পিসিওএস কি এবং কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করবেন ? What is PCOS ? Ways to control PCOS in Bengali
পিসিওএস বা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম হল মহিলাদের মধ্যে অ্যান্ড্রোজেন নামক পুরুষ হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাবার কারণে কিছু উপসর্গের সমাহার। পিসিওএস মূলত মহিলাদের একটি হরমোনজনিত ব্যাধি।
পিসিওএস কি? Meaning of PCOS
সাধারণত সুস্থ মহিলাদের ডিম্বাশয় প্রত্যেক মাসে একটি করে ডিম্বানু ছাড়ে, যা গর্ভদশা চলাকালে পরিণত হয় বা নির্মূল হয়ে মাসিক চক্রের রূপ নেয়। কিন্তু যখন অ্যান্ড্রোজেন হরমোন মেয়েদের শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় তখন ডিম্বাশয়ের আশপাশে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয়, যার ফলে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বড় হয়ে ডিম বের হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি হয় এবং এভাবে মাসিক হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পিসিওএসে আক্রান্ত মহিলাদের নিয়মিত ঋতুচক্র বাধাগ্রস্থ হয়।
পলিসিস্টিক শব্দের অর্থ,What is the meaning of the term, 'Polysystic' ?
Read also :
পলি' শব্দের অর্থ 'অনেক', সুতরাং পলিসিস্টিক শব্দের আক্ষরিক অর্থ অনেকগুলো সিস্ট। পিসিওএসের প্রধান বিষয় হল জরায়ু থেকে ডিম নির্গত না হয়ে তার পরিবর্তে ডিমের চারপাশে তরল জমে সিস্টে পরিণত হয়। ১৮ থেকে ৪৪ বছরের মহিলাদের ক্ষেত্রে পিসিওএস হল এন্ডোক্রিন গ্রন্থির সবচেয়ে সাধারণ রোগ। হরমোনের অসামঞ্জস্যতার ফলে মহিলাদের শারীরিক উর্বরতা কমে যাওয়া হল এর একটি প্রধান কারণ।
রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ, Symptoms of PCOS
পিসিওএস রোগের উপসর্গগুলো ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হয়ে থাকে। কারোও একটি দুটি উপসর্গ থাকে আবার কারোর ক্ষেত্রে অনেকগুলো উপসর্গ থাকে। অনেক সময় একজন মহিলা বা মেয়ের মধ্যেই ভিন্ন সময়ে ভিন্ন লক্ষণ দেখা যায়। পিসিওএস রোগের সাধারণ কিছু লক্ষণ ও উপসর্গগুলো হল:
● ঋতুস্রাবের ব্যাধি: অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিসিওএস এর কারণে অলিগোমেনোরিয়া (এক বছরে নয় বারের কম ঋতুচক্র) বা অ্যামেনোরিয়া (পর পর কয়েক মাস ধরে ঋতুস্রাব না হওয়া)দেখা যায়।
● উচ্চ মাত্রায় পুরুষ হরমোন নিঃসরণ: এই উপসর্গকে ইংরেজিতে বলে হাইপারঅ্যান্ড্রোজেনিজম। নারীর শরীরে উচ্চ মাত্রায় অ্যান্ড্রোজেন হরমোন নিসৃত হওয়ায় কিছু লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন:
1. ব্রণ - ত্বকে ব্রণের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
2. হিরসুটিজম - দেহের বিভিন্ন অংশে যেমন গালে এবং বুকে পুরুষের মত লোম ওঠা শুরু হয়।
3. হাইপারমেনোরিয়া - মাসিকের সময় বেশিদিন স্থায়ী হওয়া রক্তস্রাব।
4. অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেশিয়া - চুল বেশি ঝরার ফলে ঘনত্ব কম হয়ে যাওয়া।
5. কালো ছোপ: হাতের নিচে, ঘাড়ের পেছনে কালো ছোপ, বগলের ত্বক গাঢ় ও পুরু হয়ে যাওয়া।
6. স্বর - মহিলাদের গলার স্বর কিছুটা পুরুষালী বা মোটা হওয়া। যদিও এই লক্ষণ অনেক কম দেখা যায়।
Read also :
পিসিওএস নিরাময়ে খাবার নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস, Diet to get remedy from PCOS
যেহেতু পিসিওএস সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা হরমোনগুলির ভারসাম্যহীনতার কারণে ঘটে থাকে, সেহেতু এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডায়েট উন্নত করা বাঞ্ছনীয়। এই রোগ নিরাময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গই হল সুষম ডায়েট। খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কিত এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় রয়েছে যা এই পিসিওএসের লক্ষণগুলি হ্রাস করার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। অন্যদিকে এমন কিছু খাদ্য আছে যা খাওয়ার প্রভাব রোগটিকে আরও প্রখর করে তুলতে পারে।
ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া
আঁশযুক্ত বা ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার ডায়েটে রাখতে হবে। যেমন: বিভিন্ন ফলমূল এবং সবুজ শাকসবজি, তাছাড়া ভিন্ন ধরনের শস্যদানা, ডাল ইত্যাদি খাবার খাওয়া উচিত। এছাড়া ওটস, ওটমিল, রাগি, ব্রাউন রাইস, ছোলা, জোয়ার, সয়া বিন ইত্যাদি নিজের খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত।
ফ্যাটলেস প্রোটিনযুক্ত খাবার গ্রহণ
উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবারগুলি মহিলাদের দেহে অ্যান্ড্রোজেন এবং টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। তবে চর্বিযুক্ত উপাদান যা রেড মিট এবং প্রাণীজ প্রোটিনে বেশি পরিমাণে থাকে তা দেহে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
পিসিওএস রোগে আক্রান্ত মহিলাদের প্রোটিন গ্রহণের ক্ষেত্রে চর্বিবিহীন প্রোটিন খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। সুতরাং পিসিওএস ডায়েটে ডিম, মুরগি, সালমন ফিশ, টুনা ফিশ, সার্ডাইন ফিশ, তোফু, টার্কি ইত্যাদি খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি খাবার খাওয়া উচিত
অভ্যন্তরীণ প্রদাহ এবং দেহের নির্দিষ্ট কিছু অংশে জ্বালা হওয়ার মত সমস্যা পিসিওএসের একটি অঙ্গ। তাই মহিলাদের খাদ্যতালিকায় প্রদাহ-প্রতিরোধী খাবার অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিন টি তথা ব্ল্যাক টিতে শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান থাকে। এসব ছাড়াও কাঁচা হলুদ, আদা, গোলমরিচ, মৌরি, সেলারি, জিরা, তেজপাতা, ধনেপাতা, দারুচিনি, লবঙ্গ, বিট নুন, থাইম ইত্যাদি মশলা ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট খাদ্য তালিকায় যোগ করুন
পিসিওএসের সমস্যায় আক্রান্ত মহিলারা তাদের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ওমেগা -থ্রি ও ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ বিভিন্ন খাদ্য। উদাহরণস্বরূপ, টুনা, ম্যাক্রেল ফিশ, স্যামন, সার্ডাইন ফিশ, স্টারজন, আখরোট, অ্যাভোকাডো, চিয়া সিডস, জলপাই তেল ইত্যাদি খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন।
এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির যে সকল খাদ্যগুলি না খাওয়া উচিত
যে সকল খাদ্যগুলি না খাওয়া উচিত, Foods to avoid during PCOS
Read also :
পিসিওএস-এর সমস্যায় আক্রান্ত থাকলে কিছু খাবার আপনাদের খাদ্যতালিকা থেকে বাদও দিয়ে দিতে হবে। এই রোগে আক্রান্ত মহিলাদেরও ওজন বৃদ্ধি, স্থূলত্ব, ডায়াবেটিস ইত্যাদি সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। সেজন্যই নিম্নে উল্লেখিত খাবারগুলো খাদ্য তালিকা থেকে অবশ্যই দূরে রাখা উচিত-
চিনি যুক্ত খাবার বর্জন- মিষ্টি এবং মিষ্টান্ন অথবা প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন খাবার যেমন চিপস, ব্রেড ইত্যাদি। খাবারে চিনি এবং মিষ্টি ফলের রস পান করা এড়ানো উচিত, বিশেষত প্রক্রিয়াজাত ফলের রস, কারণ এসব ওজন বাড়ানোর কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কার্বোহাইড্রেট এড়িয়ে চলতে হবে- সাদা ভাত তথা আলু জাতীয় খাদ্যে উচ্চ গ্লাইসেমিক সূচক থাকে, সেকারণে এমন একটি ডায়েট তৈরি করতে হবে যাতে গ্লাইসেমিক সূচক খাবার কম থাকে।
ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন- ভাজা খাবারগুলিতে ফ্যাট এবং ক্যালোরি বেশি পরিমাণে থাকে, যার ফলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। এই খাবারগুলি খাওয়ার ফলে পিসিওএসের লক্ষণগুলি আরও বেড়ে যেতে পারে এবং তা নিরাময় করা কঠিন হতে পারে।
উপসংহার, Conclusion
পি সি ও এস নামক এই অসুখ অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় যদি জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন করা যায়। নিয়মিত শরীরচর্চার পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়ায় কিছু বদল আনলেও এই রোগটির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে সঠিক সময় শরীরের যত্ন না নেওয়া হলে এই রোগের হাত ধরেই শরীরে বাসা বাঁধতে পারে ক্যানসারের মতো মারণ রোগও।
- Related topics -
- স্বাস্থ্য
- পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম
- পেটপুজো