স্বাধীনতা আন্দোলনের শহিদ, বিপ্লবী মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনী, Indian revolutionary Matangini Hazra's biography in bengali

Saturday, August 27 2022, 5:38 am
highlightKey Highlights

মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন মহান বিপ্লবী নেত্রী। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী এবং একজন গান্ধীবাদী নেত্রী। তিনি নিজের গ্রামের মানুষ তথা সমসাময়িক বিপ্লবীদের মধ্যে 'গান্ধীবুড়ি' নামে পরিচিত ছিলেন।


প্রাথমিক জীবন, জন্ম, শিক্ষা ও ব্যক্তিগত জীবন বৃত্তান্ত, Early life, birth and personal life

বিপ্লবী মাতঙ্গিনী হাজরার প্রাথমিক জীবন নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে শুধু এতটুকুই জানা গেছে যে, ১৮৬৯ সালের ১৭ই নভেম্বর তমলুকের অদূরে হোগলা নামক একটি ছোট গ্রামে,  একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

Trending Updates

দারিদ্রের কারণে মাতঙ্গিনী হাজরা বাল্যকালে প্রথাগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে যান এবং  অতি অল্প বয়সকালেই তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর স্বামীর নাম ছিল ত্রিলোচন হাজরা। বিবাহের কিছুকাল পর মাত্র আঠারো বছর বয়সেই তিনি নিঃসন্তান অবস্থাতেই বিধবা হয়েছিলেন। বিপ্লবী নেত্রী মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম থেকে শুরু করে বৈবাহিক জীবন সহ কর্ম এবং মৃত্যু সবকিছুই তমলুক-কেন্দ্রিক।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ, Participation in Indian Independence movement

ব্রিটিশ শাসন কালে ভারতবর্ষের মেদিনীপুর জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নারীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করা এক উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল। ১৯০৫ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। মতাদর্শগত দিক দিয়ে তিনি ছিলেন একজন গান্ধীবাদী। ১৯৩২ সালে তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। সে সময় মাতঙ্গিনী লবণ আইন অমান্য করার জন্য কারাবরণ করেছিলেন।

Also read :

স্বল্প সময়ের জন্য বন্দী রেখে কিছু কাল পরেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে চৌকিদারি কর মকুব করার দাবিতে তিনি প্রতিবাদ চালিয়ে যান, ফলে আবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। এই সময় মাতঙ্গিনী বহরমপুর স্থিত কারাগারে ছয়-মাস বন্দি ছিলেন। তিনি কিছু সময়ের জন্য হিজলি বন্দি নিবাসেও বন্দি ছিলেন।

মুক্তিলাভ করার পর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্যপদ লাভ করেন তিনি এবং নিজের হাতেই চরকা কেটে কেটে খাদি কাপড় বানানোর কাজ শুরু করেন। ১৯৩৩ সালে মাতঙ্গিনী হাজরা শ্রীরামপুরে এক মহকুমা কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান করেন এবং সেখানে পুলিশের লাঠিচার্জ হওয়ার সময় তিনি আহত হয়ে পড়েছিলেন।

সে বছরই ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন অ্যাণ্ডারসন তমলুক অঞ্চল পরিদর্শন করতে আসেন, তখন মাতঙ্গিনী হাজরা জনস্রোতের সামনে সমস্ত নিরাপত্তা রক্ষীদের এড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে গভর্নরকে কালো পতাকা প্রদর্শন করেন।

সমাজ সেবা মূলক কাজ, Social welfare activities 

বিপ্লবী মাতঙ্গিনী হাজরা সর্বদাই মানবতাবাদী উদ্দেশ্য সাধনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। স্বামীর মৃত্যু ঘটার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে একরকম পরিত্যাজ্য হয়েই তিনি বাড়ি ছেড়ে মাঠের ধারে এক কুঁড়ে বানিয়ে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই বাস করতে শুরু করেন।

ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন ধরনের সমাজ সেবামূলক কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। মাতঙ্গিনী হাজরা যেখানে বসবাস করতেন সে অঞ্চলে যখন মহামারী আকারে বসন্ত-রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, তখন তিনিই আক্রান্ত পুরুষ, নারী ও শিশুদের সকলকে সেবা করেছিলেন।

১৯৩০-এর দশকে কারাবাস এবং পুলিশের লাঠিচার্জের আঘাতের কারণে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। কিন্তু পরবর্তীতে জেল থেকে মুক্তির পর তিনি ফের সমাজের সেবায় নিয়োজিত হন, বিশেষ করে অস্পৃশ্যদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ, Participation in Quit India Movement 

ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালীন সময় কংগ্রেস সদস্যরা মেদিনীপুর জেলার সবগুলো থানা এবং অন্যান্য সকল সরকারি কার্যালয় দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন। এই পরিকল্পনাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল উক্ত জেলা থেকে ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদ করে দিয়ে সেখানে এক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। প্রধানত মহিলা স্বেচ্ছাসেবক সহকারে প্রায় ছয় হাজার সমর্থক তমলুক থানা এলাকা দখলের উদ্দেশ্য নিয়ে একটি মিছিল বের করেছিল, তখন এই মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৭৩ বছর বয়সী মাতঙ্গিনী হাজরা।

Also read :

সেই মিছিল শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছালে ব্রিটিশ রাজপুলিশ তখন ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারা জারি করে দিয়ে সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু হাজার হাজার জনতার কন্ঠে "ইংরেজ ভারত ছাড়ো" শ্লোগানের সাথে নিরস্ত্র মিছিলটি মাতঙ্গিনী হাজরার নেতৃত্বে সেই আদেশ অমান্য করে অগ্রসর হতে থাকায় পুলিশ তাদের গুলি করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাতঙ্গিনী এগিয়ে যান এবং পুলিশের কাছে জনতার ওপর গুলি না-চালানর জন্য আবেদন করেন।

তৎকালীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের মুখপাত্র বিপ্লবী পত্রিকার বিবরণ অনুসারে, ফৌজদারি আদালত ভবনের উত্তর দিক হতে মাতঙ্গিনী হাজরা একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তখন পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করলে, তিনি অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের পিছনে ফেলে রেখে নিজে একাই এগিয়ে যান। ব্রিটিশ পুলিশ তিনবার তাঁকে গুলি করেছিল। প্রথমে এক হাতে গুলি লাগলে, অন্য হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন।

বন্দুকের তিন গুলির মধ্যে একটি গুলি লাগে তাঁর কপালে ও অন্য দুটি লেগেছিল দুই হাতে। তবুও তিনি থেমে থাকেন নি বরং এগিয়ে যেতে থাকেন। এরপরেও বার বার তাঁর ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। তখন একটি গুলি লাগে তাঁর বুকে। অবশেষে  মাতঙ্গিনী হাজরা কংগ্রেসের পতাকাটিকে মুঠোর মধ্যে শক্ত করে উঁচিয়ে ধরে রেখে 'বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দিতে দিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তিনি বন্দেমাতরম ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং জাতীয় পতাকার মর্যাদাও রক্ষা করেছিলেন।

মাতঙ্গিনী হাজরা র স্মরণে, In memory of Matangini Hazra    

তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার মাতঙ্গিনী হাজরার মৃত্যুবরণের দৃষ্টান্তটিকে সামনে রেখে স্বদেশের জন্য মানুষকে বিপ্লবের পথে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। উল্লেখ্য, এই সমান্তরাল সরকারটি ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সফলভাবেই নিজের অস্তিত্বকে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। পরে গান্ধীজির অনুরোধ মেনে এই সরকার ভেঙে দেওয়া হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করার পর অসংখ্য স্কুল, পাড়া এবং রাস্তার নাম মাতঙ্গিনী হাজরার নামে উৎসর্গ করে দেওয়া হয়। কলকাতায় দীর্ঘ বিস্তৃত হাজরা রোডটি তাঁর নামেই নামাঙ্কিত করা হয়েছিল। ভারত স্বাধীন হবার পর কলকাতা শহরে প্রথমবার যে নারীমূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল, তা ছিল এই বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরারই মূর্তি।

১৯৭৭ সালে কলকাতার ময়দানে এই মূর্তি স্থাপন করা হয়। তাছাড়াও তমলুকে ঠিক যে স্থানে মাতঙ্গিনী হাজরার গুলিবিদ্ধ দেহ লুটিয়ে পড়েছিল সেই জায়গাটিতেও তাঁর একটি মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছিল।

২০০২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠিত হওয়ার ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ভারতীয় ডাকবিভাগ থেকে মাতঙ্গিনী হাজরার ছবি দেওয়া পাঁচ টাকার একটি ডাকটিকিট চালু করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তমলুক শহরে মহিলাদের উদেশ্যে শহীদ মাতঙ্গিনী গভর্নমেন্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ।

উপসংহার, Conclusion

Also read :

১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তদানীন্তন মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত তমলুক থানার সামনে ব্রিটিশ পুলিশদের গুলিতে বিপ্লবী নেত্রী মাতঙ্গিনী হাজরা শহীদ হন। ৭৩ বছর বয়স্ক মাতঙ্গিনী হাজরার বীরোচিত আত্মত্যাগ শুধুমাত্র বাংলা প্রদেশই নয় বরং সমগ্র ভারতবর্ষেই ভারতছাড়ো আন্দোলনের তীব্রতাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিয়েছিল। তাঁর অকুতোভয় সাহস এবং অসামান্য দেশপ্রেম এই বাংলার তথা সারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions

১) মাতঙ্গিনী হাজরা কে?

স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন মহান বিপ্লবী নেত্রী।

মাতঙ্গিনী হাজরা কবে জন্মগ্রহন করেন?

১৮৬৯ সালের ১৭ই নভেম্বর।

মাতঙ্গিনী হাজরার মতাদর্শ কি?

তিনি ছিলেন গান্ধীবাদী।

মাতঙ্গিনী হাজরা কীভাবে শহীদ হন?

তমলুক থানার সামনে ব্রিটিশ পুলিশদের গুলিতে তিনি শহিদ হন।

মাতঙ্গিনী হাজরা কবে শহীদ হন?

১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File