পদার্থবিজ্ঞানী মোহাম্মদ আতাউল করিমের জীবনী, Mohammad Ataul Karim's biography in bengali

Monday, July 18 2022, 10:58 am
highlightKey Highlights

পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক মোহাম্মদ আতাউল করিম হলেন বাংলাদেশের সূর্যসন্তান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এই বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত বিজ্ঞানীকে বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন বলে গণ্য করা হয়। বর্তমানে তিনি "ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস ডার্টমাউথ" - এর প্রোভোস্ট এবং এক্সিকিউটিভ ভাইস চ্যান্সেলর পদে কর্মরত।


জন্ম ও বংশ পরিচয়, Birth and Family Introduction 

মোহাম্মদ আতাউল করিম ১৯৫৩ সালের ৪ঠা মে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন। সিলেটের মৌলভীবাজারের অন্তর্গত বড়লেখা উপজেলার মিশন হাউজ়ে তাঁর জন্ম হয়। মোহাম্মদ আতাউলের বাবা মোহাম্মদ আবদুস শুকুর পেশায় একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং মা একজন গৃহিণী।

শিক্ষাজীবন, Education 

বাংলাদেশে মোহাম্মদ আতাউল করিমের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মৌলভীবাজার বড়লেখার স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর বড়লেখার হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন তিনি।

Read also :
Read also :

পরবর্তীতে তিনি ১৯৬৯ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন এবং ৪র্থ স্থান অধিকার করেন। ১৯৭২ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি।

পরে স্নাতক শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি  হন তিনি। মোহাম্মদ আতাউল করিম ১৯৭৬ সালে বি. এসসি. ডিগ্রি লাভ করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। স্নাতক অর্জনের পূর্বেই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হন ।

কাগজপত্র সহ সবকিছু তৈরি থাকা সত্বেও সেখানে আর যাওয়া হয়নি তাঁর। অনার্স পরীক্ষা শেষ করে ফলাফল আসার আগেই মোহাম্মদ আতাউল ইউনিভার্সিটি অব আলবামাতে ভর্তি হয়ে যান। সেখান থেকে ১৯৭৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে এবং  ১৯৭৯ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এম. এসসি. ডিগ্রি লাভ করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ।

কর্মজীবন, Career 

ইউনিভার্সিটি অব আলবামা থেকে পিএইচডি করার পর আতাউল করিম প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ইতি টানেন। শুরু করেন জীবনের নতুন এক অধ্যায়; নতুন নতুন গবেষণা, শিক্ষকতা, আর বই লেখার কাজে নিমগ্ন হন তিনি। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি আরকানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

এরপর ১৯৮৩ সালে তিনি উইচিটা স্টেট ইউনিভার্সিটির তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৮৬ সাল অবধি সেখানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ডেইটনে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন, ১৯৯৩ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন তিনি।

১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ইলেক্ট্রো-অপটিক্স প্রোগ্রামের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পাশাপাশি ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এখানে তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন ড. আতাউল করিম।

read also :
read also :

তিনি ১৯৯৮-২০০০ সাল অবধি টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপনা করেন, পরবর্তীতে ২০০০-২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপনার কাজ করেছিলেন।

অতঃপর ২০০৪-২০১৩ সাল অবধি ওল্ড ডোমিনিয়ন ইউনিভার্সিটির তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন ড. আতাউল করিম। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৯ বছর অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজে দায়িত্বও পালন করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস ডার্টমাউথে যোগদান করেছিলেন। 

বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত লেখা এবং বই রচনা, Literary contribution and publication 

মোহাম্মদ আতাউল করিম স্কুলে পড়াশুনা করার সময় থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে লেখা শুরু করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল অবধি 'বিজ্ঞান সাময়িকী' এবং 'বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান' পত্রিকায় তাঁর ত্রিশটিরও বেশি সংখ্যক লেখা প্রকাশিত হয়েছিল; সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা ছিল ‘বিবর্তন কাহিনী’ এবং ‘সাম্প্রতিক’।

‘বিবর্তন কাহিনী’-তে মহাজাগতিক ও জৈবিক বিবর্তন সম্পর্কে ধারাবাহিক আলোচনা করা হয়েছিল। অন্যদিকে, ‘সাম্প্রতিক’ লেখাটির মধ্যে বিজ্ঞানের সমসাময়িক বিষয়গুলোর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। তিনি বিজ্ঞান ভিত্তিক ১৮ টি বই রচনা করেছিলেন।

এছাড়াও বেশ কিছু বইয়ের পাঠ্যক্রম হিসেবে ৭টি ‘অধ্যায়’ লিখেছিলেন। তাঁর রচিত বইগুলোর মধ্যে Digital Design: A Pragmatic Approach (1987), Electro-Optical Devices and Systems (1990), Optical Computing: An Introduction (1992), Electro-Optical Displays (1992), Continuous Signals and Systems with Matlab (2001, 2009), and Digital Design: Basic Concepts and Principles (2008) ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করা হয়।

ব্যক্তিগত জীবন, Personal Life 

ড. আতাউল করিম ১৯৭৭ সালে তাঁর সহপাঠিনী সেতারা করিমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। স্ত্রী সেতারা পেশায় ছিলেন একজন জৈবরসায়নবিদ। পারিবার সহ এই দম্পতি ভার্জিনিয়া রাজ্যের ভার্জিনিয়া সমুদ্র সৈকতের নিকটে বসবাস করছেন। বৈবাহিক জীবনে তাঁদের এক ছেলে ও দুই কন্যা সন্তান বর্তমান। উক্ত দম্পতির পুত্রের নাম লুৎফি এবং কন্যাদের নাম লামিয়া ও আলিয়া।

বাংলাদেশে তাঁর অবদান, Contribution to Bangladesh

সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা সত্ত্বেও নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশের জন্যও কাজ করে যাচ্ছেন মোহাম্মদ আতাউল করিম। তিনি বাংলাদেশে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন কম্পিউটার এন্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ শীর্ষক সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ।

বর্তমানে উক্ত সম্মেলনটি দেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী সম্মেলন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তিনি বিভিন্ন জার্নালে নিজের লেখার মাধ্যমে বাংলাদেশের যোগাযোগ, মাল্টিমিডিয়া, কম্পিউটিং, নেটওয়ার্ক এবং সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেছিলেন ।

Also read :

তাঁর সম্পাদিত ‘টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জ এন্ড ডিজাইন ইস্যু ইন বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ শীর্ষকের বইটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বর্তমানেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। 

ম্যাগলেভ ট্রেন, Maglev train

ড. আতাউল করিম কর্মক্ষেত্রে ১৯৮৭ সাল থেকে বিভিন্ন রকম গবেষণা অবিরতভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানী মোহাম্মদ আতাউল করিমের মোট ৩২৭টি গবেষনাকর্ম রয়েছে ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ আকর্ষণ দ্রুততম ভাসমান ট্রেন চলাচল প্রযুক্তি বাস্তবায়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কিন্তু ম্যাগলেভ ট্রেনের গবেষণা সারা বিশ্বে তাঁকে সুপ্রসিদ্ধ করে তোলে। পদার্থবিজ্ঞানী আতাউল করিম ভার্জিনিয়ার নরফোকের ওল্ড ডোমিনিয়ন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করার সময়  ম্যাগলেভ ট্রেন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন।

ওল্ড ডোমিনিয়ন ইউনিভার্সিটির গবেষকগণ প্রায় ৭ বছর ধরে এ ধরনের একটি ট্রেন তৈরির চেষ্টা করেও সাফল্যের দেখা পাননি; পরে ২০০৪ সালে উক্ত গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্ব নেন ড. করিম। এরপর তিনি পরবর্তী দেড় বছরের মধ্যে ট্রেনটির প্রযুক্তি নির্মাণে সাফল্য পান এবং গবেষণায় পরীক্ষামূলকভাবে সক্ষমতা অর্জন করেন।
এছাড়াও ড. করিমের দুটি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট রয়েছে, সেগুলো হল:

● ফাইবার অপটিক কাপলিং সিস্টেম (১৯৮৯)

● ট্রাইনারি অ্যাসোসিয়েটিভ মেমোরি (১৯৯৩)

পুরস্কার ও সম্মাননা, Award and Honour

কর্মজীবনের বিভিন্ন কার্যকলাপের স্বীকৃতিস্বরূপ মোহাম্মদ আতাউল করিম বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, উল্লেখযোগ্য পুরস্কার:

● এনসিআর স্টেকহোল্ডার অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৯)
● নাসা টেক ব্রিফ অ্যাওয়ার্ড (১৯৯০)
● আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৪)
● আউটস্ট্যান্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৮)

এছাড়াও সম্মাননাস্বরূপ তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন তালিকায়:

● ২০০০ আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টস্ট অফ দি টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরী
● আমেরিকান ম্যান এ্যান্ড উইম্যানস ইন দি সায়েন্স

উপসংহার, Conclusion 

ড. আতাউল করিম শুধুমাত্র গবেষক নন, তিনি একজন ইন্সট্রাকটর বা নির্দেশকও। তিনি অপটিক্যাল সিস্টেম, অপটিক্যাল কম্পিউটিং তথা প্যাটার্ন রিকগনিশনের ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ ৫০ জন গবেষকের মাঝে অন্যতম একজন। ড. করিম বাংলাদেশের গর্ব, তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিশীলতা যুগে যুগে দেশের তথা বিদেশের বিজ্ঞানপ্রেমীদের প্রেরণা যোগাবে ।

প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions

মোহাম্মদ আতাউল করিম কে?

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন।

মোহাম্মদ আতাউল করিম কবে জন্মগ্রহণ করেন?

১৯৫৩ সালের ৪ঠা মে ।

মোহাম্মদ আতাউল করিম উল্লেখ্যযোগ্য আবিস্কার কোনটি?

ম্যাগলেভ ট্রেন।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File