Ustad Rashid Khan | সেতারের সুরে আর শোনা যাবে না 'উস্তাদে'র কণ্ঠ! প্রয়াত 'বিরল' শাস্ত্র সঙ্গীতশিল্পী রাশিদ খান! জানুন তাঁর সঙ্গীতশিল্পী হয়ে ওঠার কাহিনী!
ছোটবেলায় দাদুর কড়া নিয়ম-শাসনের জন্য বসতে হতো 'রেওয়াজে'। বড় হয়ে সেই বিশিষ্ট ভারতীয় শাস্ত্র সঙ্গীতশিল্পীই জয় করেন অসংখ্য মানুষের মন। জানুন উস্তাদ রাশিদ খানের জীবনী।
২০২৪ এর শুরুতেই ভারতের সংগীত জগতে সৃষ্টি চিরকালীন শূন্যতা। প্রয়াত বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী উস্তাদ রাশিদ খান (Ustad Rashid Khan)। ৯ই জানুয়ারি, ২০২৪, মঙ্গলবার দুপুর ৩.৪৫ নাগাদ সুরেলা দুনিয়াকে ফেলে নিস্তব্ধতার দুনিয়ায় চলে গেলেন রাশিদ খান (Rashid Khan)। সংগীতশিল্পী দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ্য ছিলেন। অতীতে প্রস্টেটে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। এর মধ্যেই তাঁর মস্তিষ্কে একাধিক বার রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক হয়। এর পরই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তেমনভাবে খাওয়া-দাওয়াও আর করতে পারছিলেন না। কোনওরকমে রাইস টিউবে খাওয়াতে হচ্ছিল শিল্পীকে। শরীরে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ২০২৩ এর শেষে গায়কের শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও, ২০২৪ এর শুরুতে আবারো শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। যার ফলে ৯ই জানুয়ারি তাঁকে আইসিইউ এর ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। তবে সেখান থেকে আর লড়াইয়ে জয় পেলেন না গায়ক রাশিদ খান (Rashid Khan singer)।
সংকটজনক অবস্থায় ভেন্টিলেশন সাপোর্টে থাকাকালীন শাস্ত্র সঙ্গীতশিল্পী (Classical singers)কে দেখতে পৌঁছেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Chief Minister Mamata Banerjee)।সঙ্গে ছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। জানা গিয়েছে, সন্ধে ৬টা পর্যন্ত এদিন হাসপাতালেই থাকবে শিল্পীর মরদেহ। এরপরের দিন দুপুর ১টায় রবীন্দ্রসদনে ভারতীয় শাস্ত্র সঙ্গীতশিল্পী (Indian Classical Singers)কে সম্মান জানানো হবে গানস্যালুট দ্বারা। বুধবার টালিগঞ্জের কবরস্থানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে তাঁর। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে জীবনাবসান হয় শিল্পীর। স্বাভাবিকভাবেই মুর্ছে পড়েছে ভারতীয় সংগীত জগৎ থেকে শুরু করে সংগীত প্রেমীরা।
উস্তাদ রাশিদ খানের জীবনী । Biography of Ustad Rashid Khan :
ভারতের সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পের মতো দেশের সংগীতও বিশ্ব বিখ্যাত। ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন শাস্ত্রীয় সংগীতের কিংবদন্তীগণ। এরকমই এক শাস্ত্র সঙ্গীতশিল্পী (Classical singers) তথা কিংবদন্তি হলেন রাশিদ খান।
জন্ম ও পরিবার :
উত্তর প্রদেশে বরেলীর কাছে এক বিখ্যাত উর্দু কবি ও গীতিকার শাকিল বাদাঁয়ুর নামে রয়েছে বাদাঁয়ু গ্রাম। এই গ্রামেই উস্তাদ রশিদ খানের জন্ম। পিতা হামিজ রেজা খানও ছিলেন সংগীতজ্ঞ। আর মা শাখরী বেগম ছিলেন গৃহিণী। রাশিদ খান (Rashid Khan) বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আসামের গুয়াহাটি নিবাসী জয়িতার সঙ্গে। উস্তাদ রশিদ খান দুই মেয়ে এবং এক ছেলের পিতা। মেয়ে সুহা এবং শাওনা দুজনেই সঙ্গীত জগতে আত্মপ্রকাশ করেছেন পিতার পথ ধরে। মেয়েদের বাইরে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে পারিবারিক সকল সংকীর্ণতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তাদের সামনে এগিয়ে যেতে বড় অনুপ্রেরণা বাবা রাশিদ খান।
জন্ম থেকেই সুরে আবদ্ধ :
ভারতীয় শাস্ত্র সঙ্গীতশিল্পী (Indian Classical Singers) রশিদ খান যে পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস ও তাৎপর্য বিবেচনায় সেই পরিবারের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই একই পরিবারে জন্ম নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ের ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীরা। শুধু তা-ই নয়, তাদের নিজস্ব সঙ্গীত ঘরানাও ছিল। “রামপুর-সহসওয়ান” নামের এই বিখ্যাত ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আরেক বরেণ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী উস্তাদ এনায়েত হুসেন খান। রশিদ খানের চাচা উস্তাদ গোলাম মুস্তফা খানও সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাই ছোটবেলাতে পরিবার থেকেই তার সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয়। প্রথমে বাবা হামিজ রেজা খানের কাছে এবং পরবর্তীতে দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খান সাহেবের কাছে তার প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা সম্পন্ন হয়।
পরিবারের অন্য সংগীতশিল্পীদের মতোই তিনিও সংগীতে পটু। তবে ছোটবেলাতে তিনি ছিলেন খুব চঞ্চল আর দুরন্ত প্রকৃতির। গানের নিয়মিত চর্চার চেয়ে ফুটবল খেলাই ছিল তাঁর বেশি প্রিয়। কিন্তু তার দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খানের কঠোর নিয়মকানুন-অনুশাসনে নিয়মিত চর্চা করতে বাধ্য হতেন তিনি। হয়তো সেই কঠোর নিয়ম-শাসনের কারণেই ভারত তথা বিশ্বের সংগীত জগৎ এই কিংবদন্তিকে পেয়েছে।
সঙ্গীতশিল্পী রূপে আত্মপ্রকাশ :
মাত্র ১১ বছর বয়সে রশিদ খান মঞ্চে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এরপরের বছর ১৯৭৮ সালে দিল্লীতে আই টি সি সঙ্গীত সম্মেলনে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন এবং অতি অল্প বয়সেই তাঁর সঙ্গীত গায়কী সকলকে আকৃষ্ট করে। এরপর ১৯৮০ সালে দাদুর হাত ধরে কলকাতা আই টি সি সঙ্গীত একাডেমিতে আসেন তিনি এবং এখানেই তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে এখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে তিনি পরিপূর্ণ সঙ্গীতশিল্পী রূপে তথা গায়ক রাশিদ খান (Rashid Khan singer) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
'উস্তাদ রাশিদ খান' :
গায়কী বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে উস্তাদ রাশিদ খান (Ustad Rashid Khan) ছিলেন একজন অনন্যসাধারণ শিল্পী। তিনি মূলত রামপুর সহসওয়ান ঘরানা ছিলেন। তবুও ঘরানাকেন্দ্রিকতা কখনোই সীমাবদ্ধ করতে পারেনি। তাই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানার চমৎকারিত্ব তাঁর কণ্ঠে মিলে মিশে ধারণ করেছে এক মোহনীয় রূপ। মূলত রামপুর সহসওয়ান ঘরানার সাথে আরেক স্বনামধন্য গোয়ালিয়র ঘরানার সঙ্গে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পূর্ণ গম্ভীর স্বর ও সুর, মধ্য এবং ধীর লয়ের সঙ্গীতে তান ও বিস্তারের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শৈল্পিক কারুকার্য এই ঘরানাকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা। এর পাশাপাশি উস্তাদ রশিদ খান বিলম্বিত খেয়াল গায়নে তাঁর দাদুর কাছ থেকে শেখা ব্যতিক্রমধর্মী গায়কীর সাথে সরগম ও সরগম তানকারীর মিশেল ঘটিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর প্রতিভার চমৎকারিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তিনি ইন্দোর ঘরানার প্রবাদপুরুষ উস্তাদ আমির খাঁ ও শাস্ত্রীয় সংগীতের আরেক প্রাণপুরুষ পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর গায়কীতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ফলে তাঁর গায়কীতে এই দুই মহারথীর প্রভাবও সুস্পষ্ট।
শাস্ত্র সঙ্গীতশিল্পী (Classical singers) রাশিদ খান তাঁর অনবদ্য পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করেছেন প্রত্যেক মুহূর্তে। দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন থেকে প্রাপ্ত তারানা গায়নে অনন্য শৈলীকে তিনি নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে কারুকার্যমণ্ডিত করার মাধ্যমে তিনি তাঁর পরিবেশিত প্রতিটি তারানাকে পৌঁছে দিয়েছেন এক অন্য উচ্চতায়। তাঁর গায়কীর আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগের চলন অনুযায়ী কঠোর নিয়মের বাঁধনে আবদ্ধ করে সুরকে নিয়ে নানারকমের খেলা করার পাশাপাশি বন্দিশ কিংবা আলাপের সময় আবেগের স্নিগ্ধ স্পর্শ দিয়েও সঙ্গীতের শোভা আরও বাড়িয়ে তোলেন। বলাই চলে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কঠিন নিয়মের বেড়াজালে থেকে সুরের কারুকার্যের সেই প্রাচীনত্বকে বদলে দিয়েছেন উস্তাদ রশিদ খান।
আমীর খুসরোর “নায়না পিয়া সে” গানটিকে তিনি সুফি ঢঙ্গে গেয়েছেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের এক নতুন ধারার সৃষ্টি করতে লুই ব্যাংকসের সাথে যুগলবন্দী করেছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মানুষ হলেও তিনি বেশ কিছু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। নচিকেতার সঙ্গে গেয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসাধারণ কিছু যুগলবন্দী। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গান হলো-'আয়োগে যাব তুম সাজনা' (যাব উই মেট-২০০৭), 'আইয়ো পিয়াজি' (চক্রব্যূ-২০১২), 'ঝিনি রে ঝিনি রে' (ইসক -২০১৩), 'সখি রে' (ভদকা ডায়েরিজ-২০১৭) ইত্যাদি।
শুধুমাত্র সঙ্গীতে এই অসাধারণ সাফল্যেই তিনি থেমে থাকেননি। তিনি নিজের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন শাখরী বেগম মেমোরিয়াল ট্রাস্ট (Shakhri Begum Memorial Trust)। সঙ্গীতে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ২০০৬ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি সঙ্গীত নাটক একাডেমি সম্মাননা, গ্লোবাল ইন্ডিয়া মিউজিক সম্মাননা, মহা সঙ্গীত সম্মান পদক সহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন।
ছোটবেলা থেকেই অভাবনীয় পারদর্শিতা আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গায়নে মেধার দ্যুতিময়তার কারণে বহু বিখ্যাত ও প্রবীণ সঙ্গীতজ্ঞের আশীর্বাদ লাভ করেন তিনি। পণ্ডিত ভীমসেন যোশী মুক্তকণ্ঠে তাঁকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধুনিক যুগে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসাতে দ্বিধাবোধ করেন নি। পাশাপাশি উস্তাদ রশিদ খানের গুণমুগ্ধ ছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর স্বয়ং। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে শাস্ত্র সঙ্গীতশিল্পী (Classical Singers) এর জীবনাবসান ভারত তথা গোটা বিশ্বের সংগীত জগতের বড় ক্ষতি। তাঁর কণ্ঠে একের পর এক গান মন কেড়েছিল ভক্তদের। হিন্দি- বাংলা সমস্ত ভাষায় তাঁর কণ্ঠে মত মেতেছে বাঙালি তথা অন্যান্য ভাষাভাষীর মানুষ। তবে সেতারের সুরে সে কণ্ঠ থেমে গেল চিরদিনের মতো।
- Related topics -
- বিনোদন
- সঙ্গীতশিল্পী
- মমতা ব্যানার্জী
- জীবন কাহিনি
- জীবন ও জীবনী
- প্রয়াত