মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির উপায়, Ways to improve your mental health explained in Bangla
ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা বা কর্মজীবনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এর মোকাবিলা করতে গিয়ে অনেকেই মানসিক অবসাদ এবং উদ্বিগ্নতার শিকার হয়। শারীরিক সুস্থতার বিষয় নিয়ে আমাদের মনে পূর্ব থেকেই একটি স্পষ্ট ধারণা তৈরি রয়েছে; এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের সঙ্গে যে অসুখগুলি জড়িত টা নিয়ে আমরা যথেষ্ট সচেতন, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে কেউই ততটা চিন্তিত নয়, বরং এই বিষয়টি বেশিরভাগ মানুষ উপেক্ষা করে যাচ্ছেন।
মানসিক স্বাস্থ্য বলতে কি বোঝায় ?
What does mental health mean?
সুস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম জরুরী উপাদান হল মনের সুস্থতা বা মানসিক স্বাস্থ্য। চিন্তাভাবনা ,আবেগ ও আচরণ মিলিতভাবে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাখ্যা করে। আমরা কখন কি চিন্তা করছি? কোন পরিস্থিতিতে কি অনুভব করছি? এসব বিষয়ই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে উপস্থাপন করে।
আরও পড়ুন :
মানসিক সমস্যা কি ধরনের হয়? Types of
mental problems
মানসিক অসুস্থতা হল এমন এক ধরনের ব্যাধি যা মানসিক স্বাস্থ্যের দুরাবস্থাকে ইঙ্গিত করে। এই ব্যাধি একজন ব্যক্তির মেজাজ, আচরণ এবং চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত হয়। আমাদের মানসিক অসুস্থতার মধ্যে রয়েছে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, আসক্তিমূলক আচরণ বা সাইকোসিসের মতো ব্যাধি।
বেশিরভাগ মানুষের কাছে মানসিক অসুস্থতা সংক্রান্ত সমস্যাটি একটি ভুল ধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। অনেকেই মানসিক অসুস্থতা বলতে মানসিক রোগ ও মানসিক ডিসঅর্ডারে জর্জরিত থাকাকেই বোঝেন। সেক্ষেত্রে একথা জেনে রাখা অত্যন্ত জরুরি যে মানসিক সমস্যা বা অসুস্থতা বলতে শুধু মানসিক দুর্বলতা বা অস্বাভাবিকতাকেই বোঝায় না, বরং মানসিক ভারসাম্য তথা মনের স্থায়ী অবস্থার অবনতিকেও বোঝায়।
মানসিক সমস্যার উপসর্গ, Symptoms
মানসিক সমস্যার সমাধান করতে হলে উপসর্গগুলিকে চিহ্নিত করা আমাদের প্রাথমিক পদক্ষেপ; কারণ শারীরিক সমস্যাগুলোর মত এক্ষেত্রেও উপসর্গের উপর ভিত্তি করেই উপযুক্ত চিকিৎসা করে সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
আমাদের অন্যান্য রোগের চিকিৎসা পদ্ধতির মতোই এই রোগ নিরাময়ের জন্যও কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপি এবং মেডিকেশনের সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে। সাধারণত, আমরা মানসিক রোগের উপসর্গগুলো বুঝতে পারি না, অনেক ক্ষেত্রে অবহেলা করা হয় সেই লক্ষণগুলো।
আরও পড়ুন :
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় মুড সুইং (Mood Swing)- এর কথা; যা আমাদের সকলেরই হওয়া স্বাভাবিক। তবে, অত্যাধিক পরিমাণে মুড সুইং হওয়া মোটেও স্বাভাবিক নয়। সেটা মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির লক্ষণ হতে পারে।
অথবা, কোন ব্যক্তির অসামাজিক হয়ে ওঠা। আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করি। কিন্তু কেউ যদি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজনদের এড়িয়ে চলেন তাহলে তা মোটেই স্বাভাবিক বিষয় নয়। এই সমস্যার দিকে গুরুত্বের সঙ্গে নজর দেওয়া উচিত, এই ক্ষেত্রে মানসিক কোন সমস্যা রয়েছে কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া দরকার।
বিশেষজ্ঞের সাহায্য, Expert help
মানসিক সমস্যাগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। সাধারণ ভাবে দেখা যায় যে, কেউ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েও বেশিরভাগ সময়ই চিকিৎসা করানোর কথা মাথায় আনেন না, বরং বিষয়গুলিকে অবহেলা করা হয়। কিন্তু এটা আমাদের অনেকেরই অজানা যে মানসিক সমস্যা আমাদের শারীরিক সুস্থতায়ও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
তাছাড়াও মানসিক সমস্যাগুলি মানুষকে কখন কোন পরিস্থিতিতে ফেলে দেয় তা বলা কঠিন; অনেকের সহনশীলতার অভাবে বিষন্নতার শিকার হয়ে পড়ে, আবার কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, কেউবা অবসাদগ্রস্থ হয়ে শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয় যায়। এজন্যই সুস্থ থাকতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অপরিহার্য।
মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতির উপায়, Ways to improve mental health
নিয়মিত নিজের উপর একটু সময় ব্যয় করেই আমরা মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত রাখতে পারি; কারণ নিজেকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখার দায়িত্ব একমাত্র আপনারই। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নিম্নলিখিত উপায়গুলি মেনে চলা খুব জরুরী-
পর্যাপ্ত ঘুম :
ঘুম আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সার্বিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থগুলোর কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে ঘুম; এই রাসায়নিকগুলোই আমাদের মেজাজ ও আবেগ ইত্যাদি পরিচালনা করে থাকে। সাধারণভাবেই লক্ষ্য করা যায় যে যদি আমাদের পর্যাপ্ত ঘুম না হয়, তাহলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ ঠিকমতো কাজ করতে অক্ষম হয়, যার ফলে আমরা সহজেই হতাশ ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। তাই পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই।
পুষ্টিকর খাদ্য:
পুষ্টিকর খাবার শুধুমাত্র শরীরের জন্যই নয়, বরং মনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু খনিজ যেমন- আয়রন ও ভিটামিন বি ১২ এর ঘাটতি আমাদের মেজাজ পরিবর্তনের জন্য দায়ী। তাই সুষম খাবার গ্রহণ করা খুব জরুরি। আপনার যদি মেজাজ খিটখিটে হয়, কিংবা হতাশা বা উদ্বিগ্নতায় ভোগেন তবে কফি খাওয়া কম খাওয়া দরকার।
অ্যালকোহল, ধূমপান ও মাদক পরিহার:
বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা কারণে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন এবং তখন ধূমপান ও মাদকের উপর নির্ভরশীলতা জন্মায় । তবে আপনি কি জানেন, এগুলো হতাশা না কাটিয়ে শরীর ও মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে আপনাকে মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত করে চলেছে। দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যাসের ফলস্বরূপ শরীরে থায়ামিনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
থায়ামিন মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এর ঘাটতির কারণে স্মৃতি বিভ্রাট, বিভ্রান্তি, মনোযোগের অভাব ও চোখের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে আপনি যদি ধূমপান করেন, তবে এতে থাকা নিকোটিন শরীর ও মস্তিষ্ক উভয়েরই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে কোন এক সময় ধূমপান বন্ধ করলে আপনি আরও বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে পারেন। তাই মাদকমুক্ত থাকা মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে আপনাকে সাহায্য করবে।
আরও পড়ুন :
সূর্যের আলো
ছোটবেলা থেকেই আমরা বই পুস্তক পড়েছি যে সূর্যালোক 'ভিটামিন ডি' এর একটি বড় উৎস। আমাদের শরীরে সকল প্রকার ভিটামিন জরুরি, তবে বিশেষ করে ভিটামিন ডি শরীর ও মস্তিষ্কের খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এতে মস্তিষ্কে অ্যান্ডোরফিন ও সেরোটোনিন এর উৎপাদন বেড়ে যায়। তবে রোদের আলো থেকে ত্বক ও চোখকে নিরাপদ রাখা জরুরি।
দুশ্চিন্তা দূরে রাখুন
সবার জীবনেই কম বেশ কাজের চাপ থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে পড়াশোনার ব্যাপার, অন্যদিকে বড়দের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত তথা কর্মজীবনের কাজের চাপ। তাই বলে এসব নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করাও উচিত নয়। এসব সমস্যার সমাধান করতে আপনাকে প্রথমে বুঝতে হবে যে কীভাবে আপনি চাপ সামলাবেন! তা না হলে সহজেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এজন্য সবচেয়ে সহজ উপায় হন তালিকা তৈরি করা।
দৈনন্দিন সমস্যার তালিকা তৈরি করে তাদের সমাধান করার উপায় খুঁজুন। অযথা অলীক কল্পনায় সারাদিন ডুবে থাকা উচিত নয়। বেশি দুশ্চিন্তার কারণে অনেকেরই ঘুমের সমস্যা হয়। যার ফলে আমাদের অজান্তেই মানসিক স্বাস্থ্য অনুন্নত হয়ে পড়ে।
শরীরচর্চা আবশ্যক:
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে নিয়মিত শরীরচর্চা আবশ্যক। কারণ আমরা যত বেশি সক্রিয় থাকব, মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থগুলোও ততই সক্রিয়ভাবে কাজ করবে। তাই শরীর ও মন দু’টোই ভালো রাখার জন্য নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। এরজন্য ম্যারাথন দৌড় বা ফুটবল খেলার মতো কিছু করার প্রয়োজন নেই, আপনি শুধুমাত্র নিয়মিত হাঁটাহাঁটি ও যোগব্যায়াম করেও নিজেকে সুস্থ রাখতে পারবেন।
প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো:
পছন্দসই লোকজনের সাথে সময় কাটালে মন ভালো থাকে। নিজেকে ঘরের চারদেয়ালে বন্দি রাখলে হতাশা ও দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকবে, যার ফলে মানসিক সমস্যার দেখা দেয়। পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধবদের সাথে কথোপকথন বা কোথাও ঘুরে আসা, একটু হাসি ঠাট্টা, ইত্যাদি মনকে সুস্থ করে তুলার ক্ষেত্রে দারুন উপযোগী।
নিজের ভালো লাগে এমন কাজই করুন:
আপনার যা করতে ইচ্ছে করবে তা-ই করুন। কোথাও ঘুরে আসা, শপিং করা কিংবা ছবি আঁকতে ভালো লাগা, সেলাই করা, ইত্যাদি নিজের মন-পছন্দের কাজগুলো করুন; যা আপনি আনন্দের সহিত উপভোগ করেন, সেই কাজগুলো মনও ভালো রাখার সহায়ক। বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে, যারা অন্যের বাধ্যগত থেকে নিজের খুশি দমিয়ে রাখেন, তাদের মেজাজ খিটখিটে ও মানসিকভাবে অসুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়। তাই নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
নিয়মিত কিছু ব্যায়ামের অভ্যাস:
মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে হলে নিয়মিতভাবে কিছু বিশেষ ব্যায়াম করার অভ্যাস আজ থেকেই শুরু করে দিন। রোজ সকালে উঠে মেডিটেশন করুন, ৫ থেকে ১০ মিনিট দৈনন্দিন এই যোগ আপনার মনের সুস্থতা বজায় রাখতে উপযোগী। এছাড়াও প্রাণায়াম করার অভ্যাস তৈরি করা উচিত।
- Related topics -
- স্বাস্থ্য
- লাইফস্টাইল
- মানসিক স্বাস্থ্য