Bankim Chandra Chattopadhyay | বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কেবলমাত্র সাহিত্যিক বা লেখক নন, উপরন্তু তিনি যুগস্রষ্টা!
বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Bankim Chandra Chattopadhyay)। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তাঁর অসীম অবদানের জন্যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি চিরকাল অমর। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র ‘বঙ্গদর্শন’-র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সাধারণত প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ্য করা হয় বঙ্কিম চন্দ্রকে (Bankim Chandra)। বাঙালির অন্যতম এই ঔপন্যাসিকের সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল হুগলি কলেজে পড়ার সময়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ললিতা ও মানস’।
বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Bankim Chandra Chattopadhyay)। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তাঁর অসীম অবদানের জন্যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি চিরকাল অমর। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র ‘বঙ্গদর্শন’-র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সাধারণত প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ্য করা হয় বঙ্কিম চন্দ্রকে (Bankim Chandra)। বাঙালির অন্যতম এই ঔপন্যাসিকের সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল হুগলি কলেজে পড়ার সময়। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য লিখতে শুরু করেন বঙ্কিমচন্দ্র। মাত্র ১৮ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ললিতা ও মানস’।
১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬সে জুন বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্কিম চন্দ্র (Bankim Chandra)। তাঁর আদিনিবাস ছিলো হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। তাঁর পিতা যাদবচন্দ্র ওই বছর অবিভক্ত বাংলার মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হন। ফলে বাড়িতেই গ্রাম্য পাঠশালায় গুরুমশাইয়ের কাছে কয়েক মাস লেখাপড়ার পরে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুর জেলার ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। পরে তিনি কাঁঠালপাড়ায় এসে হুগলি কলেজে ভর্তি হন এবং ওই বছর তাঁর বিয়ে হয়। তবে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হলে তিনি আবার বিয়ে করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের তিন কন্যা সন্তান হয়।
ছেলেবেলা থেকেই বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Bankim Chandra Chattopadhyay) ছিলেন মেধাবী। কাঁঠালপাড়ায় চতুষ্পাষ্ঠীতে তিনি সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করেন, সঙ্গে চলতো বাংলা ভাষার চর্চাও। বঙ্কিম ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি কলেজে (অধুনা হুগলী মহসিন কলেজ) ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র আইন পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। পিতার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কম্প্যানিয়ন অব দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব।
১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন সেই সময় শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকার ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি অল্প বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়।
চব্বিশ পরগনা জেলার বারুইপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকা অবস্থায় বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই (Bankim Chandra Chatterjee Books) হিসেবে প্রথম দুটি বিখ্যাত উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী ও কপালকুণ্ডলা প্রকাশ পায়। এরপর ১৮৮৭ সালের মধ্যে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই (Bankim Chandra Chatterjee Books) হিসেবে প্রকাশ পায় মোট চৌদ্দটি উপন্যাস। এর আগে বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা উপন্যাস বলতে ছিল কয়েকটা সংস্কৃত নাটক ও গল্প এবং কিছু ফারসি ও আরবি গল্পের অনুবাদ। উল্লেখ্য, ১৮৮০ থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের রাজনীতি ও ধর্মের প্রতি অনুরাগ জন্মাতে থাকে। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি শেষ লেখা লেখেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৩৪। ১৫ বছর বয়সে তিনি দু’টি ছোট কাব্য রচনা করেন। তিন বছর পরে ওই দু’টি কাব্য ললিতা-পুরাকালিক গল্প তথা মানস নামে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি ভাষায় দক্ষ বঙ্কিমচন্দ্র খুলনায় ‘Rajmohan’s Wife’ নামে এক ইংরেজি উপন্যাস রচনা করেন। বাঙালির রোমান্টিক সত্তার এক নতুন জাগরণ ঘটে বঙ্কিমচন্দ্রের তিনটি রচনার মধ্য দিয়ে — ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, এবং ‘মৃণালিনী’। মাসিকপত্র বঙ্গদর্শনে তিনি পরপর ‘বিষবৃক্ষ’, ‘ইন্দিরা’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’ ইত্যাদি উপন্যাসের সঙ্গে নানা বিষয়ে নানা প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, যথা ‘লোকরহস্য’, ‘বিজ্ঞানরহস্য’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘সাম্য’ প্রভৃতি। বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যযুগের রচনায় দেখা যায়—সৌন্দর্য ও লোকশিক্ষার মিলন। শেষ যুগে লোকশিক্ষার প্রাধান্য। প্রতিভার শেষ ধাপে প্রকাশিত পত্রিকা হলো ‘নবজীবন’ ও ‘প্রচার’। এই যুগের প্রধান উপন্যাস রাজসিংহ (১৮৮২), আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরানী (১৮৮৩), সীতারাম (১৮৮৭)। দেবী চৌধুরানী আংশিকভাবে প্রকাশিত হয় বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। ‘সীতারাম’, ‘প্রচারে’ প্রকাশিত হয়। তাঁর অনেক উপন্যাসই তিনি বারবার নতুন ভাবে লিখেছেন বা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন। দৃষ্টান্ত হল ‘ইন্দিরা’, ‘রাজসিংহ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার শেষ পর্যায় পূর্ণভাবে প্রকাশ পায় স্বাদেশিকতা ও অনুশীলন ধর্মের ব্যাখ্যা। ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’র নায়ক নেশাখোর কমলাকান্তের মুখে মাতৃপ্রেমের প্রথম প্রকাশ ‘আনন্দমঠের’ ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পায়। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সব উপন্যাসই ইংরেজি, জার্মান, হিন্দি, কানাড়া, তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তাঁর উপন্যাসগুলির নাট্যরূপ সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চে অভিনীত ও সিনেমাতেও রূপায়িত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র কেবলমাত্র সাহিত্যিক বা লেখক নন, উপরন্তু তিনি যুগস্রষ্টা। বঙ্কিমচন্দ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তুলতে প্রবন্ধ ও গ্রন্থে ‘বন্দে মাতরম্’, ‘মাতৃভূমি’, ‘জন্মভূমি’, ‘স্বরাজ’, ‘মন্ত্র’ প্রভৃতি নতুন স্লোগানও তৈরি করেন। বাংলা আধুনিক গদ্যশৈলীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণ্য করা হয় প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রকে।