Netaji Subhash Chandra Bose | 'অশ্বারোহী'-'আজাদ হিন্দ ফৌজ'-'মৃত্যু রহস্য' ছাড়াও সুভাষ চন্দ্র বসু আরও বহু কিছু! জানুন নেতাজি সম্পর্কে অজানা তথ্য!

Tuesday, January 23 2024, 3:52 pm
highlightKey Highlights

আই.সি.এস-তে চতুর্থ হয়েও মত বদল করেছিলেন তিনি। ২০ বছরে ১১বার হয়েছিলেন গ্রেফতার। জার্মানিতে পৌঁছানোর জন্য একাধিক ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন, তিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।


২৩শে জানুয়ারি, নেতাজির জন্মদিন (23rd january netaji birthday) কেবল বাঙালিদের জন্যই নয়, গোটা ভারতের জন্যই এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা তিনি। কংগ্রেস দলের বামপন্থী নেতা, ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতিষ্ঠাতা ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সর্বাধিনায়ক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। কারুর কাছে তিনি এক জন যথার্থ দেশনায়ক না, ‘সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিক রাজনীতির শিকার’ এক জন বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী। আবার কারুর কাছে তিনিই 'অমর শ্রেষ্ঠ নেতা'। ২০২১ সালে ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Prime Minister Narendra Modi ) ২৩শে জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিন (23rd january netaji birthday) এর দিনকে জাতীয় পরাক্রম দিবস বলে ঘোষণা করেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু জয়ন্তী (Netaji Subhash Chandra Bose Jayanti) উপলক্ষ্যে দেশজুড়ে নানান সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজিত করা হয়। শ্রদ্ধা জানানো হয় নেতাজিকে।

 ২০২১ সালে ২৩শে জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনের দিনকে জাতীয় পরাক্রম দিবস বলে ঘোষণা করা হয়
 ২০২১ সালে ২৩শে জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনের দিনকে জাতীয় পরাক্রম দিবস বলে ঘোষণা করা হয়

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী ও অজানা তথ্য :

Trending Updates

'গান্ধীজি না নেতাজি' এই বিতর্কে আমরা বেশিরভাগ মানুষই এগিয়ে দি নেতাজিকে। ভারতের স্বাধীনতার নেপথ্যে যে সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান অপরিহার্য তা নতুন করে কাউকে বলে দিতে হয়না। 'ভারতের নোটে নেতাজির ছবি ছাপানো হোক', 'নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু জয়ন্তী (Netaji Subhash Chandra Bose Jayanti)'কে জাতীয় ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হোক' বলতে থাকা আমরা 'সাধারণ ব্যক্তি'রা কতটাই বা চিনি আমাদের প্রিয় নেতাকে? আমরা অনেকেই জানিনা যে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হিসাবে প্রশাসক সুভাষচন্দ্র একাধিক ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কলকাতা কর্পোরেশনে জনসংখ্যার অনুপাতেরও একটু বেশি সংখ্যক মুসলিমকে চাকরি দেওয়ার মাধ্যমে সম্প্রদায়-অসাম্য দূর করার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছিলেন তিনি। এ নিয়ে শিক্ষিত বর্ণহিন্দু বাঙালিদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হলে সুভাষ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছিলেন, 'অতীতে হিন্দুরা এই সমস্ত চাকরিতে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে রেখেছিল, তাই আজ তাদের গাত্রদাহ হলেও কিছু করার নেই।' আমরা অনেকেই জানিনা যে, ১৯৪২ সালে লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের যে প্রধান তিন জন অফিসারের বিচার হয়েছিল, তাঁদের নাম ছিল যথাক্রমে প্রেমকুমার সহগল, শাহ নওয়াজ় খান এবং গুরুবক্স সিং ধিলোঁ। অর্থাৎ নেতাজির তিন প্রধান সেনাপতি ধর্মপরিচয়ে ছিলেন হিন্দু, মুসলমান এবং শিখ। আমরা অনেকেই জানিনা যে,ভারতের ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির প্রথম সভাপতি ছিলেন জওহরলাল নেহরু, কিন্তু ওই পদটির জন্য নেহরুর নামটি সুপারিশ করেছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। 'দি এসেনশিয়াল রাইটিংস অব সুভাষচন্দ্র বোস' (The Essential Writings of Subhash Chandra Bose) নামে মোট বারো খণ্ডে সুভাষচন্দ্রের যাবতীয় লেখালিখি প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে নেতাজি সম্পর্কে নানান তথ্য, তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা- দর্শন বিধৃত রয়েছে।

আই.সি.এস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান :

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৮৯৭ সালের ২৩সে জানুয়ারি বঙ্গ বিভাগের উড়িষার কটকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মাতা প্রভাবতী বসু (দত্ত) ছিলেন উত্তর কলকাতার হাটখোলা দত্ত বাড়ির কন্যা এবং পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন সরকারি আইনজীবী।  সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন তার পিতা-মাতার চৌদ্দ সন্তানের নবম সন্তান তথা ষষ্ঠ পুত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজে উচ্চশিক্ষা শুরু করলেও জনৈক ইউরোপীয় শিক্ষকের সঙ্গে কথিত অসদাচরণের জন্য তাঁকে ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর সুভাষ চন্দ্র বসু কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ডিস্টিংকশনসহ দর্শনশাস্ত্রে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর আই.সি.এস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য তিনি ১৯১৯ সালে ইংল্যান্ড যান এবং সাফল্যের সাথে কাঙ্ক্ষিত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছিলেন এবং মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থানে এসেছিলেন। কিন্তু অনতিবিলম্বে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সিভিল সার্ভিস থেকে ইস্তফা দিয়ে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যোগ দেন।

সিভিল সার্ভিস থেকে ইস্তফা দিয়ে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যোগ দেন নেতাজি
সিভিল সার্ভিস থেকে ইস্তফা দিয়ে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যোগ দেন নেতাজি

সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্পাদক :

১৯২১ সালের ১৬ ই  জুলাই, ২৪ বছর বয়সী সুভাষচন্দ্র বসু, ইংল্যান্ড থেকে ফিরে ভারতের বোম্বেতে পাড়ি দেন এবং অবিলম্বে গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের আয়োজন করেন। গান্ধী এবং বসু প্রথম সাক্ষাতেই আন্দোলনের উপায় সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন। ১৯২৩ সালে সুভাষচন্দ্র সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি এবং একইসাথে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন।

 কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হিসাবে সুভাষচন্দ্র :

১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাস কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বসু কলকাতা পৌরসংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। ১৯২৫ সালে সুভাষচন্দ্র বসুকে গ্রেফতার করে মান্দালয়ের কারাগারে পাঠানো হয়, যেখানে তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। ১৯২৭ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সুভাষ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হন এবং জওহরলাল নেহেরু সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। এর কিছুদিন পরে, সুভাষচন্দ্র বসুকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং আইনঅমান্য আন্দোলনের জন্য জেলে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, কলকাতা কর্পোরেশনে জনসংখ্যার অনুুপাতেরও একটু বেশি সংখ্যক মুসলিমকে চাকরি দেওয়ার মাধ্যমে সম্প্রদায়-অসাম্য দূর করার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছিলেন নেতাজি। এ নিয়ে শিক্ষিত বর্ণহিন্দু বাঙালিদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হলে সুভাষ বলেন, সংখ্যালঘু মুসলিম, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদেরই এই বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া এখন কর্তব্য।

১৯৩০ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু  কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন
১৯৩০ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন

লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নেতাজি ও ২০ বছরে ১১বার গ্রেফতার :

১৯৩০ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং এর জন্য তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি ১৯৩১-এর গান্ধী-আরউইন চুক্তির বিরোধিতা করেন। ১৮১৮ সালের কুখ্যাত ১১১ প্রবিধানের  আওতায় তিনি তৃতীয়বারের মতো গ্রেফতার হন। কারাগারে তাঁর স্বাস্থ্যের এমন অবনতি ঘটে যে স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি মুক্তি লাভ পান। অন্যদিকে, লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন বন্ধ করলে সুভাষ চন্দ্র বসু ও বীঠলভাই প্যাটেল ইউরোপ থেকে সুভাষচন্দ্র -প্যাটেল ইস্তাহার দেন। বল্লভভাই প্যাটেল তার সম্পত্তির চার ভাগের তিন ভাগ নেতাজিকে দান করেন। তবে পরবর্তীতে তাঁর ছোটো ভাই বল্লভভাই প্যাটেল তা অস্বীকার করে এবং তাঁকে জালিয়াত-সহ নানা খারাপ আখ্যা দেন। কুড়ি বছরের মধ্যে সুভাষচন্দ্র মোট ১১ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁকে ভারত ও রেঙ্গুনের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ইউরোপে নির্বাসিত করা হয়।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন  
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন  

ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা :

১৯৩৮ সালে সুভাষ সর্বসম্মতিক্রমে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের বছর তিনি ওই একই পদে পুনঃনির্বাচিত হন। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তাঁর 'জঙ্গি' অবস্থানের কারণে অচিরেই তাঁকে কংগ্রেসের মূল নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। স্বয়ং গান্ধী তাঁর বিরুদ্ধে চলে যান। এ পরিস্থিতিতে ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে তিনি কংগ্রেস সভাপতি পদে ইস্তফা দেন। তবে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার ও জোরদার করার জন্য তিনি ওই বছরই কংগ্রেসের ভেতরে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করে সাধারণভাবে সারা ভারতে এবং বিশেষ করে বাংলায় বিপ্লবী শক্তিগুলিকে সুসংহত করতে প্রয়াসী হন।

নেতাজি “ফরোয়ার্ড” পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চাকরি লেখার ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে তাকে প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে পরে তিনি “স্বরাজ” নামে একটি নিজস্ব পত্রিকা খুলতে সক্ষম হন। 'অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লক'টি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসু এবং চিত্ত বসু স্বাধীন ভারতে এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে এটির মূল দুর্গ ছিল। তিনি তার নতুন রাজনৈতিক প্রকল্পের সমর্থন করে, সারা দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। নাগপুরে তাঁরা তাদের প্রথম সর্বভারতীয় ব্লক সভা আয়োজন করেন। ১৯৪২ সালের আগস্টে ব্রিটিশরা অল ইন্ডিয়া ব্লক নিষিদ্ধ করে। ভারতের অভ্যন্তরে, ফরোয়ার্ড ব্লকের স্থানীয় কর্মীরা ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যান।

'অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লক'টি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
'অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লক'টি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন

সুভাষচন্দ্রের বিবাহ :

নেতাজির বিয়ে হয়েছিল অস্ট্রিয়ার এক সুন্দরী মহিলা এমিলি শিনকেনের সাথে। তাদের মেয়ের নাম অনিতা বসু যিনি জার্মানিতে জনপ্রিয় অর্থনীতিবিদ। জার্মানিতে তাঁর সময়ে, স্পষ্টতই নেতাজিকে ভারত স্টিলিংগার্ডে আত্মসমর্পণের পরেই ভারত ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ১৮৪৩ সালে নেতাজি জার্মানিতে তাঁর স্ত্রী এবং একমাত্র সন্তানকে রেখে এক সাবমেরিনে উঠেছিলেন বলে জানা যায়।

অস্ট্রিয়ার এক সুন্দরী মহিলা এমিলি শিনকেনকে বিয়ে করেন নেতাজি এবং তাদের কন্যা সন্তান হয় 
অস্ট্রিয়ার এক সুন্দরী মহিলা এমিলি শিনকেনকে বিয়ে করেন নেতাজি এবং তাদের কন্যা সন্তান হয় 

 ছদ্মবেশে জার্মানিতে নেতাজি :

১৯৪১ সালে সুভাষচন্দ্র বসুকে গৃহবন্দী করা হয়। এসময় সিআইডি তাঁর বাড়ি নজরদারিতে রাখে। তবুও তিনি আফগানিস্তান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানিতে পালাতে সক্ষম হন তিনি। পালানোর কয়েকদিন আগে, তিনি নিঃসঙ্গ থাকার অজুহাতে ব্রিটিশ রক্ষীদের সাথে দেখা করা এড়িয়ে চলেন এবং লম্বা দাড়ি রাখেন। ১৯৪১ সালের ১৬ই জানুয়ারি, গভীর রাতে পালানোর সময়, তিনি পাঠানদের বেশভূষা ধারণ করেন। ১৯৪১ সালের ১৭ই জানুয়ারি রাতে কলকাতায় তাঁর এলগিন রোডের বাড়ি থেকে ব্রিটিশদের নজরদারি এড়িয়ে, তাঁর ভাগ্নে শিশির কুমার বসুকে সঙ্গে নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু পালাতে সক্ষম হন। পালিয়ে তৎকালীন বিহার রাজ্যের গোমোহ্‌ রেলওয়ে স্টেশনে পৌছান। সেখান থেকে তিনি তৎকালীন জার্মান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আবওয়ের সাহায্যে পেশোয়ার পৌঁছান। সেখানে তিনি আকবর শাহ, মোহাম্মদ শাহ এবং ভগত রাম তলওয়ারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁকে আকবর শাহের বিশ্বস্ত বন্ধু আবাদ খানের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ১৯৪১ সালের ২৬সে জানুয়ারি তিনি আফগানিস্তান সংলগ্ন ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে রাশিয়া পৌছানোর জন্য যাত্রা শুরু করেন। এর জন্য তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের তৎকালীন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মিঞা আকবর শাহ এর সাহায্য গ্রহণ করেন। শাহ নেতাজিকে একটি অভিনব ছদ্মবেশ ধারণের প্রস্তাব দেন। যেহেতু বসু পশতু ভাষার একটি শব্দও জানতেন না, ব্রিটিশদের জন্য কর্মরত পশতু বক্তাদের পক্ষে তাকে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব ছিল। এজন্য শাহ তাঁকে বধির এবং বোবা হওয়ার অভিনয় করার পরামর্শ দেন এবং সেখানকার উপজাতিদের অনুকরণে তার দাড়ি বৃদ্ধি করতে বলেন।

সুলতান মুহাম্মদ শাহ আগা খান এর সমর্থকরা তাঁকে সীমান্ত পেরিয়ে আফগানিস্তানে যেতে সাহায্য করে, যেখানে আবওয়ের এর একটি ইউনিট তার সাথে দেখা করে ও কাবুল হয়ে আফগানিস্তান পেরিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সীমান্তে পৌঁছাতে তাকে সাহায্য করে। একজন পশতুন বীমা এজেন্ট “জিয়াউদ্দিন” সেজে আফগানিস্তানে পৌছানোর পর, তিনি তার ছদ্মবেশ পরিবর্তন করে একজন ইতালীয় অভিজাত ব্যক্তি, “কাউন্ট অরল্যান্ডো মাজোত্তা” সেজে ইতালীয় পাসপোর্টে মস্কো পৌঁছান। মস্কো থেকে তিনি রোমে পৌছান, এবং সেখান থেকে জার্মানিতে পাড়ি দেন। রাশিয়ায় পৌছানোর পর, সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা, এনকেভিডি, তাকে মস্কোতে নিয়ে যায়। তবে তাঁকে দ্রুত মস্কোতে উপস্থিত জার্মান রাষ্ট্রদূত কাউন্ট ফন ডার শুলেনবার্গের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি এপ্রিলের শুরুতে, একটি বিশেষ কুরিয়ার বিমানে করে সুভাষচন্দ্র বসুর বার্লিনে পৌছানোর ব্যবস্থা করেন। তিনি বার্লিনে ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে সৈন্য নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করেন।

হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাৎ :

 জার্মানিতে পৌঁছানোর পর, তিনি জার্মান পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত আজাদ হিন্দ রেডিওর সম্প্রচারের দায়িত্বে থাকা ভারতের স্পেশাল ব্যুরোর সঙ্গে যুক্ত হন। নেতাজি হিটলারের অফিসের বাইরে পৌঁছলে তাঁকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরে, হিটলার অফিসের বাইরে এসেছিলেন কিন্তু নেতাজির সাথে দেখা হয় নি। অবশেষে, হিটলার নেতাজির কাছে গিয়ে নেতাজির কাঁধে হাত রেখেছিলেন। তিনি খবরের কাগজ পড়তে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে তিনি আর তাকান নি। কয়েক মিনিট পরে, তিনি বললেন “হিটলার”। হিটলার ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন “আপনি কীভাবে এতটা নিশ্চিত হন যে আমি হিটলার?”। এতে নেতাজি জবাব দিয়েছিলেন “কেবলমাত্র হিটলার আমার কাঁধে হাত রাখার সাহস করতে পারে”।

একাধিকবার ছদ্মবেশ ধারণ করে অবশেষে জার্মানি পৌঁছে হিটলারের সঙ্গে দেখা করেন নেতাজি 
একাধিকবার ছদ্মবেশ ধারণ করে অবশেষে জার্মানি পৌঁছে হিটলারের সঙ্গে দেখা করেন নেতাজি 

আজাদ হিন্দ ফৌজ :

জার্মানি ও জাপান সরকারের সমর্থন লাভ করে সুভাষ সিঙ্গাপুর অভিমুখে জলপথে একটি সাবমেরিনে তাঁর যাত্রা শুরু করেন এবং ১৯৪৩ সালের ২ জুলাই সেখানে পৌঁছেন। জাপানিদের হাতে ভারতীয় যুদ্ধবন্দিরা সিঙ্গাপুরে তাঁর উপস্থিতিতে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রকাশ করে। ইতিমধ্যে জাপানে অবস্থানরত অন্যতম ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠিত করেন। রাসবিহারী বসু আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্বভার সুভাষ বসুকে অর্পণ করেন। ১৯৪৩ সালের ২৫ আগস্ট সুভাষ আই.এন.এ-র (INA) সর্বাধিনায়ক হন এবং ঐ একই বছর ২১ অক্টোবর অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করেন। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি রেঙ্গুনে আইএনএ-র সদরদপ্তর স্থানান্তর করেন। সব মিলিয়ে ৩০০০ ভারতীয় যুদ্ধবন্দী আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগদান করেন।  নেতাজিই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একমাত্র সশস্ত্র বাহিনী আজাদ হিন্দ ফৌজকে নেতৃত্ব দেন। এর কারণে তাঁকে ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর উপাধি দেওয়া হয়। সম্মান হিসাবে তাঁর অনুসারীরা তাকে জনপ্রিয় ও স্নেহস্বরূপ “নেতাজি” হিসাবে ডাকা শুরু করেন।

তিনি রেঙ্গুন থেকে ভারত-বার্মা সীমান্তে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করেন এবং ভারতের দিকে অগ্রসর হন। ১৯৪৪-এর মার্চ মাসে তিনি তাঁর এ অগ্রাভিযানে ইম্ফল ও কোহিমায় দুটি ব্রিটিশ সামরিক চৌকি দখল করেন ও সেখানে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন।

 নেতাজির মৃত্যু রহস্য :

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যু আজও রহস্য। অনেকে মনে করেন ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে ফরমোজায় এক বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ নিহত হন। সেই ঘটনায় নাকি কোনও দেহ উদ্ধার করা যায়নি, কেবল কয়েকটি ছাই জাপানে নেওয়া হয়েছিল। আবার অনেকের মতে, এই দুর্ঘটনায় প্রাণ যায়নি নেতাজির। তিনি সন্ন্যাস নিয়েছিলেন এবং ভগবানজি বা গুমনামি বাবার নামে ইউ.পি.তে বাস করছিলেন এবং ১৯৮৫ সালে তিনি ফয়জাবাদে মারা গিয়েছিলেন। বলা হয় যে ভগবানজি নেতাজির মতোই দেখতে ছিলেন এবং তাঁর লেখার সাথে নেতাজির লেখাও মিলেছিল। চারটি পৃথক অনুষ্ঠানে তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে তিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। কিন্তু তিনি বেনামে থাকাই জাতির পক্ষে সবচেয়ে ভাল। এদিকে কথিত বিমান দুর্ঘটনা তাইওয়ানীয় রেকর্ডেও নেই। ফলে নেতাজির মৃত্যু আজও বড় রহস্য।

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর শেষ ছবি 
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর শেষ ছবি 

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর স্লোগান ও বক্তৃতা :

সুভাষ চন্দ্র বসু বক্তৃতা (Subhash Chandra Bose speech) ও সুভাষ চন্দ্র বসুর স্লোগান (Subhash Chandra Bose slogan) আজও ভারতীয়দের মনে শক্তি জোগায়। নেতাজির দুঃসাহসিক জীবন প্রত্যেক যুবকের জন্য অনুপ্রেরণা। 'তোমরা আমাকে রক্ত ​​দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। সুভাষ চন্দ্র বসু স্লোগান (Subhash Chandra Bose slogan) দিয়ে সে সময়ে প্রতিটি ভারতীয়ের রক্তে উদ্দীপনা ও শক্তিতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। এরকমই সুভাষ চন্দ্র বসু বক্তৃতা (Subhash Chandra Bose speech) ও স্লোগান নিচে উল্লেখ করা হলো-

  • মনে রাখবেন, সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে অন্যায়কে সহ্য করা এবং অন্যায়ের সাথে আপস করা।
  • উচ্চ চিন্তা দ্বারা দুর্বলতা দূর হয়। আমাদের সর্বদা উচ্চ চিন্তা তৈরি করা উচিত।
  • যার 'পরমানন্দ' নেই সে কখনো মহান হতে পারে না।
  • জীবনে সংগ্রাম না থাকলে, ভয় না পেলে জীবনের অর্ধেক স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।
  • সর্বদা কিছু আশার রশ্মি থাকে, যা আমাদের জীবন থেকে বিচ্যুত হতে দেয় না।
  • যদি কখনও মাথা নত করতে হয়, বীরের মতো মাথা নত করো।
  • সাফল্য সবসময় ব্যর্থতার স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তাই ব্যর্থতাকে কেউ ভয় পাবেন না।
  • যারা ফুল দেখে উত্তেজিত হন, তারা কাঁটা দ্রুত অনুভব করে।
'যদি কখনও মাথা নত করতে হয়, বীরের মতো মাথা নত করো' - নেতাজির বাণী 
'যদি কখনও মাথা নত করতে হয়, বীরের মতো মাথা নত করো' - নেতাজির বাণী 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে ‘দেশনায়ক’ আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি নেতাজিকে উৎসর্গ করেন।

স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।

তাসের দেশ উৎসর্গপত্রে নেতাজির উদ্দেশ্যে রবীন্দরনাথ ঠাকুরের লেখা
নেতাজির দুঃসাহসিক জীবন প্রত্যেক যুবকের জন্য অনুপ্রেরণা 
নেতাজির দুঃসাহসিক জীবন প্রত্যেক যুবকের জন্য অনুপ্রেরণা 

স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তার নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামে কলকাতায় স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং দিল্লিতে স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। কলকাতা মেট্রোর দুটি স্টেশন বর্তমানে নেতাজির নামাঙ্কিত: ‘নেতাজি ভবন’ (পূর্বনাম ভবানীপুর) ও ‘নেতাজি’ (পূর্বনাম কুঁদঘাট)।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File