চিত্রের জাদুকর ; যামিনী রায় | Biography of an Indian Painter, Jamini Roy
যামিনী রায় ছিলেন একজন বাঙালি চিত্রশিল্পী। তিনি বাংলার বিখ্যাত লোকচিত্র কালীঘাট পটচিত্র শিল্পকে বিশ্বনন্দিত করে তোলেন। তিনি নিজে পটুয়া না হলেও নিজেকে পটুয়া হিসেবে পরিচয় দিতেই তিনি পছন্দ করতেন।
ভূমিকা | Introduction to Jamini Roy
যে সমস্ত চিত্রশিল্পী আন্তর্জাতিক মহলে দেশীয় চিত্রকলার ঐতিহ্যকে প্রদর্শন করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলেন যামিনী রায়।স্বদেশের প্রত্যন্ত ও অবহেলিত লোকসংস্কৃতিকে তাঁর বলিষ্ঠ তুলির আঁচড়ে ও রঙের মাধুর্য দিয়ে ভরিয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মান প্রদান করেছিলেন। কালীঘাটের পটশিল্পীকে কে সমগ্র বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন এই স্বনামধন্য শিল্পী।অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম যোগ্য শিষ্যদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি।যামিনী রায় নিজে পটুয়া না হলেও নিজেকে পটুয়া হিসেবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করতেন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন | Birth & educational life of Jamini Roy
বিশিষ্ট বাঙালি চিত্রশিল্পী যামিনী রায় ১৮৮৭ খ্রিষ্টাবদের ১১ ইএপ্রিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামের এক মধ্যবিত্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতার নাম রামতরণ রায় এবং মাতার নাম নগেন্দ্রবালা দেবী। যামিনী রায়ের পিতা ছিলেন শৌখিন এবং শিল্পী মনের মানুষ। ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ সাল অবধি তিনি কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক নিয়ম অনুযায়ী অধ্যয়ন করেন। আর্ট স্কুলে অধ্যয়নকালীন সময়ে ইতালীয় শিল্পী গিলার্দি এবং অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের সান্নিধ্য লাভ করে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় শিল্পের কলা-কৌশলের সাথে তিনি সুপরিচিত হয়েছিলেন।পাশ্চাত্য রীতির শিল্পকলা যামিনী রায়কে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল।বিখ্যাত শিল্পী পল সেজান, ভ্যান গগ ,পাবলো পিকাসো, প্রভৃতি স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীর প্রভাব দেখা যায় তাঁর শিল্পে । তবে পরবর্তীকালে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত দেশজ সরল রীতিতে চিত্র নির্মাণ করে থাকেন। পরবর্তীকালে কিছুদিন তিনি ফার্সি শিল্পীদের মতো চিত্র চর্চা করেছিলেন এবং এভাবে চিত্রচর্চার প্রতি তাঁর মনোযোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে ।চিত্রচর্চা উদ্দেশ্য হেতু মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হন ।
লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহ | Jamini Roy's interest in folk art
বিদেশি ভাবধারায় উদ্ভূত হয়ে প্রথমদিকে তাঁর আঁকায় পাশ্চাত্যের প্রভাব দেখা দিলেও পরবর্তীতে সম্পূর্ণ দেশীয় তথা গ্রামবাংলার সুন্দর প্রতিচ্ছবি তিনি তাঁর ছবিগুলিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন । নিজস্ব বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাবধারার জন্য তিনি সততই গর্ব অনুভব করতেন তাই পরবর্তীকালে তিনি লোকশিল্পকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর চিত্রের উপজীব্য বিষয় হিসাবে।বহুবার বিদেশ থেকে তাঁকে আমন্ত্রিত করা হলেও তিনি কখনো বিদেশে পাড়ি দেন নি। কালীঘাটের পটশিল্পের দ্বারা তিনি বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তাই তিনি সেটিকেই তাঁর চিত্রশিল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে যামিনী রায়ের শিল্প 'পটুয়া শৈলীর' আঙ্গিকে চিত্রিত।তাঁর ছবির চরিত্র শান্ত এবং কোমল। কখনো পৌরাণিক প্রেক্ষাপট আবার কখনও বা লোকসামাজিক জীবনযাত্রা যামিনী রায়ের চিত্রে সুন্দর ভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে । ইউরোপীয় পদ্ধতিতে ও চিন্তনকে অধিক প্রাধান্য না দিয়ে ঐতিহ্যশালী ভারতীয় দর্শনের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে অবলীলায় ইউরোপীয় সাহচর্য ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন নিজস্ব সাংস্কৃতিক মূলে। তবে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে থাকাকালীন তাঁর দেখা সেজান, গগ্যাঁ, ভ্যান গগদের ছবির প্রভাব অন্তরে রেখেই যামিনী রায় তাঁর নব অনুরাগ দেখিয়েছিলেন বাংলার লোকশিল্পে, সংস্কৃতিতে ও লোকপুরাণে,লোকজ ছন্দ ও স্পন্দনে। তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে বাংলার সাধারণ সমাজের ধর্ম, আচরণ, শিল্পকলা, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল । বাংলার উদ্ভিদজগৎ, প্রাণিজগৎ, প্রাকৃতিক জগৎ নিজের স্বরূপে ফিরে পেয়েছিল যামিনী রায়ের চিত্রশিল্পে ।
এই সবই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলার পটচিত্রে, পটুয়া পাড়ায়, কালীঘাটে, বেলিয়াতোড়, বিষ্ণুপুরী টেরাকোটায়। আটপৌরে কায়দায়, প্রসাধনহীন সরলরেখায় এবং মাটির রং দিয়ে তাঁর ছবি ছিল বর্ণিত।তিনি তাঁর শৈলীর নাম রেখেছিলেন,' ফ্ল্যাট টেকনিক'। যামিনী রায় একে একে সৃষ্টি করেন রামায়ণ কথা, সাঁওতাল জীবনযাপনের ইতিবৃত্ত, কৃষ্ণলীলা প্রভৃতি। ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে এই পটুয়া শিল্পকেই কেন্দ্র করে শহরের শিল্পজগতে নিজের একটি স্থায়ী জায়গা তৈরি করে ফেলেছিলেন।সেই প্রথম কোনো এক ভারতীয় শিল্পীর আঁকা প্রদর্শিত হয় ব্রিটিশ কলকাতার রাস্তায়।সাধারণ মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই ছিল তাঁর চিত্রিত ছবির মূল্য। । তাঁর সৃষ্টির মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেছে বাঁকুড়ার পটচিত্রের ধর্ম, ধর্মচিহ্ন, বৈষ্ণব অনুরাগ, রামায়ণ, মহাভারত, মনসামঙ্গল, মঙ্গলকাব্য আলেখ্য। প্রাণি ও উদ্ভিদের ‘মোটিফ’, জ্যামিতিক গড়ন ও কোনো কোনো চিত্রকলায় সুস্পষ্ট । পটচিত্রে ধরা দিয়েছিল চিত্রকরের নিজস্ব ভাবনা, গোষ্ঠীর ভাবনা, শ্রুতি, মৌখিক পরম্পরা, হেঁয়ালি-প্রবাদ নির্ভর কল্পনার জাগরণ। তাঁর ছবিগুলি ছিল একপ্রকার মৌখিক সাহিত্যের চিত্ররূপ।
ক্রমশ পাশ্চাত্য দুনিয়াও তাঁর শিল্পের সন্ধান পেল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে যামিনী রায়ের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হল নিউ ইয়র্কে এবং লন্ডনে। পরের দিকে যামিনী রায় তাঁর শিল্পী উপকরণেও পাশ্চাত্য বস্তু বাদের ছোঁয়া রেখেছিলেন । ক্যানভাসের পরিবর্তে ব্যবহার করতেন কাপড় দিয়ে তৈরি উপকরণ ও রঙ প্রস্তুত করতেন বিভিন্ন প্রাকৃতিক পদার্থ দিয়ে।
দেশজ উপকরণের ব্যবহার | Use of Jamini Roy's indigenous ingredients
সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরেই যামিনী রায় তাঁর চিত্রকলার চর্চা করে গিয়েছিলেন ।বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত পুতুল, শিশু, গ্রাম বাংলার অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা,পশুপাখি ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখের ছবি ইত্যাদি তিনি ছিল তাঁর ছবির মূল উপজীব্য বিষয়। সেই ছবিগুলোকে সহজলভ্য করার জন্য তিনি ছবি আঁকার উপকরণ হিসেবে খড়িমাটি ,ভুসাকালি , ইটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি ও বিভিন্ন লতাপাতার রস ব্যবহার করে থাকতেন। পটচিত্র আঁকার সময় তিনি বিভিন্ন প্রকারের বর্ণময় পট ব্যবহার করে থাকতেন। পটটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে কাজ করা হত এবং রংয়ের প্রকারের মধ্যে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, বাদামী, সাদা এবং কালো ব্যবহৃত করা হত।
চিত্র সমূহ | Pictures of Jamini Roy
যামিনী রায়ের আঁকা কিছু বিখ্যাত ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম হলো :'সাঁওতাল জননী ','মা ও শিশু ', 'গণেশ জননী', 'নৃত্যরত সাঁওতাল', 'যিশু', 'রাধাকৃষ্ণ' ইত্যাদি।১৯১৮-১৯ সালে তাঁর ছবি ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস পত্রিকায় প্রকাশিত হয় পরবর্তীসময়ে তিনি সাঁওতাল আদিবাসীদের নিয়ে গবেষণা করে থাকেন এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চার স্বরূপ ফুটিয়ে তোলেন তাঁর চিত্রে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ভারতে আগত মার্কিন সৈনিক ও অফিসারবৃন্দ যামিনী রায়ের চিত্র অধিকমূল্যে কেনবার ফলে তাঁর চিত্রের জনপ্রিয়তা প্রভূত বৃদ্ধি পেয়েছিল।আন্তর্জাতিক মহলেও তাঁর ছবি বহুল প্রশংসিত হয়ে থাকে যা পরবর্তীকালে ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে আমেরিকা, ব্রিটেন, প্যারিস ও ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট মিউজিয়াম সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সংরক্ষিত আছে যামিনী রায়ের চিত্রকলা।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা | Awards & honours of Jamini Roy
১৯৫৪ সালে যামিনী রায়কে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা, 'পদ্মভূষণে' সম্মানিত করা হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি সর্বপ্রথম ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন যা চারু শিল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান হিসেবে মান্য করা হয়।১৯৫৬ সালে তাঁকে ডি-লিট সম্মানেও ভূষিত করা হয়ে থাকে। এই মহান চিত্রশিল্পীকে নিয়ে যত গ্রন্থ ,পত্র পত্রিকা, আলোচনাসভা এবং প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে ভারতীয় কোনো চিত্রকরকে নিয়ে তা আজ পর্যন্ত করা হয়নি।
মৃত্যু | Death of Jamini Roy
পঁচাশি বছর বয়সে, ১৯৭২ সালের ২৪ শে এপ্রিল কলকাতায় এই স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীর মৃত্যু হয়।
উপসংহার | Conclusion
আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসে যামিনী রায় এক প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী। চিত্রশিল্পকে জাদুঘরের দেওয়াল থেকে মধ্যবিত্তের চার দেয়ালের মধ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় আধুনিক শিল্পকে এক বিশেষ রূপদান করেছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর সম্মান লাভ করেছিলেন। বাংলার আধুনিক শিল্পের এই অন্যতম প্রাণপুরুষকে সংস্কৃতিপ্রিয় প্রত্যেকটি মানুষই চিরকাল মনে রাখবে।
প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions
প্রখ্যাত চিত্রকর যামিনী রায় কার প্রিয় শিষ্য ছিলেন?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যামিনী রায় কোন শিল্পকে তার আঁকায় স্থান দিয়েছিলেন ?
কালীঘাটের পটশিল্প
যামিনী রায় তাঁর নিজস্ব চিত্রশৈলীর কী নাম রেখেছিলেন ?
'ফ্ল্যাট টেকনিক'
গ্রামীণ ই ড্রয়ের দুটো বিখ্যাত ছবির নাম কি কি?
'সাঁওতাল জননী' ', মা ও শিশু'
যামিনী রায়ের কবে মৃত্যু হয়?
পঁচাশি বছর বয়সে, ১৯৭২ সালের ২৪ শে এপ্রিল কলকাতায় এই স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীর মৃত্যু হয়।
- Related topics -
- জীবন ও জীবনী
- জীবনী সাহিত্য
- যামিনী রায়
- ভারতীয়
- চিত্রশিল্পী
- শিল্পী
Contents ( Show )
- ভূমিকা | Introduction to Jamini Roy
- জন্ম ও শিক্ষাজীবন | Birth & educational life of Jamini Roy
- লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহ | Jamini Roy's interest in folk art
- দেশজ উপকরণের ব্যবহার | Use of Jamini Roy's indigenous ingredients
- চিত্র সমূহ | Pictures of Jamini Roy
- স্বীকৃতি ও সম্মাননা | Awards & honours of Jamini Roy
- মৃত্যু | Death of Jamini Roy
- উপসংহার | Conclusion
- প্রশ্নোত্তর ( Frequently Asked Questions )
- পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File