Aurora in India | ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি থেকে লাদাখ! অন্ধকার আকাশে অরোরার রংবেরঙের খেলা! তবু কেন উদ্বেগ বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে?দেখুন ভিডিও!

ভারতে বসেই নর্দার্ন লাইটের বা অরোরার জৌলুসের সাক্ষী রইল অনেকেই। আর এর নেপথ্যে রয়েছে সৌরঝড়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০০৩ সালের পর এমন সৌরঝড় আর দ্বিতীয়বার হয়নি।
রাতের আকাশ অন্ধকার নয়, যেন রঙের মেলা! সম্প্রতি সৌরঝড়ের কারণে অপূর্ব আলোকছটায় ভরে গিয়েছিল মেরু প্রদেশের আকাশ। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে সেই মেরুপ্রভা দেখে বাকরুদ্ধ গোটা পৃথিবী। এমনকি ভারতেও অরোরা (Aurora in India) এর দেখা মিলেছে। খাস স্বর্গতুলোনীয় লাদাখে দেখা মিললো মেরুজ্যোতি’র খেলার। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০০৩ সালের পর এমন সৌরঝড় আর দ্বিতীয়বার হয়নি। তবে কেন বিদেশের বিভিন্ন অংশ-সহ ভারতে অরোরা বোরিয়ালিস (Aurora Borealis in India) এর দেখা মিললো? কেনই বা দেখা মেলে অরোরা বোরিয়ালিসের? সৌরঝড় নিয়েই কি চিন্তিত হওয়া দরকার?

কোথায় দেখা মিললো অরোরা?
শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ কেমব্রিজ, গোটা ব্রিটেন জুড়ে মায়া ছড়ায় অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দান লাইটস। বাদ যায়নি ইতালি, জার্মানিও। এছাড়া শনিবার ভারতে অরোরা বোরিয়ালিস (Aurora Borealis in India) দেখা গিয়েছে। সেদিন মধ্যবর্তী সময়ে গভীর রাতে লাদাখের আকাশ থেকে লাল রঙের অরোরা আলোগুলো দেখা গিয়েছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, বেঙ্গালুরু (IIA) এর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা লাদাখের হ্যানলেতে ইন্ডিয়ান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি (IAO)-এর চারপাশে থাকা অল-স্কাই ক্যামেরার মাধ্যমে অরোরা দেখেছেন। আইআইএ মালিকানাধীন এবং পরিচালিত, আইএও-এর ক্যামেরাগুলো লাগাতার আকাশের ছবি তুলতে সক্ষম। শনিবার মধ্যরাত থেকে গোধূলির মধ্যে এই ছবি তোলা হয়েছে। এরপর শনিবার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
অরোরা আসলে কী?
অরোরাস নামে পরিচিত এই আলোগুলো সাধারণত উচ্চ-অক্ষাংশ অঞ্চল, অর্থাৎ উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু থেকে দেখা যায়। উত্তর মেরুতে দেখা গেলে, তাকে বলা হয়- অরোরা বোরিয়ালিস। আর দক্ষিণ থেকে দেখা গেলে বলা হয়, অরোরা অস্ট্রালিস। সৌরঝড় থেকে উৎপন্ন চার্জড পর্টিকেল, যেগুলো মূলত ইলেকট্রন এবং প্রোটন, পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে দুই মেরুতেই আকর্ষিত হয়। এসব চার্জড পার্টিকেলের সাথে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংঘর্ষ হয়। এর ফলে বায়ুমন্ডলের গ্যাসীয় পরমাণুগুলো উদ্দীপিত হয়ে রঙিন আলো বিকিরণ করে। এটাই হলো আরোরার আলোর উৎস। সাধারণত অরোরার আলো সবুজ রঙের হয়। বায়ুমণ্ডলের ৬০ থেকে ১৫০ মাইল উচ্চতায় অবস্থিত অক্সিজেনের সাথে সূর্য থেকে ছুটে আসা প্রচন্ড গতির চার্জড পার্টিকেলের সংঘর্ষের ফলে এই সবুজ আলোর সৃষ্টি হয়। তবে অরোরার আলোর রং সবুজ না হয়ে বেগুনি বা নীল রংয়েরও হতে পারে। নাইট্রোজেন গ্যাসের সাথে সংঘর্ষের ফলে বেগুনি বা নীল অরোরার সৃষ্টি হয়। বেগুনি বা নীল রঙের অরোরা সাধারণত বায়ুমণ্ডলের ৬০ মাইলের নিচে সৃষ্টি হয়। প্রধানত উত্তর আমেরিকার আলাস্কা, ক্যানাডার উত্তরাঞ্চল, ইউরোপের আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এসব দেশ থেকে অরোরা বোরিয়ালিস দেখা যায়।
কেন দেখা যাচ্ছে অরোরা?
সূর্যের অভ্যন্তরের সৌরঝড়ের পরিমাণ যখন বৃদ্ধি পায় তখন পৃথিবীর দুই মেরুতে অরোরার আলো বেশি দেখা যায়। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত ৯ মে সৌরপৃষ্ঠে একটি বিশাল ঝড়ের আভাস পাওয়া গেছে। এর ফলে আগামী কয়েক দিন পৃথিবীর দুই মেরুতেই অরোরা বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যেই আমেরিকার অনেক স্টেট এবং অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ অঞ্চল থেকে অরোরা দেখা যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, আসলে ২০০৩ সালের পর তীব্রতম সৌরঝড় আছড়ে পড়েছে পৃথিবীতে। সৌর কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন প্লাজমার অতি তীব্র চার্জড কণার স্রোত পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সংস্পর্শে এলে আধান-এর ধাক্কাধাক্কিতে সম্ভাবনা তৈরি হয় এই অরোরার। মেরু অঞ্চলে এই ঝড় পৌঁছলে, বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে থাকা গ্যাসীয় অণুর সঙ্গে রাসায়নিক ক্রিয়া করে সৌর কণা, তৈরি হয় মেরুজ্যোতির। যত তীব্র থাকে কণার গতি ও আধান, তত উজ্জ্বল হয় মেরুজ্যোতি, দাবি বিশেষজ্ঞদের। সৌর বিজ্ঞানীদের দাবি, ১১ বছর অন্তর তীব্রতা শিখরে ওঠে সূর্যের অন্দরে। এবার যা ২০২৫ এ উঠবে। তারই ফলে এদিক ওদিক দেখা যাচ্ছে অরোরা।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (IISER) কলকাতার সেন্টার অফ এক্সিলেন্স ইন স্পেস সায়েন্স ইন্ডিয়ার সৌর পদার্থবিদরা বলেছেন যে, শুক্রবার এবং শনিবারের মধ্যে অন্তত চারটি শক্তিশালী সৌরঝড় পৃথিবীতে এসেছে। এই ঝড়ের উৎস ছিল করোনাল ম্যাস ইজেকশনস (CMEs)। যা সূর্যের করোনা থেকে চুম্বকীয় কণা এবং প্লাজমার বৃহৎ নির্গমন। এই সিএমইগুলো বর্তমানে সূর্যের ওপর একটি সক্রিয় অঞ্চল, এআর১৩৬৬৪ (AR13664) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এই সৌরঝড়গুলো ৭০০ কিমি/সেকেন্ড গতিতে ১০ এবং ১১ মে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছেছিল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সৌরঝড়ের মিথস্ক্রিয়ার জেরে ওই লাল, বেগুনি এবং নীল রঙে অরোরার আবির্ভাব হয়েছিল। যার ফলে ভারতে অরোরা (Aurora in India) অর্থাৎ লাদাখে অরোরা দেখা গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে একই তীব্রতার একটি সৌরঝড় এর আগে ২০০৩ সালের নভেম্বরেও পৃথিবীকে প্রভাবিত করেছিল।

বর্তমানে, দৃশ্যমান সৌরডিস্কে বেশ কয়েকটি চৌম্বকীয়ভাবে সক্রিয় অঞ্চল আছে। যা একাধিক উচ্চশক্তির শিখা তৈরি করে। যার জেরে বিজ্ঞানীরা সিএমইগুলোর একটি সিরিজ ১২ মে পর্যন্ত পৃথিবীর দিকে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। এই ক্রমাগত সৌর ঝড়গুলো মহাকাশের আবহাওয়াকে বিঘ্নিত করে। পৃথিবীর চুম্বকমণ্ডলে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটায়। যা পরবর্তী দুই দিন স্থায়ী হয় বলেই বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত, তীব্র সৌরঝড় ক্ষতিকারক হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, তারা নিম্ন আর্থ অরবিট বা এলইও (LEO)-র ২০০ থেকে ১,৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে উচ্চতাতে কাজ করা স্যাটেলাইটগুলোর মসৃণ ক্রিয়াকলাপে হস্তক্ষেপ করতে পারে। হুমকিদায়ক হতে পারে। এলইও থেকে কাজ করা সবচেয়ে সাধারণ উপগ্রহগুলো একাধিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। যেমন- নেভিগেশন, সামরিক, বুদ্ধিমত্তা, যোগাযোগ ইত্যাদি। যার ফলে সৌরঝড়, পৃথিবীর উপগ্রহ-ভিত্তিক জিপিএস, নেভিগেশন সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতি করতে পারে। এই সৌরঝড় দ্বারা সৃষ্ট অত্যন্ত শক্তিশালী কণা পরিবেশের ওপরের বায়ুমণ্ডলের উত্তাপকেও প্রভাবিত করতে পারে। এটি বিকিরণ বিপত্তির ঝুঁকি বাড়ায়। যার প্রভাব পড়তে পারে এলইও-তে অবস্থানরত উপগ্রহগুলোর ওপর। যাতে স্যাটেলাইটগুলো পর্যন্ত জ্বলে যেতে পারে।