S Somnath | একটা সময় ছিল না হস্টেলের টাকা দেওয়ার মত সামর্থ্য, আজ তিনি ইসরো প্রধান! জানুন এস সোমনাথের সাফল্যের কাহিনী!
চাঁদের বুকে ভারতের পা রাখা থেকে আরও বহু মহাকাশ অভিযানের আড়ালে মূল কান্ডারি ছিলেন তিনি। তবে চন্দ্রযানের মিশনের মতোই ইসরো চেয়ারম্যান এস সোমনাথকেও জীবনে অনেক ব্যর্থতা, অনেক কঠিন পথের মোকাবিলা করতে হয়েছে সাফল্য অর্জন করার জন্য।
২০২৩ সালে চাঁদের দক্ষিণমেরুতে সর্বপ্রথম পা রেখে নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করে ভারত তথা ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO) এর চন্দ্রযান-৩। এরপর আদিত্য এল-১ মিশন দ্বারাও মহাকাশ বিজ্ঞানে নয়া অধ্যায়ের সূচনা করে ইসরো।মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে ক্রমাগত নানান পরীক্ষা করে চলেছে ইসরো। যার ফলে বর্তমানে গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের এক নতুন পরিচয়, সম্মান তৈরী হয়েছে। ইসরো এবং ইসরোর সাফল্যের কথা উঠলেই যে মানুষটার কথা তুলতেই হয় ভারতের সেরা ১০ বিজ্ঞানী (top 10 scientists of india) তথা তিনি এই সংস্থার বর্তমান চেয়ারম্যান এস সোমনাথ (S. Somnath)। চাঁদের বুকে ভারতের পা রাখা থেকে আরও বহু মহাকাশ অভিযানের আড়ালে মূল কান্ডারি ছিলেন তিনি। তবে চন্দ্রযানের মিশনের মতোই ইসরো চেয়ারম্যান এস সোমনাথকেও জীবনে অনেক ব্যর্থতা, অনেক কঠিন পথের মোকাবিলা করতে হয়েছে সাফল্য অর্জন করার জন্য। একটা সময় হস্টেলের টাকা দেবার মতও সামর্থ্য ছিল না ইসরোর বিজ্ঞানীর (isro scientist)। আজ জেনে নেবো ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী (top scientists of india) এস সোমনাথের জীবন সংগ্রাম এবং সাফল্য সম্পর্কে।
ইসরো প্রধান এস সোমনাথের সাফল্যের কাহিনী । Success Story of ISRO chief S. Somnath :
এস সোমনাথের পুরো নাম শ্রীধরা পানিকার সোমনাথ (Sridhara Panikar Somnath)। বর্তমানে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যান তথা একজন মহাকাশ প্রকৌশলী, রকেট এবং ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী (top scientists of india) তিনি । ভারতের সেরা ১০ বিজ্ঞানী (top 10 scientists of india) এর তালিকার মধ্যে যে এস সোমনাথ রয়েছেন তা বলা ভুল হবে না। যার ফলে ২০১৮ সালে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারে (VSSC) পরিচালক হিসাবে কাজ করার সময় খ্যাতি পান তিনি। তবে এই খ্যাতি যে এক দিনে মিলেছে তা নয়। তার জন্য রয়েছে দিনের পর দিনের পরিশ্রম।
ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবার :
১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে কেরালার আলাপ্পুঝারের অরুরে দক্ষিণ ভারতীয় পরিবারে জন্ম নেন এস সোমনাথ। সোমনাথের বাবা বেদামপারম্বিল ছিলেন পেশায় একজন স্কুলের হিন্দি শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই এক শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা পরিবারে বেড়ে উঠেছেন সোমনাথ। কেরিয়ার শুরুর দিকে বাবাই ছিলেন সোমনাথের আদর্শ-পথপ্রদর্শক। তিনিই ছিলেন সোমনাথের চোখে রোল মডেল। কাজে প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার প্রাথমিক পাঠ পেয়েছিলেন বাবার থেকেই। বাবাই শিখিয়েছিলেন কাজের গুরুত্ব। সব কাজে পরিবারের সমর্থন পেয়েছেন বরাবর। ছেলে সোমনাথের পড়াশোনার দিকে মা থাংকাম্মারও ছিল কড়া নজর। পড়াশোনার বিষয়ে সবসময় ছেলেকে সমর্থন করেছেন। ছোটবেলায় মায়ের কাছেই পড়তেন সোমনাথ। ছেলের পড়াশোনার পরিধি বাড়াতে ছোট থেকেই তাঁকে একাধিক বই পড়ানোর অভ্যাস করিয়েছিলেন তাঁর বাবা। সিলেবাসের বাইরেও বই পড়ারও অভ্যাস করিয়েছিলেন। নিয়ে আসতেন মালায়ালম এবং ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞানের ভালো ভালো বই। ছোট থেকেই মা-বাবার কঠোর শাসন সঙ্গে সঠিক গাইডেন্সে আজ সোমনাথ সুপ্রতিষ্ঠিত।
উল্লেখ্য,এস সোমনাথের স্ত্রীর নাম ভালসালাকুমারী। ফিনান্স গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স (GST) বিভাগে কাজ করেন সোমনাথ-জায়া। তাঁদের রয়েছে দুই যমজ সন্তান। এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুই জনই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। ছেলের নাম মাধব, মেয়ের নাম মালিকা।
পড়াশোনা ও কেরিয়ার :
ছোট থেকে মেধাবী ছাত্র সোমনাথ। তাঁর আগ্রহ ছিল বিজ্ঞানে। সেন্ট অগাস্টিন হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন সোমনাথ। স্কুল জীবন শেষের পর ভর্তি হন এর্নাকুলামের মহারাজা কলেজে। সেখান থেকে তিনি স্নাতক পাশ করেন। গণিত এবং পদার্থবিদ্যায় প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন সোমনাথ। এরপূর্র ১৯৮৫ সালে কোল্লামের টিকেএম কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বি টেক ডিগ্রি ( ব্যাচেলর অফ টেকনোলজি) অর্জন করেন। ১৯৯৫ সালে ব্যাঙ্গালোরের IISC (Indian Institute of Science) থেকে মহাকাশ প্রকৌশল এবং গতিবিদ্যা নিয়ন্ত্রক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর দীর্ঘদিন বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করেছেন এস সোমনাথ। পরে আবারও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, (IIT) মাদ্রাজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রসঙ্গত, মালয়ালম ভাষায় লেখা এস সোমনাথ একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। সেই জীবনীতে তিনি লিখেছেন একটা সময় হস্টেলের টাকা দেবার মতও সামর্থ্য ছিল না তাঁদের। একটা পুরনো সাইকেলে চড়ে কলেজে যেতেন এস সোমনাথ, বাসে ওঠার ভাড়ার টাকাও ছিল না তাঁর কাছে। প্রবল অর্থকষ্টেই কেটেছে তাঁর শৈশব এবং কৈশোরের দিনগুলো। কেরালার কোল্লাম জেলায় পড়াশোনার জন্য খুব ছোট্ট একটা ঘরে কোনওভাবে থাকতে হয়েছে তাঁকে। কারণ হস্টেলে থাকার মত অর্থবল ছিল না তাঁর। কিন্তু সেই ঘরে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। কেরালার টিকেএম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশোনা করেছেন এস সোমনাথ। কিন্তু সেটাও সম্ভব হত না। অন্য পাঁচজন সাধারণ গ্রামের ছেলের মত তিনিও কৈশোরে ভেবে উঠতে পারছিলেন না বিএসসি করবেন না ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন।পরে পিটিআই সংবাদমাধ্যমকে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে, কেউ একজন তাঁকে এই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভর্তির ফর্ম হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন। তা নাহলে তাঁর আর সেই কলেজে পড়াই হয়ত হয়ে উঠত না। কলেজে পড়ার সময় অর্থকষ্টের দরুণ স্টাডি ট্যুরেও যেতেন না এস সোমনাথ।
ইসরোতে সোমনাথ :
১৯৯৫ সালে ইসরোর বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারে (VSSC) প্রথম চাকরি পান সোমনাথ। একই বছরে পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল (PSLV)-এর প্রজেক্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন এই ইসরোর বিজ্ঞানী (isro scientist)। ২০১০ সালে জিওসিঙ্ক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল MK3 (GSLV MK3)-এর প্রজেক্ট ডিরেক্টরের দায়িত্ব পান এস সোমনাথ। প্রকল্পের পরিচালক হিসাবে কাজ করার পাশাপাশি প্রায় ৪ বছর ধরে স্পেস অর্ডিন্যান্স স্ট্রাকচার এন্টিটির ডেপুটি ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেছেন শ্রীধরা সোমনাথ । ২০১৫ সালে লিকুইড প্রপালশন সিস্টেম সেন্টারের ডিরেক্টর এবং ইসরোর VSSC-এর ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। এরপর ১২ই জানুয়ারি ২০২২, ইসরোর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ইসরোর VSSC-এর দায়িত্বে ছিলেন।
এক সময়ে অর্থাভাবের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল এস সোমনাথকে। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রতি মাসে প্রায় ২.৫ লক্ষ টাকা বেতন পান এস সোমনাথ। বার্ষিক আয় প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ দুই থেকে ছয় কোটি টাকা। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন বহু সম্মান। বিজ্ঞান ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তামিলনাড়ুর SRM বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে ডক্টরেট অফ সায়েন্সে ভূষিত করে। GSLV Mk-III উৎক্ষেপণের জন্য অ্যাস্ট্রোনটিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া (ASI) থেকে গোল্ড মেডেল এবং ইসরো থেকে পারফরম্যান্স এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড - ২০১৪ ও টিম এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০১৪ সম্মান পান। ২০২৩ সালে, কর্ণাটক সরকার তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ রাজ্যোৎসব পুরস্কারে ভূষিত করে।
ইসরোর সাফল্য এবং ভারতের মহাকাশ গবেষণায় সোমনাথের অবদান বলে শেষ হওয়ার নয়। মহাকাশযানের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছেন, পাইরোটেকনিক, স্ট্রাকচারাল ডিজাইনিং, গতিবিদ্যাতেও অবদান রেখেছেন এস সোমনাথ। এস সোমনাথের সাফল্যের কাহিনী (success story) আজ অনুপ্রেরিত করে যুব সমাজকে। আজ তিনিই ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানের অন্যতম পথপ্রদর্শক। চন্দ্রযান ৩-এর বিপুল সাফল্যের কান্ডারি তিনিই।