মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জীবনী | Biography of Chandragupta Maurya, the founder of the Maurya Empire

Thursday, May 12 2022, 7:48 am
highlightKey Highlights

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য (সংস্কৃত: चन्द्रगुप्त मौर्य), যিনি গ্রিকদের নিকট সান্দ্রোকোত্তোস বা আন্দ্রাকোত্তাস নামে পরিচিত ছিলেন, (৩৪০ খ্রিস্টপূর্ব-২৯৮ খ্রিষ্টপূর্ব) মৌর্য্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম সম্রাট যিনি বৃহত্তর ভারতের অধিকাংশকে এক শাসনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।


ভূমিকা | Introduction of Chandragupta Maurya

এক সাধারণ তরুণ থেকে যিনি হয়ে উঠেছিলেন এক দুর্দমনীয় রাজা, গড়ে তুলেছিলেন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য মৌর্য সাম্রাজ্য  তিনি হলেন মহা পরাক্রমশালী বীর  এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ৩৪০ খ্রিস্টপূর্ব-২৯৮ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত । তিনি গ্রিকদের কাছে সান্দ্রোকোত্তোস বা আন্দ্রাকোত্তাস নামে সুপরিচিত ছিলেন। যে শক্তিশালী নন্দরাজের মুখোমুখি হতে স্বয়ং আলেকজান্ডারের সৈন্যরাও সাহস পায়নি সেই নন্দরাজ এই অসীম সাহসী তরুণের কাছে পরাজিত হয়ে মগধ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য   মগজের মুকুট নিজের মাথায় পরিধান করেন। সম্রাট হওয়ার পর সর্বপ্রথম তিনিই  বৃহত্তর ভারতের অধিকাংশ রাজ্যকে   এক শাসনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুদীর্ঘ  ২৩ বছর ধরে সাফল্যের সাথে শাসন করার পর, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সমস্ত দুনিয়ার আনন্দ ছেড়ে দেন এবং নিজেকে একজন জৈন সন্ন্যাসী রূপে পরিণত করেন এবং কথিত আছে যে পরবর্তীকালে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন শেষ করেছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

চন্দ্রগুপ্তের পূর্বপুরুষ সম্পর্কীয় তথ্য ও তাঁর  কৈশোর সম্পর্কীয় বিস্তারিত ভাবে  কিছু জানা যায় না   । বিভিন্ন ধ্রুপদী সংস্কৃত, গ্রিক ও লাতিন সাহিত্য সম্ভার  ও ঐতিহাসিক রচনা থেকে কিছু তথ্য প্রাপ্ত হয়েছে এই বিষয়ে ।সংস্কৃত নাটক 'মুদ্রারাক্ষসে' চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে  নন্দন্বয় বা নন্দের বংশধর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। একাংশ ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে তিনি নন্দ রাজকন্যা এবং তার দাসী মুরা র অবৈধ সন্তান ছিলেন। অন্যরা বিশ্বাস করে যে চন্দ্রগুপ্ত মুরিয়াসের অন্তর্গত ছিলেন, যিনি পিম্পলভীনার এক ক্ষুদ্র পুরাতন প্রজাতন্ত্রের ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা) বংশধর, রুমিন্দী (নেপালি তরাই) এবং কাসিয়ার (উত্তর প্রদেশের গোরখপুর জেলা) মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত। এছাড়াও ভিন্ন দুটি  মতামত ইঙ্গিত দেয় যে তিনি মুরস (বা মোর) বা ইন্দো-সিথিয়ান বংশের ক্ষত্রিয় ছিলেন। । বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে মোরিয় নামক এক ক্ষত্রিয় বংশের সন্তানহিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাপরিনিব্বাণ সুত্ত অনুযায়ী, মোরিয়রা  ছিলেন উত্তর ভারতের পিপ্পলিবনের ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এক সম্প্রদায়। মহাবংশটীকা অনুসারে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে  শাক্য ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত  আছে বলে বর্ণিত  করা হয়েছে। কিছু   পৌরাণিক কাহিনীর বর্ণনা অনুযায়ী তিনি একটি পৌত্তলিক পরিবার দ্বারা উত্থাপিত হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয় এবং পরবর্তীকালে চাণক্য   তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন , যিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে  প্রশাসনের নিয়ম এবং এক সফল সম্রাট হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দান করেছিলেন বলে কথিত আছে।

প্রাথমিক জীবন | Chandragupta Maurya’s early life

চন্দ্রগুপ্ত আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন।  পিতার মৃত্যুর পর, তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে   পাটালিপুত্রে আসেন।  কথিত আছে  শৈশবে তাঁর মা তাঁর দেখাশোনার দায়িত্বভার এক গো-পালককেপ্রদান করেছিলেন । কিন্তু এই গো-পালক পরবর্তীকালে  চন্দ্রগুপ্তকে এক শিকারীর কাছে বিক্রয় করেন এবং পর্যায়ক্রমে  সেই শিকারীটিও তাঁকে গো-চারণে নিযুক্ত করেন। সময়ের সাথে সাথে চন্দ্রগুপ্ত স্থানীয় রাখাল বালকদের নেতা হয়ে ওঠেন। সেই সময় তক্ষশীলাবাসী চাণক্য (কৌটিল্য), চন্দ্রগুপ্তের অবয়বে  রাজ-সদৃশ চিহ্ন পরিলক্ষিত করে সেই  শিকারীর কাছ থেকে চন্দ্রগুপ্তকে ক্রয় করেছিলেন বলে জানা যায়। এরপর চাণক্য তাঁকে তক্ষশীলায় নিয়ে এলে বালক চন্দ্রগুপ্তকে রাষ্ট্রবিদ্যা এবং সমরবিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলেন ও পরবর্তীকালে   উচ্চশিক্ষার্থে  তাঁকে পাটালিপুত্রে পাঠান  ।এই সময় পাটালিপুত্রের রাজা ছিলেন নন্দরাজ ধননন্দ যিনি ছিলেন এক অত্যন্ত অত্যাচারী রাজা।  পরবর্তীকালে চন্দ্রগুপ্ত  এবং চাণক্য দুইজন মিলে নন্দ সম্রাট ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। 

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা | Chandragupta Maurya, the founder of the Maurya Empire

পাটালিপুত্রের অধিবাসীরা নন্দরাজ, অত্যাচারী   ধননন্দের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন। ঠিক সেই সময় আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন।  খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে আলেকজান্ডার ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন ও খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে তিনি সিন্ধু নদ অতিক্রম করে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন। চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে উৎখাত করার  উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রিকদের সাহায্য পাওয়ার লক্ষ্যে আলেকজান্ডারের শিবিরে যান। চন্দ্রগুপ্তের উদ্ধত ব্যবহার আলেকজান্ডারকে ক্ষুব্ধ করে এবং তিনি  চন্দ্রগুপ্তকে মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান করে থাকেন। চন্দ্রগুপ্ত  কৌশলে  গ্রিক সৈন্যদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বিন্ধ্যাপর্বতের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই সময় নন্দরাজ কর্তৃক অপমানিত হয়ে চাণক্য ও সেই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং পর্যায়ক্রমে এই বনে চাণক্য এবং চন্দ্রগুপ্তের সাক্ষাত্ হওয়ার পর, উভয়ই নন্দরাজের পতনের লক্ষ্যে একমত হন। চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্লুতার্কের বর্ণনানুযায়ী, বিতস্তা নদীর যুদ্ধের সময়কালে নন্দ সাম্রাজ্যের ২,০০,০০০ পদাতিক, ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ৮,০০০ রথারোহী এবং ৬,০০০ যুদ্ধহস্তী উপস্থিত ছিল। 

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

কথিত আছে যে  সেই বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনীর কথা শ্রবণ করে   আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী ভারতে অগ্রসর না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।'চন্দ্রগুপ্তকথা' নামক গ্রন্থানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যের সেনাবাহিনী প্রথমে নন্দ সাম্রাজ্যের কর্তৃক পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু  পরবর্তী বেশ কিছু যুদ্ধে  চন্দ্রগুপ্ত , ধননন্দ ও তার সেনাপতি ভদ্রশালাকে পরাজিত করেন ও অবশেষে পাটলিপুত্র নগরী অবরোধ করতে সক্ষম হন॥চন্দ্রগুপ্ত ৩২১ খ্রিটপূর্বাব্দে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে গোটা নন্দ সাম্রাজ্য অধিকার করেন। বিশাখদত্ত রচিত 'মুদ্রারাক্ষস' নাটকে ও জৈন গ্রন্থ 'পরিশিষ্টপার্বণ' গ্রন্থে হিমালয়ের একটি পার্বত্য রাজ্যের রাজা পর্বতেশ্বর বা পর্বতকের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের মিত্রতার কথা বর্ণনা করা আছে।  ঐতিহাসিকদের  মতে আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগ করার পর, যে গ্রিক সৈন্যরা ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল  অঞ্চলে  শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা চন্দ্রগুপ্তকে এই যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন । কথিত আছে এই যুদ্ধে ১০ হাজার হাতি, ১ লক্ষ অশ্বারোহী এবং ৫ হাজার রথচালক নিহত হয়েছিল। আনুমানিক ৩২৪-৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে পরাজিত করে রাজত্ব লাভ করেছিলেন। মহাবংশ-টীকা গ্রন্থ অনুসারে  নন্দরাজ  সেই যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন।  আবার অন্যমতে চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে কিছু সামান্য আসবাবপত্র ও তাঁর পরিবার পরিজনসহ প্রদান করে পাটালিপুত্র থেকে বিতারিত করেছিলেন।

সিংহাসন আরোহণ | Ascend the throne of Chandragupta Maurya

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সিংহাসন লাভের সময় নিয়ে নানা মতভেদ বর্তমান। যে  বিভিন্ন মতগুলো পাওয়া যায় তা হলো―

খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৩ অব্দ [কারপেন্টার];খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৮ অব্দ (সেইন্ট) ;খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০ অব্দ [ফ্লিট]; খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ অব্দ [স্মিথ]; খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দ [রাধাকমল মুখার্জি] ; খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৫ অব্দ (কানিংহাম, জয়স্বাল)।

সিংহাসন আরোহণ 
সিংহাসন আরোহণ 

সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ | Expansion of the empire by Chandragupta Maurya

(মেসিডোনিয়ার সত্রপ রাজ্য অধিকার) নন্দরাজকে পরাজিত করে চন্দ্রগুপ্ত নিজের সাম্রাজ্য প্রভূতভাবে বিস্তার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং   উত্তরভারতে গ্রিক সৈন্যদের উৎখাত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সাত জন সেনাপতি নিজেদের মধ্যে রাজ্য ভাগ করে নিয়েছিল এবং ভারতবর্ষ পড়েছিল সেনাপতি প্রথম সেলুকাস  নিকেটারের ভাগ্যে। মূলত   ব্যাক্ট্রিয়া ও সিন্ধু নদ পর্য্যন্ত বিস্তৃত  সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশ সেনাপতি প্রথম সেলুকাস নিকেটরের অধিকারে আসে। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। জানা যায় যেএই সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে প্রথম সেলুকাস নিকেটর চন্দ্রগুপ্তকে   আরাখোশিয়া, গেদ্রোসিয়া ও পারোপামিসাদাই ইত্যাদি সিন্ধু নদের পশ্চিমদিকের বিশাল অঞ্চল অঞ্চল সমর্পণ করেছিলেন এবং নিজ কন্যা হেলেনা কে তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

Expansion of the empire by Chandragupta Maurya
Expansion of the empire by Chandragupta Maurya

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করার পর প্রথম সেলুকাস নিকেটর পশ্চিমদিকে প্রথম আন্তিগোনোস মোনোফথালমোসের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন। সেইসময়ে চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে  ৫০০টি যুদ্ধ-হস্তী দিয়ে সাহায্য করেছিলেন যা ইপসাসের যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল এবং সেলুকাসের জয়লাভের পথকে প্রশস্ত করেছিল। এরপর চন্দ্রগুপ্ত তাঁর সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ম্যাসিডনীয় সত্রপ রাজ্যগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধু নদ উপত্যকা অঞ্চলের শাসক ইউদেমোস ও পাইথনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন বলে প্রতীত করা হয়। রোমান ঐতিহাসিক মার্কাস জুনিয়ানিয়াস জাস্টিনাসের বর্ণনা অনুযায়ী  চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ম্যাসিডনীয় সত্রপগুলি অধিকার করেছিলেন।

চন্দ্রগুপ্তের  দাক্ষিণাত্য অভিযান | The Deccan Expedition of Chandragupta Maurya

সাম্রাজ্যের অধিক বিস্তারের উদ্দেশ্যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দক্ষিণ ভারতের দিকে অগ্রসর হন।  বিন্ধ্য পর্বত পার হয়ে দাক্ষিণাত্য মালভূমির সিংহভাগ নিজের দখলে আনতে সক্ষম হন । ফল স্বরূপ   কলিঙ্গ ও দাক্ষিণাত্যের  সামান্য  কিছু অংশবিশেষ  বাদে সমগ্র ভারতবর্ষেই বলতে গেলে  মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর থেকে বড় সাম্রাজ্য আর গড়ে ওঠেনি ।  শিক্ষক চাণক্যই ছিলেন রাজা চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী। মেগাস্থিনিসের ,'ইন্ডিকা' তে উল্লেখ আছে  যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রায় চার লক্ষ সৈন্য বর্তমান ছিল । মৌর্য্য সেনাবাহিনী দ্বারা দাক্ষিণাত্য আক্রমণের বিস্তারিত ঘটনাটি উল্লিখিত   আছে  সঙ্গম সাহিত্যের বিখ্যাত তামিল কবি মমুলনার বর্ণনায়।

চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে সাম্রাজ্যের বিস্তার | Expansion of empire during the reign of Chandragupta

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য   তামিল ও কলিঙ্গ অঞ্চল ব্যতিরেকে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ স্থানেই তাঁর রাজত্ব  স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্বে বাংলা থেকে শুরু করে  পশ্চিমে আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান, উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য মালভূমি অবধি তাঁর সুবিশাল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল  যা ভারতীয় ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।

মৌর্য প্রশাসন | Maurya Administration

পাটলিপুত্র আবিষ্কার
পাটলিপুত্র আবিষ্কার

চাণক্যের পরামর্শ অনুযায়ী  চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর সাম্রাজ্যকে চার প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। তিনি একটি উচ্চতর কেন্দ্রীয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে তার রাজধানী পাটালিপুত্র অবস্থিত ছিল।  বিভিন্ন প্রদেশের জন্য বিভিন্ন  প্রতিনিধিদের নিয়োগ করা হত যারা তাদের নিজ নিজ প্রদেশ পরিচালনা করে থাকত । এটি একটি অত্যাধুনিক প্রশাসন ছিল যা চাণক্যের  গ্রন্থ অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত আছে। এছাড়াও  চন্দ্রগুপ্ত ও তার প্রধান পরামর্শদাতা চাণক্য  কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করেছিলেন। চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে চন্দ্রগুপ্ত একটী শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়ে তুলেছিলেন।  সামরিক ব্যবস্থা , উন্নত পৌর প্রশাসন এবং গুপ্তচর ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তিনি এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিলেন । অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ও কৃষির  ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছিল। মৌর্য  সাম্রাজ্যের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ফলস্বরূপ একটি সুদৃঢ়  অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। 

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উপাধি সমূহ | Titles of Chandragupta Maurya

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জীবদ্দশায় অনেক উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাদের  মধ্যে অন্যতম হলো ‘চন্দ্রশ্রী’, ‘প্রিয়দর্শন’ ও ‘ভ্রিশাল’। ‘ভ্রিশাল’ অর্থ হলো শুদ্রের সন্তান। 

চাণক্যের বাণী
চাণক্যের বাণী

পারিবারিক জীবন | Chandragupta Maurya’s family

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের  তিনজন স্ত্রী ছিলেন- মহাপদ্ম নন্দের মেয়ে নন্দিনী, গ্রীক বংশোদ্ভূত সেলিউকাসের মেয়ে হেলেনা ও দুর্ধরা। দুর্ধরার গর্ভেই তাঁর একমাত্র পুত্র  বিন্দুসারের জন্ম হয়। তার আগে  দুর্ধরার গর্ভে কেষ্ণক নামক আরেকটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে  জন্মের তিন দিনের মধ্যে সেই শিশুপুত্রটি মারা যায়। পরবর্তীকালে  চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৃত্যুর পর এবং  বিন্দুসারের রাজত্বকাল শেষ হওয়ার পর  বিন্দুসারের পুত্র  হন মৌর্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট,  সম্রাট অশোক।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৃত্যু | Chandragupta Maurya's death

কিম্বদন্তী আছে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য  জৈন আচার্য্য ভদ্রবাহুর কাছে  আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন ও পরবর্তীকালে বিয়াল্লিশ বছর বয়সে সিংহাসন ত্যাগ করেন ও জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন।একই সময় তিনি ভদ্রবাহুর সাথে   দাক্ষিণাত্য যাত্রা করেন।জৈন  ধর্মের অনুশাসন অনুসারে তিনি তাঁর পুত্র বিন্দুসারের কাছে রাজ্য সমর্পণ করেন । আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮-২৯৫ অব্দের দিকে বর্তমানে‌ কর্ণাটকের শ্রাবণবেলগোলায়  তিনি স্বেচ্ছায় উপবাসে রত হন   এবং  দেহত্যাগ করেন।

Chandragupta Maurya’s family
Chandragupta Maurya’s family

উপসংহার  | Conclusion

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন এক বিজয়ী বীর।`শুধুমাত্র রাজ্যজয় নয় সুশাসন প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এক বৃহৎ সাম্রাজ্যে সুনিয়ন্ত্রিত অথচ  বিকেন্দ্রীকৃত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের  এক অনন্য কীর্তি। কৌটিল্য  তাঁর 'অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থে চন্দ্রগুপ্তের শাসনব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রজাদের প্রতি যত্নবান,ন্যায় পরায়ণতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা  চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে ইতিহাসের সিংহাসনে এক উচ্চ শিখরে বসিয়েছিল।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File