Heat Wave | গরমে স্বস্তি পেতে রাস্তায় যেখান সেখান থেকে খাচ্ছেন জল, কাটা ফল, শরবত? তাপপ্রবাহে কেবল হিট স্ট্রোকই নয় হতে পারে হিট ক্র্যাম্প, হিট এক্সহসনও!
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, তীব্র গরমে কিংবা তাপপ্রবাহের মধ্যে বিভিন্ন ভুল পদক্ষেপের জন্য পেটের সমস্যাও মারাত্মক আকার নিতে পারে। এই সময়ে তেষ্টা মেটাতে বহু পথচলতি মানুষ যেখান-সেখান থেকে জল পান করেন। কিংবা রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া আইসক্রিম, রঙিন শরবত বা লেবুর জল কিনে পান করেন। এতে সংক্রমণের আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
বৈশাখের শুরুতেই বঙ্গের তাপমাত্রা ছুঁয়েছে ৪০ ডিগ্রি। এর সঙ্গে রয়েছে তাপপ্রবাহ, হিটওয়েভ, লু এবং হিট স্ট্রোক! এখনই স্বস্তি মিলবে না বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর। পশ্চিমবঙ্গ আবহাওয়ার খবর (west bengal weather news) অনুযায়ী, আগামী কয়েক দিনে অস্বস্তিকর গরম বাড়বে এবং তীব্র থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ সতর্কতা (Moderate heatwave warning) রয়েছে সঙ্গে। এই গরমের হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই রাস্তায় বেরিয়ে নানা রকমের ঠান্ডা পানীয়, কাটা ফল, ফলের রস (fruit juice) খেয়ে থাকেন। কিন্তু এই বিষয়ে সতর্ক করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, হিট স্ট্রোকের পাশাপাশি পেটে সংক্রমণ হয়ে ডায়েরিয়াও শুরু হতে পারে। যা এই গরমে শরীরকে আরও দুর্বল করে তুলবে। আসলে হিটওয়েভ থেকে হিটস্ট্রোকই নয়, নানান অসুখ হতে পারে যেমন- হিট ক্র্যাম্প,হিট এক্সহসন, হিট স্ট্রোক। ফলে তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে যেমন সঠিক খাদ্যাভাস এবং নিয়ম মানতে হবে তেমনই সতর্ক হতেই হবে স্বাস্থ্য বিধি নিয়েও।
তাপপ্রবাহ । Heat Wave :
তাপপ্রবাহের জেরে শরীর থেকে কুলকুল করে ঘাম বেরোতে শুরু করে, গায়ে জ্বালা ধরা শুরু হয়। তাপপ্রবাহ মানুষের শরীরের জন্য বিপজ্জনক। আসলে কোনও এলাকার স্বাভাবিক তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে সেখানে কত তাপমাত্রা হলে তাকে তাপপ্রবাহ বলা যাবে। যখন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সমতলের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৪০ ডিগ্রি বা তার বেশি এবং পার্বত্য অঞ্চলের জন্য কমপক্ষে ৩০ ডিগ্রি বা তার বেশি হয়, তখন তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি বলা হয়। স্বাভাবিকের থেকে তাপমাত্রা সাড়ে ৪ ডিগ্রি থেকে ৬.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হলে তা তাপপ্রবাহ বলে ধরা হয়। আর তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি ছাড়ালে , তা তীব্র তাপপ্রবাহের আওতায় পড়বে। যখন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যাবে, তখন তা অতি তীব্র তাপপ্রবাহের আওতায় পড়বে।
হিটওয়েভ ও নানা অসুখ । Heatwave and Various Diseases :
তাপপ্রবাহের জেরে শুধুমাত্র হিটস্ট্রোকই নয়, হতে পারে - হিট ক্র্যাম্প,হিট এক্সহসনের মতো অসুখও।
হিট ক্র্যাম্প : হঠাৎ করেই প্রচন্ড পেশিতে টান লাগা, নিজের অনিচ্ছাতেই হাত, পা কাঁপতে থাকা, প্রচন্ড ঘাম, সেই সঙ্গে প্রবল জ্বর হিট ক্র্যাম্পের (Heat Cramp) লক্ষণ। জলের মতো ঘাম বেরোতে থাকে হিট ক্র্যাম্প হলে। গায়ের তাপমাত্রাও অনেকটাই বেড়ে যায়। এমনটা হলে প্রথমেই অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা জায়গায় যেতে হবে। ব্যথা হচ্ছে এমন পেশীতে আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করতে হবে। সেই সঙ্গে জলে চুমুক দিতে হবে।
হিট স্ট্রোক : হিট স্ট্রোক (Heat Stroke) বাংলার গরমে কিন্ত এখন প্রায়ই ঘটছে। আর হিট স্ট্রোকের ফলে মৃত্যুও ঘটছে। চিকিৎসকদের মতে, যাঁরা বেলা ১১ টা থেকে বিকেল ৪ টের মধ্যে কোনও কারণে রোদে বের হচ্ছেন, যাঁদের বয়স ৫৫ বছরের বেশি বা ১০-১৫বছরের কম, তাঁরাই মূলত হিটস্ট্রোকের শিকার হন বেশি। শরীর তার ভিতরের তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে নিজস্ব শারীরবৃত্তীয় কৌশলে। কিন্তু এখন রোদের তাপ এতটাই বেশি যে শরীর থেকে প্রচুর জল বেরিয়ে যাচ্ছে। শরীর তখন সেই ব্যালেন্সটা দরে রাখতে পারে না। ফলে পথে-ঘাটে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনেক সময়ই অজ্ঞান হয়ে পড়ার মত পরিস্থিতি হচ্ছে। ব্ল্যাক আউট হচ্ছেন। এটাই হিট স্ট্রোক।
হিট এক্সহসন : অতি ক্লান্তি, দুর্বলতা, ঝিমিয়ে পড়া মাথা যন্ত্রণা, বমি, মাসল ক্র্যাম্প ইত্যাদি হতে পারে হিট এক্সহসনের (Heat Exhaustion) ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি রোগীকে ঠান্ডা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। অতিরিক্ত জামা কাপড় ছাড়িয়ে হালকা কিছু পরাতে হবে। ঠান্ডা জল দিতে হবে।
তাপপ্রবাহে অসুস্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা কাদের বেশি? । Who is More Likely to Get Sick in a Heat Wave?
প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যারা বেশি সময় ধরে গরমে কাজ করছেন তাদের যে-কারও হিট স্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন- শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় তাদের হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেক বেশি। যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন— কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক, দিনমজুর, কন্সট্রাকশন লেবার ইত্যাদি। শরীরে ডিহাইড্রেশন হলে অর্থাৎ জল কম পান করলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ও যাদের শরীরে অত্যাধিক ঘামের মধ্যে জল ও খনিজ বেরিয়ে যায়। কিছু কিছু ওষুধ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় বিশেষ করে যারা ডাইইউরেটিক গ্রুপের ওষুধ খান তাদের শরীরে জলের ঘাটতি দেখা দেয়।
তাপপ্রবাহে কীভাবে সুস্থ্য থাকবেন? । How to Stay Healthy in Heatwave?
তাপপ্রবাহে হাইড্রেশনের দিকে নজর দিতে হবে সবসময়। এটাই গরমের সঙ্গে লড়াইয়ের মূল মন্ত্র। তবে বাইরে থেকে ফিরে এসেই ঠান্ডা জল নয়, একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর ঠান্ডা জল খান। বারবার এসি ও নন-এসি পরিস্থিতির বদলের জন্য শরীর অসুস্থ হতে পারে। যাঁরা এসিতে থাকেন, তাঁদের তেষ্টা কম পায়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কিন্তু তাঁদের জলের চাহিদাটা বেশি। তাই এসি তে থাকলেও জল খেতে হবে। তাছাড়া এই তীব্র তাপপ্রবাহে ডায়েটে রাখতে হবে দই। এই গরমে কফি-চা একটু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ভাল। পেটের সমস্যা গরমকালে একটু বেড়ে যায়। তাই এসময় হাত ধুয়ে খাওয়া, খাবার ঢেকে রাখার অভ্যেস করুন। হজম করার ক্ষমতাও কমে যায় গরমে। পুষ্টিবিদের পরামর্শ এ সময় কষিয়ে রান্না করে না খেয়ে সাধারণভাবে রান্না করা সহজপাচ্য প্রোটিন খান। আর যেসব দিকে নজর রাখবেন -
- প্রচুর পরিমানে জল খেয়ে শরীরকে হাইড্রেট করতে হবে। ইলেক্ট্রোলাইট ঘাটতি মেটাতে জলের সাথে ওআরএস পানীয় (ORS drink) খেলতে হবে। নাহলে ঘরোয়া পদ্ধতিতে ৪ টেবিল চামচ চিনি ও ১ চামচ লবন এক লিটার জলে মিশিয়ে ব্যাগে রাখুন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় এই জল পান করতে থাকুন।
- জলের পাশাপাশি ফলের রস (fruit juice) যেমন লেবু, বেল, তরমুজের জুস্ খেতে পারেন। কিডনি ও প্রেশারের রুগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ মত জল পান করুন। গরমে চা, কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস না খাওয়াই ভালো।
- পোশাক পরুন ঢিলেঢালা, সুতির কাপড়ের ও হালকা রঙের। গরমে আঁটোসাটো পোষাক থেকে শরীরকে রেহাই দিন। ফুল স্লিভ জামা বা কাপড় ব্যবহার করুন যাতে শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢাকা থাকে। নরম কাপড়ের অন্তর্বাস অবশ্যই ব্যবহার করুন। যাতে দ্রুত ঘাম শুষে নিয়ে আপনার শরীরকে ঠাণ্ডা রাখবে।
- বাইরে বেরোলে অবশ্যই ছাতা, টুপি,সানগ্লাস ব্যবহার করুন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঠান্ডা জল দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিন। ওয়েট ওয়াইপ রাখতে পারেন সাথে।
- ত্বক অনুযায়ী সঠিক সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। যাদের ত্বক বেশি সেন্সিটিভ প্যারাবেন কিংবা অক্সিবেনজোন জাতীয় কেমিক্যাল যুক্ত সানস্ক্রিন এড়িয়ে চলুন। সূর্যের তাপ থেকে ত্বককে রক্ষা করে এই উপাদানগুলি। বাইরে যাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে মেখে নিতে হবে সানস্ক্রিন। সম্ভব হলে ২ ঘন্টা বাদে আরও একবার মেখে নিতে হবে।
- গরমের সময় ফাস্টফুডকে না বলুন। কেননা, এতে থাকা অতিরিক্ত লবন, তেল গরমে আপনার শরীরকে আরও বেশি ক্ষতি করবে। বাইরের খোলা খাবার থেকে বিরত থাকুন। ঘরোয়া হালকা খাবারে জোর দিন এবং ডায়েটে ফলের তালিকায় (fruit chart) এমন ফল রাখুন যা শরীর ঠান্ডা করবে।
- প্রচণ্ড গরমে শরীরে যাতে ঘাম না জমে তার জন্য সম্ভব হলে হালকা রুমাল জলে ভিজিয়ে গা মুছে নিন। বাড়িতে থাকলে একধিকবার স্নান করুন।
- হঠাৎ বাইরে থেকে এসে এসি তে বসবেন না বা হঠাৎ এসি থেকে বেরিয়ে অতিরিক্ত গরমে যাবেন না।
- দীর্ঘক্ষণ প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। এতে রক্তচাপ কমে যেতে পারে।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, তীব্র গরমে কিংবা তাপপ্রবাহের মধ্যে দুপুরে রাস্তায় থাকলে বিভিন্ন ভুল পদক্ষেপের জন্য পেটের সমস্যাও মারাত্মক আকার নিতে পারে। এই সময়ে তেষ্টা মেটাতে বহু পথচলতি মানুষ যেখান-সেখান থেকে জল পান করেন। কিংবা রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া আইসক্রিম, রঙিন শরবত বা লেবুর জল, কাটা ফল কিনে খান। কিন্তু এতে সংক্রমণের আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। আসলে তীব্র তাপমাত্রার কারণে খোলা খাবারে ব্যাক্টিরিয়া ও ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ ঘটছে। ফলে খাবার তাড়াতাড়ি নষ্টও হচ্ছে। আবার, তীব্র গরমেশরীরের বিপাক প্রক্রিয়া সহজে কাজ করতে পারে না। যার ফলে খাবার হজম করতেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই দুইয়ের কারণেও পেটের গোলমালে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, দুপুরের তীব্র রোদে রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ ঘোরাঘুরির মধ্যে যদি পেটে বার বার মোচড় দেয় কিংবা পাতলা পায়খানা হয়, তা হলে দেরি না করে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া ভাল। গা গোলানো, মাথা ঝিমঝিম, পাতলা পায়খানা— এগুলি সবই হিট স্ট্রোকের পূর্বাভাস।
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গ আবহাওয়ার খবর (west bengal weather news) অনুযায়ী, এখনই আবহাওয়া বদলাবে না। বরং বাড়বে তাপমাত্রা। জারি করা হয়েছে তীব্র থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ সতর্কতা (Moderate heatwave warning)। ফলে এই সময়ে সাবধানে থাকুন। বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত বাইরে না বেরোনোই ভালো। বাইরে বেরোলেও সঙ্গে রাখুন ওআরএস পানীয় (ORS drink)।
- Related topics -
- লাইফস্টাইল
- স্বাস্থ্য
- খাদ্য
- খাদ্যগুণ
- পানীয়
- পানীয়জল
- কোল্ড ড্রিংক
Contents ( Show )