নৈস্বর্গিক চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু | Biography of an Indian artist, Nandalal Bose
১৯৪৩ সালে তিনি বরোদার মহারাজের কীর্তিমন্দির অলঙ্কৃত করার দায়িত্ব লাভ করেন। এই কীর্তিমন্দিরের চারিদিকের এবং শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতনের দেয়ালচিত্র নন্দলাল বসুকে খ্যাতিমান করে তুলে। ভারতীয় সংবিধানের সচিত্র সংস্করণও নন্দলাল বসু অলংকৃত করেন।
ভূমিকা | Introduction of Nandalal Bose
বিংশ শতাব্দীতে বাঙালি চিত্রকলা চর্চার অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রকর নন্দলাল বসু।তিনি ছিলেন এমন একজন ভারতীয় বাঙালি শিল্পী যিনি পাশ্চাত্য শিল্প আঙ্গিকের বাইরে বেরিয়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল নব চেতনার প্রতিশ্রুতি বিস্তৃত করেছিলেন গোটা ভারতে। নন্দলাল বসু ছিলেন আদ্যন্ত দেশপ্রেমিক, সেবাপরায়ণ,নিরহংকারী ও প্রচারবিমুখ। একজন শিল্পী হিসেবে তিনি সকল বস্তুর মধ্যে তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করেছিলেন এবং সাধারণ মানুষের জীবনে শিল্পের প্রভাব যাতে আরও গভীরে প্রবেশ করে সেদিকে সর্বক্ষণ তাঁর নজর ছিল।
জন্ম | Birth of Nandalal Bose
নন্দলাল বসুর জন্ম ১৮৮২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ববিহারের মুঙ্গের জেলার হাভেলি-খড়গপুরে। ।তাঁদের আদিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হুগলী জেলার হরিপাল-তারকেশ্বর সন্নিকটে অবস্থিত জেজুর গ্রামে। নন্দলাল বসুর বাবার নাম ছিল পূর্ণচন্দ্র বসু ও মাতার নাম ক্ষেত্রমণি দেবী। বাল্যকাল থেকেই এই মহান চিত্রকার প্রবল উৎসাহ সহকারে দেব-দেবীর মূর্তি সহ পুতুল বানাতেন।
শিক্ষাজীবন | Education life of Nandalal Bose
নন্দলাল বসু দ্বারভাঙ্গা ও কলকাতা স্কুলে শিক্ষা প্রাপ্ত করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯০২ সালে। ছোটবেলা থেকেই চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য শিল্পের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আকর্ষণ। চিত্রকলার প্রতি মোহ ও লেখাপড়ায় অমনযোগিতার কারণে এফ, এ পরীক্ষায় পর পর দু বার অকৃতকার্য হয়েছিলেন । পরবর্তীকালে তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহায্যে কলিকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকেন। এই সময় তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরএর একজন অন্যতম প্রিয় শিষ্য হয়ে ওঠেন। ভারতীয় শিল্পকলার সংস্কারবাদী আন্দোলনের নেতা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনা করেছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ।সেই আন্দোলন বেঙ্গল স্কুল আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে এবং তাঁর শিষ্য নন্দলাল বসু , জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন ও শিক্ষানবিশ থাকা অবস্থাতেই নন্দলাল একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই কলেজে ছাত্র থাকাকালীন তিনি কর্ণের সূর্যস্তব, গরুড়স্তম্ভতলে শ্রীচৈতন্য, কৈকেয়ী, শিবমতি, নৌবিহার প্রভৃতি চিত্র অঙ্কন করে নিজের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন।
তাঁর জগাই-মাধাই এবং সতীর মতো কিছু চিত্রশিল্প সারা ভারতে সুবিশাল লোকপ্রিয়তা লাভ করেছিল ।চারুকলা বিদ্যালয় থেকর উত্তীর্ণ হওয়ার পর নন্দলাল বসু , 'দি ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট স্কুলে' যোগদান করেন এবং সেখানে তিনি তিন বছর কর্মরত ছিলেন। ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দে তিনি তাঁর শিব-সতী চিত্রশিল্পের জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার পান এবং তিনি সেই অর্থ দিয়ে ভারতীয় সভ্যতার শৈল্পিক কীর্তিসমূহ স্বচক্ষে দর্শন হেতু বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করেন। এই পরিভ্রমণ নন্দলালের শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল যার প্রভাব তাঁর শিল্পসাধনায় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনে দেয়।
কর্মজীবন | Career of Awards and honors of
কর্মজীবনের অগ্রভাগে নন্দলাল বসু পাটনা, রাজগির, বুদ্ধগয়া, বারাণসী, দিল্লী, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন, এলাহাবাদ ভ্রমণ করে উত্তর ভারতের শিল্প ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি পুরী থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারত পরিদর্শন করেছিলেন এবং কোণারকের সূর্য মন্দির তাকে ভীষণ রকমভাবে প্রভাবিত করে। বাঘ গুহার ক্ষয়প্রাপ্ত চিত্রগুলি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব লাভ করেন তিনি ১৯২১ সালে। ভগিনী নিবেদিতার হিন্দু-বৌদ্ধ পুরাকাহিনী সম্বলিত পোস্টটির অঙ্গসজ্জা করেছিলেন এবং ঠাকুর বাড়ির চিত্রকলার তালিকা প্রস্তুত করতেও সহায়তা করেছিলেন। ১৯১৪ সালে তিনি শান্তিনিকেতনের কলাভবন পরিদর্শন করেন যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসেন। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোতে 'বিচিত্রা' প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে স্বল্প সময়ের জন্য অবস্থান করেন ও সেখানে শিল্পকলার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। নন্দলাল বসু ১৯২০ সাল থেকে শান্তিনিকেতনে বসবাস করেন এবং ১৯২২ সালে কলাভবনের দায়িত্ব নেন।
১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ সালে পর পর তিন বছর তিনি কংগ্রসের বার্ষিক সম্মেলনে শিল্প প্রদর্শনী ব্যবস্থাপকের দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন। হরিপুরা সম্মেলনে(১৯৩৭) তিনি লোকচিত্রের ধারাবাহী ৮৩টি পট প্রদর্শন করেছিলেন যা 'হরিপুরা পট' নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিল । ১৯৪৩ সালে নন্দলাল বসু বরোদার মহারাজের কীর্তিমন্দির অলংকরণ করার দায়িত্ব লাভ করেন এবং সেই মন্দিরে অলংকৃত তাঁর দেয়ালচিত্র তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল।জাতীয় সংবিধানের সচিত্র সংস্করণও নন্দলাল বসুর শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের নিদর্শন । তার প্রত্যেকটি চিত্রগুলির মধ্যে তাঁর বিরল প্রতিভার ও স্বাতন্ত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বই সহজপাঠের চরিত্রগুলিও নন্দলাল বসুর সৃষ্টি । তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ চিত্রগুলির মধ্যে অন্নপূর্ণা, সতী, দার্জিলিং প্রভৃতি উল্লেখ্যযোগ্য ।
পুরস্কার ও সম্মাননা | Awards and honours of Nandalal Basu
নন্দলাল বসু ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী থেকে দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত হন। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে ভারত সরকারের দ্বারা পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ও তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল।১৯৫৬ সালে এই মহান চিত্রশিল্পী ললিত কলা একাডেমির দ্বিতীয় ফেলো নির্বাচিত হনI
নন্দলাল বসুর শৈল্পিক নিদর্শন | Nandalal Basu's artistic specimens
একজন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও প্রাচীরচিত্র শিল্পী হিসেবে নন্দলাল বসু আধুনিক ভারতে শীর্ষস্থান অর্জন করেছিলেন । নন্দলাল বসুর রৈখিক ও অনুপম শিল্পশৈলী তাঁর নিজের ব্যক্তিত্বে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাঁর অবিস্মরণীয় কিছু চিত্রশিল্পের মধ্যে রয়েছে সাবিত্রী ও যম, গান্ধারী, সিদ্ধার্থ ও আহত হংস, হলাহল পানরত শিব, মিরাবাই, শ্রীচৈতন্যের জন্ম ইত্যাদি।
১৯৩০ সালে লবণ-আন্দোলনে গান্ধীর গ্রেফতারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি লাঠিহাতে পদযাত্রারত গান্ধীজির একটি বস্ত্রখোদিত নকশা অঙ্কন করেছিলেন যা ইতিহাসের পাতায় এখনো জাজ্বল্যমান। নন্দলাল বসু স্বচ্ছ জলরঙের ওয়াশ পদ্ধতির পাশাপাশি টেম্পেরার কাজেও অতীব পারদর্শী ছিলেন।
নন্দলাল বসুর অনুপ্রেরণা | Nandalal Basu's inspiration
ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বামী বিবেকানন্দ ও সিস্টার নিবেদিতার আধ্যাত্মিকতা বাদ, প্রাচীন ভারতের শৈল্পিক ঐতিহ্য এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা নন্দলাল বসুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর সৃষ্টি করা প্রথম দিকের অনেক ধর্মীয় এবং পৌরাণিক শিল্পকর্ম অজান্তা এবং অন্যান্য ঐতিহ্যগত প্রাচীরচিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অঙ্কিত করা আছে। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে ও তিনি উদ্দীপিত হন এবং তাঁর চারদিকের পরিবেশ থেকে সমকালীন ভাবধারা চিত্রায়ন করতে শুরু করেছিলেন যা পরবর্তীকালে তাঁর ছাত্রদের উপর ও প্রভাব বিস্তার করেছিল। প্রাচীরচিত্রে তাঁর ছিল অদম্য আগ্রহ।
মৃত্যু | Nandalal Basu's Death
বিশ্ব বরেণ্য চিত্রকর নন্দলাল বসু ১৯৬৬ সালের ১৬ই এপ্রিল ৭৯ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
উপসংহার | Colnclusion
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পভাবনায় দীক্ষিত হলেও নন্দলাল বসুর শিল্পকর্মে ছিল স্বকীয়তা ও স্বতন্ত্র ।তাঁর ছবিতে যেমন পুরাণের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে ঠিক তেমনি উঠে এসেছে আশেপাশের মানুষ ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য।
বিংশ শতাব্দীর বাঙালির চিত্রকলা চর্চার অন্যতম পুরোধা প্রবাদপ্রতিম চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু একজন কিংবদন্তি হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions
নন্দলাল বসু কবে জন্মগ্রহণ করেন ?
নন্দলাল বসু ১৮৮২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠের চিত্রাঙ্কন কে করেছিলেন ?
নন্দলাল বসু।
নন্দলাল বসু প্রথম জীবনে কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কোন ধরনের চিত্রশৈলীর প্রতি নন্দলাল বসুর বেশি আগ্রহ ছিল ?
প্রাচীর চিত্র
নন্দলাল বসু তাঁর চিত্রশিল্পের জন্য কীভাবে সম্মানিত হয়েছিলেন?
নন্দলাল বসু ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী থেকে দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত হন। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে ভারত সরকারের দ্বারা পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ও তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে এই মহান চিত্রশিল্পী ললিত কলা একাডেমির দ্বিতীয় ফেলো নির্বাচিত হনI
- Related topics -
- জীবন ও জীবনী
- জীবনী সাহিত্য
- নন্দলাল বসু
- চিত্রশিল্পী
- ভারতীয়
Contents ( Show )
- ভূমিকা | Introduction of Nandalal Bose
- জন্ম | Birth of Nandalal Bose
- শিক্ষাজীবন | Education life of Nandalal Bose
- কর্মজীবন | Career of Awards and honors of
- পুরস্কার ও সম্মাননা | Awards and honours of Nandalal Basu
- নন্দলাল বসুর শৈল্পিক নিদর্শন | Nandalal Basu's artistic specimens
- নন্দলাল বসুর অনুপ্রেরণা | Nandalal Basu's inspiration
- মৃত্যু | Nandalal Basu's Death
- উপসংহার | Colnclusion
- প্রশ্নোত্তর ( Frequently Asked Questions )
- পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File