মকর সংক্রান্তির মর্মকথা | The essence of Makara/Makar Sankranti
পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিন বাঙালিরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। তার মধ্যে পিঠা খাওয়া, ঘুড়ি উড়ানো অন্যতম।
ভূমিকা | Introduction to Makar Sankranti
পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতির এক অন্যতম উৎসবের দিন হিসেবে চিহ্নিত। বাংলা মাসের পৌষ এর শেষের দিনটি তে এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। এই বিশেষ দিনটি জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি বিশেষ ক্ষণ। সাধারণত ১৪ জানুয়ারি বা তার এক দিন আগে-পরে এই তিথি আসে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসবের বিভিন্ন বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য বর্তমান এবং তার সাথে এটির সময়সীমাও ক্ষেত্রবিশেষে আলাদা হয়ে থাকে। মকর সংক্রান্তির মূল প্রথা হল গঙ্গাস্নান, অন্নদান এবং এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশেষ খাবারের ও আয়োজন করা হয়ে থাকে বিভিন্ন প্রদেশে। সূর্যের উত্তরায়ন শুরু হওয়ার এই দিনটি রবিশস্য ঘরে তোলার উত্সব হিসেবে পালন করা হয়। সারা দেশের মতো বাংলাতেও এই দিনে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় এবং চারিদিকে উৎসবের আমেজ ছেয়ে থাকে।
মকর সংক্রান্তির প্রকৃত অর্থ | Meaning of Makar Sankranti
'সংক্রান্তি' শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল সং + ক্রান্তি অর্থাৎ বিভিন্ন রূপে অন্যত্র গমন৷ সংক্রান্তি' হল একটি সংস্কৃত শব্দ যার দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। 'মকরসংক্রান্তি' শব্দটির মধ্যে দিয়ে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশ করাকে নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে।জ্যোতিষশাস্ত্র মতে ১২টি রাশি অনুসারে এরকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে। পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি পৌষ মাসের শেষ দিনটি তে পালিত হয়; এরপর থেকে মাঘ মাসের সূচনা । এই বিশেষ মুহূর্তটি তে সূর্য ধনু রাশি পরিত্যাগ করে প্রবেশ করেন মকর রাশিতে অর তখন থেকে ই আরম্ভ হয় সূর্যের উত্তরায়ন।তাই এই দিনটি ঋতুরাজ বসন্ত কে স্বাগত জানানোর দিন হিসেবেও পালন করা হয়ে থাকে।
মকর সংক্রান্তির তাৎপর্য এবং পৌরাণিক ব্যাখ্যা | Significance and mythological explanations of Makar Sankranti
কথিত আছে যে সূর্য এই লগ্নে তার ছেলে মকর অধিপতি শনি র সাথে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং সেই অর্থে এই দিনটিকে বাবা-ছেলের সম্পর্কের মিলনের দিন হিসেবে ও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। পৌরাণিক মতে মকরসংক্রান্তির সম্পর্ক মহাভারতে ভীষ্মের শরশয্যা সঙ্গে ও জড়িত রয়েছে। পিতামহ ভীষ্ম, পিতা শান্তনু কর্তৃক স্বেচ্ছামৃত্যুর বর পাওয়া সত্ত্বেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শরশয্যায় শায়িত ছিলেন এবং মৃত্যুর অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন। কারণ হিসাবে বলা হয়ে থাকে যে সেই সময় টি ছিল সূর্যের দক্ষিণায়ন, তাই মৃত্যুকে তিনি আহ্বান করেননি। পৌরাণিক মতে কিছু ক্ষেত্রে দক্ষিণায়ন কে তুলনা করা হয়েছে রাতের সাথে। রাতের বেলা সকলে যেমন বিশ্রাম নেয় ঠিক তেমনি স্বর্গের দেবতারা ও অবিরত ছয় মাস বিশ্রাম নিয়ে থাকেন এবং সেই সময় যদি ভীষ্ম স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করতেন তাহলে তাঁকে স্বর্গের দরজায় দণ্ডায়মান থাকতে হতো দেবতাদের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়।পুরাণে কথিত রয়েছে সূর্যের দক্ষিণায়ন এর সময় প্রাণত্যাগ করলে পুনর্জন্ম হয়,আর উত্তরায়নের মৃত্যুর অর্থ হল পৃথিবী থেকে চির বিদায় আর তাই ভীষ্ম অপেক্ষা করেছিলেন সূর্যের উত্তরায়নের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য এবং অবশেষে মকর সংক্রান্তির পূন্য লগ্নে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এই মহান আত্মা। অপরদিকে সূর্যের উত্তরায়ন শুরু হওয়ার ফলে উন্মোচন হল স্বর্গের দ্বার ; দেবতাদের নিদ্রা ভঙ্গ হলো । সেই মত কর্কট সংক্রান্তি থেকে মকর সংক্রান্তি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
বিভিন্ন রাজ্যে উৎসবটির তাৎপর্য | Significance of Makar Sankranti in different states
সারা দেশ জুড়ে নানা রকম ভাবে , হরেক রকম নামে মকর সংক্রান্তি উৎসব পালিত হয়। কোথাও লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করা হয়, কোথাও বা সূর্য দেবের পূজা আবার কোথাও বা পূজিত হন দেবী সরস্বতী। কিন্তু পূজা বা প্রসাদের উপকরণ সব ক্ষেত্রেই প্রায় এক ই – "নতুন ফসল"।
সুবিশাল এই দেশে মকর সংক্রান্তির বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন রূপ আমরা পরিলক্ষিত করতে পারি । তামিলনাড়ুতে মহা ধুমধামে 'পোঙ্গল' উদযাপন করা হয়ে থাকে ; মূলত পৌষ মাসের শেষ দিনে এর শুরু, চলে পরের মাসের তৃতীয় দিন অবধি। তেলুগু অঞ্চলেও এই উৎসব চার দিন ব্যাপী চলে ; তবে বেশির ভাগ অঞ্চলেই এটি এক বা দু’দিনেই শেষ হয়ে যায়। পঞ্জাবের 'লোহরী'র মতোই তামিলনাড়ু অধিবাসীরা প্রথম দিনে কাঠকুটো একত্রিত করে আগুন জ্বালিয়ে সেই আগুনে পুরনো বস্ত্রাদি ও অন্যান্য জিনিসপত্র আহুতি দিয়ে থাকে: জীর্ণ পুরাতন যা কিছু অবশিষ্ট সবটুকু কে বিসর্জন দিয়ে নতুনের আবাহন করাই এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য । পরের দিন দুধ আর গুড় মিশিয়ে তার মধ্যে নতুন ‘ভাজা’ চাল এবং মুগডাল ফোটানো হয় যতক্ষণ না সেই দুধ উথলে ওঠে। দুধ ওথলানোকে এই বিশেষ দিনে তামিলবাসীরা শুভলক্ষণ বলে গণ্য করে থাকে।
পৌষসংক্রান্তির এই সময়ে পঞ্জাব থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত সব স্থানেই উৎসবের সময় গুড় এবং তিলের মিষ্টি একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে কারণ আখ এবং তিলের ফসল এই মরসুমেই ফলে। তবে কেরল বা পশ্চিমবঙ্গে অন্য অঞ্চলের তুলনায় সংক্রান্তির ধুমধাম কম। অসমেও এই সময় নতুন ধান ওঠে, তাই উপবাস, ভোজ ও উৎসবের মধ্যে দিয়ে পালন করা হয় 'ভোগালি বিহু'। পাঞ্জাব থেকে বিহার অবধি প্রায় সব উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে তিল, গুড় এবং দুধের মিষ্টান্নের সাথে সাথে অত্যন্ত জনপ্রিয় খাদ্য হল মরসুমি সবজি দিয়ে তৈরি খিচুড়ি। পঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রের সুজির হালুয়া, তামিলনাড়ুর মতো কিছু রাজ্যে দুধ আর চালের পায়েস এবং মিষ্টির আয়োজন করা হয়ে থাকে।
গোটা ভারতে, এমনকী বাংলা ও কেরলেও ‘গঙ্গাস্নান’- এই উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।কেরালায় এই উত্সব "মকরাভিলাক্কু 'নামে খ্যাত। অনেক ক্ষেত্রে গরুবাছুরকেও পুণ্যস্নান করানো হয়, কোথাও আবার তাদের শিং দুটো নানা রঙে রাঙিয়ে তাদের নিয়ে শোভাযাত্রা আয়োজন করা হয়, তামিলনাড়ুতে ষাঁড়কে বশে আনার প্রতিযোগিতা হয় যা 'জাল্লিকাট্টু' নামে বিশেষ পরিচিত। এই খেলাটির ভয়াবহতার কারণে, সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এটি কে নিষিদ্ধ করেছে। গুজরাত বা কর্নাটকে এই সময় ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব হয়ে থাকে। গুজরাত এবং রাজস্থানে মকর সংক্রান্তি পরিচিত, 'উত্তরায়ন' হিসেবে এবং হরিয়ানা ও পঞ্জাবে এটি 'মাঘী' নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে ।ঠিক একই সময়ে ওডিশার ভুঁইয়া জনজাতির অধিবাসী এবং বাংলার পশ্চিম প্রান্তের মানুষ 'টুসু' উৎসবে মেতে ওঠে। মণিপুর অঞ্চলে অনেকে তাঁদের পরমপূজ্য ঈশ্বর লিনিং-থোউয়ের কাছে প্রার্থনা করে থাকেন, আবার সুদূর অরুণাচল প্রদেশে চিন সীমান্তের নিকটবর্তী ব্রহ্মকুণ্ড অঞ্চলে রামায়ণ, মহাভারত ও কালিকাপুরাণের সূত্র ধরে দেবতার পূজা করা হয়ে থাকে এই বিশেষ দিনটিতে। হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয় সেখানে। উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি এলাকায় এই সময়ে লোকনৃত্যের আসরের আয়োজন করা হয়। এমনকী সাম্প্রতিককালে শবরিমালার প্রসিদ্ধ হিন্দু মন্দিরে ভক্তেরা বিস্তর কৃচ্ছ্রসাধন করতে আসেন।
শবরীমালা পাহাড়ের মাথায় সূর্যের প্রথম আলো পড়লে তা প্রত্যক্ষ করতে হাজির হন বহু পূণ্যার্থী।কর্ণাটকে একে ‘মকর সংক্রমনা’ বা ‘ইল্লু বিল্লা’ বলে অভিহিত করা হয়,অন্ধ্রে আর কেরলে এই উৎসব 'মকর সংক্রান্তি 'নামেই পরিচিত । মহারাষ্ট্রে ‘তিলগুল’, মধ্যপ্রদেশে 'সুকরাত', কাশ্মীরে 'শায়েন-ক্রাত', উত্তর ভারতের পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল, জম্মুতে এই উৎসব ‘লোহরি’ হিসেবে জনপ্রসিদ্ধ। বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসবকে ‘খিচড়ি পরব বলেও অভিহিত করা হয়েছে। অনেক রাজ্যে এদিন বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন নিয়ে নানা রঙের ঘুড়ি ওড়ানোর উত্সব পালন করে থাকেন। সন্ধ্যায় এদিন আকাশদীপ ও জ্বালানো হয়ে থাকে। মকর সংক্রান্তির এই পুণ্য তিথিতে বাড়ি ঝাড়া মোছা করার রীতি বহু যুগ ধরে চলে আসছে।ফুল ও আমপাতা সহকারে বাড়ির প্রধান ফটক সুসজ্জিত করা হয় এবং অনেকেই আলপনা ও দিয়ে থাকেন।
পশ্চিমবঙ্গের উদযাপিত মকরসংক্রান্তি | Makar Sankranti celebration in West Bengal
পশ্চিম বাংলায় মকর সংক্রান্তি বা পৌষসংক্রান্তি বা 'নবান্ন ', মূলত নতুন ফসলের উৎসব যাকে 'পৌষ পার্বণ' ও বলা হয়ে থাকে। নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পাটালি সহকারে বিভিন্ন স্বাদের ও নানান ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরি করা হয়। তাই পৌষ পার্বণের আরেক নাম পিঠে পার্বণ । উত্তরায়ণের সূচক, মকর সংক্রান্তি কে অশুভ সময়ের অন্তিম দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।এই উৎসব মূলত নতুন ফসলের উৎসব হওয়ায় বাঙালির কাছে তা ‘নবান্ন ’বলে অধিক স্বীকৃতি পেয়েছে । পৌষ সংক্রান্তির শস্যোৎসবে খেতের পাকা ধান প্রথম ঘরে ওঠার সুবাদে পালন করা হয় এই উৎসব। পাকা ধানের শিস নিয়ে আসা হয় এবং নির্দিষ্ট কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। দু’-তিনটি খড় এক সাথে পাকিয়ে তার সাথে ধানের শিস, মুলোর ফুল, সরষে ফুল, আমপাতা প্রভৃতি বেঁধে ‘আউনি বাউনি’ বানানো হয়ে থাকে। এটি কে ধানের গোলা, খড়ের চাল, ঢেঁকি, বাক্স-প্যাঁটরর ভিতর গুঁজে দেওয়া হয়ে থাকে।এই বিশেষ দিনটিতে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সাগরদ্বীপ অঞ্চলে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে কপিল মুনির আশ্রমে লক্ষাধিক পুণ্যার্থী জমায়েত হয় এবং পুণ্যস্নান করে থাকে। এই উপলক্ষে এক বিরাট মেলা ও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
উপসংহার | Conclusion of Makar Sankranti
'বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য '~এই আমাদের ভারতবর্ষ।আমাদের সুবিশাল দেশে উৎসবের যেমন প্রাচুর্য আছে তেমনি তার ঐতিহাসিক উৎস বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম । আমরা ভারতবাসী এই উৎসবগুলির ‘বহুমুখী বৈচিত্র’ উপভোগ করে এসেছি কালক্রমে। মকর সংক্রান্তি বা পৌষসংক্রান্তি এই উৎসবগুলির মধ্যে একটি অন্যতম উদাহরণ। বিভিন্ন অঞ্চলের রকমারি আচার-অনুষ্ঠান এসে মিশেছে এই অনুষ্ঠানে যা এই উৎসবটিতে একটি সর্বভারতীয় উৎসবে উন্নীত করেছে।
প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions
মকর সংক্রান্তি কবে উদযাপন করা হয়?
পৌষ মাসের শেষ দিনটিতে
মকর সংক্রান্তি বলতে কী বোঝায় ?
'মকরসংক্রান্তি' শব্দটির মধ্যে দিয়ে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশ করাকে নির্দিষ্ট করা হয়
তামিলনাড়ুতে মকরসংক্রান্তির নাম কি ?
পোঙ্গল
বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির অপর নাম কী?
নবান্ন
মকর সংক্রান্তিতে পশ্চিমবঙ্গে কোন মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে পুণ্যার্থীদের জমায়েত হয়?
কপিলমুনির আশ্রম
- Related topics -
- লাইফস্টাইল
- মকর সংক্রান্তি
- পৌষ উৎসব