওতায় বলে অভিযোগ ওঠে। শুধু তাই নয়, যে জাতীয় সড়কটির নির্মাণ হয়েছে, সেটিও রাজাজি ন্যাশনাল পার্ক, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ন্যাশনাল পার্ক, কেদারনাথ ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি এবং ভাগীরথী পরিবেশ সংবেদনশীল অঞ্চলের মধ্যে পড়ে বলে জানা গিয়েছে। পাশাপাশি দুই লেন বিশিষ্ট রাস্তা গড়ে তোলা নিয়ে পরিবহণ সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরেছে কেন্দ্র। কিন্তু পরিবেশবিদদের দাবি, যে এলাকা দিয়ে এই রাস্তা এগিয়েছে, সেখানে অহরহ ধস নামে। গাছপালা সব কেটে সাফ করে দেওয়ায় বিপদ আরও বেড়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গত, এখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ২০১৯ সালে বিশেষ কমিটি গড়ে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court)। পরিস্থিতি সব কিছু খতিয়ে দেখে ওই কমিটি যে রিপোর্ট জমা দেয়, তাতে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সতর্কবার্তা তোয়াক্কা না করেই রাস্তা তৈরির কাজ চলতে থাকে।
কেন্দ্রের প্রত্যাশার চার ধাম প্রকল্প ছাড়াও ৩৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ চারধাম রেল প্রকল্প গড়ার কাজ শুরু হয়েছে উত্তরাখণ্ডে। ওই রেলপথ এগিয়ে নিয়ে যেতেও জায়গায় জায়গায় সুড়ঙ্গের নির্মাণ শুরু হয়েছে। জোশীমঠের অবনমনের জন্য এই যত্রতত্র সুড়ঙ্গ খোঁড়া এবং পাহাড় কাটাকেই দায়ী করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকার্যের দিকেও আঙুল উঠেছিল। তাই সুড়ঙ্গ বিপর্যয় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলেও, তার সঙ্গেও প্রকৃতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। অর্থাৎ 'মানব' সমাজের কল্যাণের জন্য পাহাড় তথা প্রকৃতির ধ্বংসলীলার পাল্টাঘাত হিসেবে ফিরে আসছে ধস, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বলা চলে এখন যেমন গোটা দেশবাসীর নজরে উত্তরকাশীর খবর (Uttarkashi News) তেমনই উদ্ধারকারী দল ও পরিবেশবিদদের নজর প্রকৃতির পাল্টাঘাতের দিকে। কারণ প্রকৃতি তার ধ্বংসলীলা শুরু করলেই প্রাণ সংশয় হতে পারে সুড়ঙ্গে আটকে থাকা শ্রমিকদের।
- Related topics -
- দেশ
- ভারত
- উত্তরাখন্ড
- পরিবেশ
- পরিবেশ রক্ষা
- পরিবেশ সুরক্ষা
- পরিবেশ বান্ধব
- বৃষ্টিপাত
- ভূমিধস
- তুষারপাত
- কেন্দ্রীয় সরকার