Nelson Mandela Day | খেলাধুলো বর্ণবাদ কমাতে পারে বলে বিশ্বাস করতেন ম্যান্ডেলা! জানুন ম্যান্ডেলার সম্পর্কে অজানা তথ্য!
নেলসন ম্যান্ডেলা কেবল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না। বিশ্বকে বদলে দেওয়ার জন্য বিশাল স্বপ্নের একজন মানুষ ছিলেন তিনি। ফলে প্রতি বছর ১৮ই জুলাই বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় 'নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস'।
কেবল বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেই নয়, বিশ্বে শান্তি সম্প্রচার করেও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে নাম লিখেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা (Nelson Mandela)। এক কারাগার থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা (South Africa) আর সেই দেশ থেকে বিশ্বের কোণায় কোণায় চিরস্মরণীয় ম্যান্ডেলা। সেই কিংবদন্তিকে সম্মান জানাতে তাঁরই জন্মদিনের দিন বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় 'নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস' (Nelson Mandela Day)।
অ্যাক্টিভিস্ট, রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, মানবতাবাদী এই নেতা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে বহুবর্ণভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের দেশ হিসেবে। আজ গোটা বিশ্বের প্রতি অংশে তাঁর নাম ডাক থাকলেও, ম্যান্ডেলার জীবন সংগ্রাম বাস্তবে ছিল বহু কঠিন।
নেলসন ম্যান্ডেলার জীবন সংগ্রাম । Nelson Mandela's Life Struggle :
১৯১৮ সালের ১৮ই জুলাই নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম। তবে জন্ম থেকেই কিন্তু তাঁর নাম নেলসন ছিল না। ম্যান্ডেলার বাবা তাকে নাম দিয়েছিলেন রোলিহ্লাহলা ডালিভুঙ্গা ম্যানডেলা। পরবর্তীকালে স্কুলের এক শিক্ষক তাঁর ইংরেজি নাম রাখলেন নেলসন। তৎকালীন সময়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের নিপীড়ন ছিল বর্ণনাতীত। দেশটির জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ কৃষ্ণাঙ্গ হলেও, সব সুবিধা ভোগ করতেন শ্বেতাঙ্গরা। সেই অসাম্য, অনৈতিক অত্যাচার ও নিপীড়নই নেলসন ম্যান্ডেলাকে প্রতিবাদী মনস্ক করে তোলে। যার ফলে বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে আইনজীবী হয়ে ওঠেন ম্যান্ডেলা।
এরপর ১৯৪২ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (African National Congress) যোগ দেন নেলসন। প্রত্যক্ষ সরকার বিরোধিতায় রাজনীতির ময়দানে ঝাঁপিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধিতা বা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন তিনি। তবে ১৯৬০ সালে শার্পভিলে (Sharpeville) কৃষ্ণাঙ্গ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি বর্ষণ করে পুলিশ। ঘটনায় মৃত্যু হয় ৬৯ জনের। এরপরে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এএনসি (ANC) সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কারারুদ্ধ হন নেলসন ম্যান্ডেলা সহ অসংখ্য অনুগামীদের।
তবে ম্যান্ডেলা কারারুদ্ধ হলেও সেখানে বর্ণবাদবিরোধী লড়াই অব্যাহত থাকে। তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বাড়তে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের ওপর চাপও। অবশেষে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাবাসের পর মুক্তি পান নেলসন ম্যান্ডেলা। সেই সময়ে কারারুদ্ধ থাকার সময় ম্যান্ডেলা লিখেছেন আত্মজীবনী ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ (Long Walk to Freedom)।১৯৯৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে (Nobel Peace Prize) সম্মানিত হন নেলসন ম্যান্ডেলা। এরপরের বছরই অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে গণতান্ত্রিক ভোটে নির্বাচিত হয়ে হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট পদে বসেন নেলসন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। যদিও পরে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান ম্যান্ডেলা। তবে অবসরের পরেও থামেনি তাঁর কাজ।
নেলসন ম্যান্ডেলা দিবসের ইতিহাস । History of Nelson Mandela Day :
দক্ষিণ আফ্রিকার (South Africa) আপামর মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘মাদিবা’। অর্থাৎ জাতির স্থপতি। স্বাধীনতা এবং বিশ্ব শান্তির এক আইকন বা প্রতীকে পরিণত হয়েছেন ম্যান্ডেলা। যার ফলে ২০০৯ সালের নভেম্বরে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সমাজে শান্তি ও স্বাধীনতার সংস্কৃতিতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ১৮ই জুলাইকে 'নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস' হিসাবে ঘোষণা করে। বর্ণবাদ বিরোধী নেতার কৃতিত্বকে সম্মান জানাতে ম্যান্ডেলার ৯২ তম জন্মদিনে, ১৮ই জুলাই, ২০১০ সালে প্রথম এই দিবস পালিত হয়েছিল। ম্যান্ডেলা দিবসের প্রথম উদযাপন উপলক্ষে, তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠান, শিল্প প্রদর্শনী এবং সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।
নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস ২০২৩-এর থিম । Theme For Nelson Mandela International Day 2023 :
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সংকটকে দূর করতে সুস্থ্য এবং খাদ্য পরিপূর্ণ পরিবেশ তৈরী করা চলতি বছরের 'নেলসন ম্যান্ডেলা দিবসে'র লক্ষ্য। ফলে এই দিবসের প্রতিপাদ্য হলো "এটি আপনার হাতে" (It's In Your Hands)।
নেলসন ম্যান্ডেলা সম্পর্কে অজানা তথ্য । Unknown Facts About Nelson Mandela :
দক্ষিণ আফ্রিকায় মানবতাবাদী কাজ এবং শান্তিপ্রবর্তক হিসেবে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। জানুন তাঁর সম্পর্কে বেশ কিছু অজানা তথ্য।
১. কারাবাসে থাকাকালীন আইনের ডিগ্রি লাভ । Obtained Law Degree While in Prison :
নেলসন তাঁর কলেজ জীবন থেকেই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ও তাঁদের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তবে এই সংগ্রামের সঙ্গে পড়াশোনাও চালিয়ে যান তিনি। ১৯৩১ সালে ফোর্ট হেয়ার ইউনিভার্সিটি কলেজে (Fort Hare University College) ভর্তির পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন ম্যান্ডেলা। যার ফলে কারাবাসে পাঠানো হয় নেলসনকে। তবুও থামেনি তাঁর পড়াশোনা। কারাগারে থাকাকালীনই শেষ মাসগুলিতে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৯৮ সালে আইন নিয়ে পড়া শেষ করে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫০ টিরও বেশি সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন নেলসন ম্যান্ডেলা।
২. নেলসন গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন । Nelson Was Forced to Leave The Village :
কলেজ চলাকালীন কারাবাসে যাওয়ার পর থেকে গ্রামে তার সুনাম ক্ষুন্ন হয়। যার ফলে যখন তিনি তাঁর জন্মস্থানে ফিরে আসেন তখন গ্রামের প্রধান তাঁকে এবং তাঁর চাচাতো ভাইয়ের উপর জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে এতে রাজি হন না কেউই। বরং জোহানেসবার্গে (Johannesburg) পালিয়ে যান তারা।
৩. নেলসন দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়ার জন্য ভিন্ন নাম ব্যবহার করেছিলেন । Nelson Used a Different Name to Leave South Africa :
শ্বেতাঙ্গ বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য নেলসনকে দেশের বাইরে যাওয়া থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। তবে বিভিন্ন দেশে তার শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে ডেভিড মোতসামায়ী (David Motsamayi) নামে একটি ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে বিদেশ ভ্রমণ করতেন ম্যান্ডেলা।
৪. প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন । Founded The First Black Law Firm :
১৯৫২ সালে তিনি তাঁর সহযোগী এএনসি সদস্য অলিভার ট্যাম্বোর (Oliver Tambo) সঙ্গে দেশে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন ম্যান্ডেলা। প্রধানত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই আরও গঠনমূলক করে তুলতে এই সংস্থার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংস্থার নাম দেওয়া হয় 'ম্যান্ডেলা এবং ট্যাম্বো' (Mandela and Tambo)।
৫. তিনি বিশ্বাস করেন বর্ণবাদ হ্রাস করতে খেলাধুলা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে । He Believes That Sports Can Play a Big Role in Reducing Racism :
কারাগারে থাকা সত্ত্বেও, নিজের সক্রিয়তা অব্যাহত রেখেছিলেন ম্যান্ডেলা। পাশাপাশি বেশ কয়েকজন বন্দিকে অহিংস প্রতিরোধের পাঠদান ও পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি। ম্যান্ডেলা বিশ্বাস করতেন যে, খেলাধুলা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে এবং অনুপ্রাণিত করতে পারে। সঙ্গে এবং বর্ণবাদ কমাতেও বড় ভূমিকা পালন করতে পারে খেলাধুলা। সেজন্য তিনি তাঁর সক্রিয়তায় খেলাধুলাকে ব্যবহার করতেন।
নেলসন ম্যান্ডেলা কেবল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না। বিশ্বকে বদলে দেওয়ার জন্য বিশাল স্বপ্নের একজন মানুষ ছিলেন তিনি। যার ফলে তাঁকে সম্মান জানাতে তাঁর জন্ম তারিখে অর্থাৎ ১৮ই জুলাই বিশ্ব জুড়ে পালন করা হয় 'নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস'।