Women Freedom Fighters | দুর্দমনীয় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন যেসব ডানপিটে নারীরা, স্বাধীনতা দিবসে চলুন জানি তাঁদের ডানপিটেমির প্রাক্-কথন

ভারতবর্ষ আজ স্বাধীন। কত অজানা, অচেনা 'বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা ' এই স্বাধীনতা তাঁর খবর কজন রাখেন! আজ, ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসে আমরা এমনই কিছু নারীদের নির্ভীকতার গল্প শুনবো যারা মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ব্রিটিশ বোমার সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। নিজের স্বামী সন্তানকে নির্ভয়ে পাঠিয়েছিলেন সম্মুখ সমরে। দেশের জন্যে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষ আজ স্বাধীন। কত অজানা, অচেনা 'বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা ' এই স্বাধীনতা তাঁর খবর কজন রাখেন! আজ, ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসে আমরা এমনই কিছু নারীদের নির্ভীকতার গল্প শুনবো যারা মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ব্রিটিশ বোমার সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। নিজের স্বামী সন্তানকে নির্ভয়ে পাঠিয়েছিলেন সম্মুখ সমরে। দেশের জন্যে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন।

বাংলার একমাত্র মহিলা স্টেট-প্রিজনার ননীবালা দেবী:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন প্রায় শেষের পথে। ১৯১৮ সাল নাগাদ কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে আসা হল এক বিধবা মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীকে। তাঁর অপরাধ একাধিক। তিনি বিপ্লবীদের গোপন তথ্য পাচার করেছেন, পুলিশকে সহায়তা তো করেনইনি উপরন্তু পুলিশি জেরায় চরম অসহযোগিতা করেছেন। তাঁর মুখ থেকে কথা বার করাবার জন্যে চললো অকথ্য অত্যাচার। ফল হলো সম্পূর্ণ বিপরীত। জেলে খাওয়াদাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলেন তিনি। অনুরোধ, উপরোধ, ভয় দেখানো কোনোটাতেই কাজ হলো না।

সেসময় প্রেসিডেন্সি জেলের আই. বি. পুলিসের স্পেশাল সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন গোল্ডি সাহেব। প্রতিদিন সকালে পুলিশের দফতর ইলিসিয়াম রোতে ননীবালাদেবীকে জেরা করতেন তিনি। একদিন জেরার সময়ে গোল্ডি সাহেব ননীবালাকে দেখে বেশ ধমক দিয়েই বললেন, 'আপনাকে এখানে এই জেলেই থাকতে হবে, তাই বলুন কী করলে খাবেন?'। ননীবালা তাঁর উত্তরে এক অদ্ভুত শর্ত রাখলেন। তিনি জানালেন তাঁকে বাগবাজারে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের স্ত্রী সারদা মায়ের কাছে রেখে আসলে তিনি খাবেন। গোল্ডি বললেন, দরখাস্ত লিখে দিতে। ননীবালাদেবী দরখাস্ত লিখে হাতে দিতেই গোল্ডি সেটাকে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। মুহূর্তে ক্ষিপ্ত বাঘিনির মতো লাফিয়ে উঠে এক চড় বসিয়ে দিলেন গোল্ডির মুখে। চিৎকার করে ওঠেন, "ছিঁড়ে ফেলবে তো আমায় দরখাস্ত লিখতে বলেছিলে কেন? আমাদের দেশের মানুষের কোনও মান সম্মান থাকতে নেই?"
১৮১৮ সালের ৩ নং রেগুলেশনে ননীবালাদেবীই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা স্টেট প্রিজনার।
দুকড়িবালা দেবী:
অসামান্যা ননীবালার তেজ দেখে গোল্ডি সাহেব তাঁকে আর ঘাঁটাননি। এদিকে জেলের মধ্যে একটানা অনশন চলছে। এই অনশন কালে প্রেসিডেন্সি জেলেই ননীবালা দেবীর সঙ্গে আলাপ হয় দুকড়িবালা দেবীর। দুকড়িবালা দেবীর কাছে তিনি জানতে পারেন, সিউড়িতে তাদের বাড়ীতে সাতটা মসার পিস্তল পাওয়া গিয়েছিল। কে এই পিস্তল রেখে গিয়েছিল তা শত জেরাতেও জানায়নি গ্রামের বৌ দুকড়িবালা। এই অপরাধেই তাঁর দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। শাস্তি হিসেবে প্রতিদিন আধমণ ডাল ভাঙতে হচ্ছে তাঁকে।

এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট ক্রমাগত ননীবালা দেবীকে উপবাস ভাঙার অনুরোধ করছেন। মতলব স্থির করলেন ননীবালা। একদিন সাহেবের অনুরোধে তিনি জানালেন, রান্না করার জন্যে তাঁর একজন ব্রাহ্মণ কন্যা চাই। রান্নার ঝি হিসেবে তিনি দুকড়িবালাকে চাইতেই সাহেব সম্মত হলেন। এরপরের দু বছর দুজনে একসাথেই জেলে কাটিয়েছিলেন। শত জেরা, শারীরিক নির্যাতনেও মুখ খোলেননি তাঁরা। অসুস্থ পরিবেশে প্রতিদিন আধমণ ডাল ভাঙতে ভাঙতে দুকড়িবালা বাবাকে চিঠি লিখতেন, তিনি ভালোই আছেন, তার জন্য যেন তাঁরা চিন্তা না করেন, শুধু বাচ্ছাদের যেন তাঁরা দেখেন, শিশুরা যেন না কাঁদে। এমনই লৌহকঠিন ছিল সেকালের নারীদের মন। দেশের জন্যে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য হাসিমুখে বলিদান দিতেন অগ্রগামী নারী সৈনিকরা।
ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা:
কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী কংগ্রেসকর্মী পদ্মরাজ জৈন কংগ্রেস আন্দোলনে যোগদান ক'রে তিনবার জেল খেটেছিলেন। নিজের বাড়িতে পর্দাপ্রথা তুলে দিয়েছিলেন পদ্মরাজ। প্রকাশ্যে বিধবা বিবাহের সমর্থন করতেন। জেল খাটা সমাজসেবী বাবাকে দেখেই ছোট্ট ইন্দুমতী দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা পেয়েছিল সন্দেহ নেই। ফলে ১৯৩০ সালে কলকাতায় যখন “নারী সত্যাগ্রহ সমিতি" কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করলো, তখন ইন্দুমতীও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
শোভাযাত্রা চলাকালীন মিছিলের পুরোভাগে জাতীয় পতাকা হাতে অগ্রসর হচ্ছিলেন তিনি। তখন একজন ব্রিটিশ সাজেন্ট তাঁর হাত চেপে ধরে জাতীয় পতাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই নিরুপায় ইন্দুমতী সার্জেন্টের হাতে কামড় বসিয়ে দৈন। সার্জেন্টের হাতের মুঠি শিথিল হয়। ইন্দুমতী পতাকা বাগিয়ে এগিয়ে যান।

তবে এই ঘটনা তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করলো। সাহসী ইন্দুমতী দেখলেন, তাঁর নিজের দেশের লোকেরাই পুলিশের উর্দি পরার সুবাদে দেশে লোককে অকথ্য অত্যাচারে জর্জরিত করছে। ইন্দুমতী স্বনামে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বেআইনি ইস্তেহার ছাপালেন। পুলিশকর্মচারীদের এই মর্মে আবেদন জানালেন যে: “আমরা সব একই ভারতমাতার সন্তান। ভীত ইংরেজ সবকাব যেমন করে হোক আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পিষে মেরে ফেলতে চাইছে। নির্দোষ জনতার উপব তাঁরা অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে। নারীর গায়ে হাত ওঠাতেও তারা দ্বিধা করছে না। কাঁথিতে আমাদেব মা ও ভগ্নীদের উলঙ্গ ক'রে মারপিট চালিয়েছে, তাদের স্তন ধরে ওঠ বোস করাচ্ছে । রাবণও এমন অমানুষিক অত্যাচার করেনি । ভাইসব, এসব দেখেও কি আপনারা এই সরকারের অঙ্গ হয়ে থাকবেন? আমরা কি আপনাদের মা বোন নই? একথা নিশ্চিত যে, বিদেশী সরকারের অন্তিম দিন ঘনিয়ে এসেছে, রাবণের মতো অত্যাচারীর শক্তিও চূর্ণ হ'য়ে গিয়েছিল। এখন শুধু আপনাদের পদত্যাগের অপেক্ষা। বিদেশী শাসকের বল ও শক্তি ত আপনারাই। আজই আপনার চাকবী ছেড়ে দিন, ওরা বিদায় হোক্।"
ইন্দুমতী আরও লিখলেন, “আপনারা ওদের সহায়তা না করলে ওদের হাজার হাওয়াই জাহাজ, হাজার বোমা ব্যর্থ হয়ে যাবে । আপনারা যখন নিজের ভাইয়ের গায়ে লাঠিবর্ষণ করেন তখন আমার গভীর দুঃখ হয়, আমার চোখে জল আসে। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কি এত নীচ কাজ করতে হবে, যার জন্য আপন ভাই, মা, বোনের উপর এমনি ক'রে হাত উঠাতে হবে? আপনাদের উপর আমার বিশ্বাস আছে । খাদ্যসমস্যা যত কঠিনই হোক, আপনারা এই ভারতবর্ষেরই সন্তান। আমরা আপনার্দেরই ভগ্নী, আমরা ও আপনারা একই ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছি। সেই দাবি নিয়ে আমি আপনাদের নিকট জোড়হাতে প্রার্থনা করছি যে, আপনারা এই রাক্ষসী সরকারের চাকরী ছেডে দিন, অন্ততঃ ভগবানকে সাক্ষী ক'রে প্রতিজ্ঞা করুন যে, নিজের দেশের ভাইয়ের উপর, বোনের উপর হাত উঠাবেন না”।
ইন্দুমতা দেবীর এই জ্বালাময়ী ইস্তাহার কলিকাতা, আগ্রা, কানপুর, দিল্লী প্রভৃতি নানা জায়গায় বিতরণ করা হয়। এই ইস্তেহারের জেরেই ইন্দুমতীকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ সরকার। হাসিমুখে তিনি কারাবাস গ্রহণ করেন।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথমদিকে নারীদের যোগদান সীমিত হলেও ধীরে ধীরে অন্তঃপুর থেকে রাজপথে নেমে আসছিল বহু বিখ্যাত বাড়ির মেয়েরা। ঠাকুরবাড়ির সরলা দেবী চৌধুরানী, উকিল বগলামোহন দাশগুপ্তের কন্যা আশালতা দেবী, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, প্রতিভা ভদ্র, মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, শোভারানী দত্ত সহ একাধিক নারীর স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেও জাতীয় পতাকার প্রতিটি ছত্র আজও তাঁদের বলিদানের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
- Related topics -
- স্বাধীনতা দিবস
- স্বাধীনতা সংগ্রামী
- ভারত
- ভারতীয়
- পুজো ও উৎসব