Sabyasachi Mukherjee | চন্দননগর থেকে কলকাতায় এসে ভুগছিলেন বিষন্নতায়, চেয়েছিলেন নিজেকে শেষ করতে! আজ তিনি বিশ্বখ্যাত ডিজাইনার সব্যসাচী!

Friday, December 15 2023, 11:27 am
highlightKey Highlights

বিশ্বখ্যাত সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় 'বিখ্যাত' সব্যসাচী হওয়ার আগে পেরিয়েছেন একাধিক কঠিক ধাপ। বিষন্নতা, হয়রানি সব পেরিয়ে সাফল্যের শিখরে সব্যসাচী।


ফ্যাশন-স্টাইল এবং পোশাক, এই শব্দগুলো কানে এলেই একটাই নাম নেয় বলিউড-সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় (Sabyasachi Mukherjee)!সব্যসাচীর লেহেঙ্গা (Sabyasachi Lehenga), সব্যসাচীর শাড়ি (Sabyasachi Sarees), সব্যসাচীর পোশাক (Sabyasachi Dresses) মানেই বিশাল ব্যাপার। ছবিতে নায়ক-নায়িকার সাজই হোক কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিয়ের আসর, এই ব্রাহ্মণপুত্রের পোশাক ছাড়া অসম্পূর্ন। হুগলির এই ছেলে যে এক সময়ে গোটা বলিউড এমনকি গোটা বিশ্বের ফ্যাশন ফিল্ড দাঁপিয়ে বেড়াবেন তা ধারণা করতে পারেননি তিনি নিজেও। দীর্ঘ সময় ধরে ভুগতেন বিষন্নতায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে অন্যতম সফল ফ্যাশন ডিজাইনার তিনি।

বিশ্বের অন্যতম ফ্যাশন ডিজাইনারের মধ্যে অন্যতম হুগলির ছেলে সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় 
বিশ্বের অন্যতম ফ্যাশন ডিজাইনারের মধ্যে অন্যতম হুগলির ছেলে সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় 

১৯৭৪ সালের ২৩সে ফেব্রুয়ারি হুগলিতে জন্ম নেন এই 'ফ্যাশন কিং'। সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষা (Sabyasachi Mukherjee Education) পথ শুরু হয় শ্রী অরবিন্দ বিদ্যামন্দির, চন্দননগর থেকে। বাংলা সাহিত্য ছিল প্রিয় বিষয়। কোনও বিষয়ের উপর রচনা লিখতে দিলেও তাঁর কলম চলত ঝড়ের বেগে। যদিও বা পরে তিনি চন্দননগর থেকে চলে আসেন কলকাতায়।  তিলোত্তমার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় শিক্ষা (Sabyasachi Mukherjee Education) লাভ করেন।

 বাড়ির এই ঠিকানা পরিবর্তনের ঘটনা ছিল তাঁর কাছে 'ছোট শহর থেকে প্যারিসে' আসার মতো ঘটনা। ছোট শহর থেকে খাস কলকাতায় এসে পড়া সব্যসাচীর জন্য বেশ কঠিন হয়ে পরে এই পরিবর্তন। তার উপরে নিজেকে প্রকাশ করতে না পারারও একটি সমস্যা ছিল। ফলে খুব সহজেই বিষণ্ণতার শিকার হয়ে পড়েন সব্যসাচী। অনুভূতিগুলি তাঁর উপরে এতটাই আধিপত্য কায়েম করেছিল যে, মাত্র ১৭ বছর বয়সেই সব্যসাচী নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন। তবে ভাগ্যক্রমে সফল হয়নি আত্মহননের চেষ্টা। পরবর্তীকালে যখন তিনি বিখ্যাত 'সব্যসাচী' নামে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত, তখন তিনি সোশ্যাল মাধ্যমে লেখেন, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার প্রচেষ্টার কারণে জ্ঞানহীনভাবে পড়েছিলেন তিনি। মায়ের চড়েই ফায়ার আসে হুঁশ।

বিষন্নতা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে নানারকম ফ্যাশন এক্সপেরিমেন্ট করতেন সব্যসাচী
বিষন্নতা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে নানারকম ফ্যাশন এক্সপেরিমেন্ট করতেন সব্যসাচী

নতুন জীবনের বন্ধু 'ফ্যাশন' :

ছোটবেলার থেকেই বোন পায়েলের সঙ্গে নাকি ছোট্ট সব্যসাচীর কম্পিটিশন হত, কে কত ভাল পোশাক ড্রয়িং করতে পারে। এছাড়াও নানারকমের রং, কাপড়ের এক এক টেক্সচার সব কিছুই যেন ছোটবেলার থেকে ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলছিলো ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচীকে। তবে আত্মহননের চেষ্টার পর ঘুরে দাঁড়ানো যেন ছিল সব্যসাচীর কাছে এক নতুন জীবনের মতো। এই ঘটনার পরই যেন জন্ম নিয়েছিল ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়! নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য সব্যসাচী নিজের পোশাক এবং চুলের স্টাইল পরিবর্তন করেন। ম্যাডোনার ফ্যাশন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে টর্ন জিন্স অর্থাৎ ওয়ান শট বা ছেঁড়া স্টাইলের জিন্স পরা শুরু করেছিলেন সব্যসাচী। কেবল জামাকাপড়েই পরিবর্তন নয়, পরিবর্তন করেছিলেন চুলের ফ্যাশনও। চুলে নানা রকমের কালার করেও নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। নানা রকমের ফ্যাশন এক্সপেরিমেন্ট  নিজেকে প্রকাশ করার অনন্য উপায় ছিল সব্যসাচীর কাছে।  এর থেকে পেয়েছিলেন মানসিক স্বস্তিও। তবে এই ধরনের ফ্যাশন সেন্সের কারণে তাঁকে নানা হয়রানির মুখেও পড়তে হয়েছিল। এমনকি বাবা-মাও চাননি সব্যসাচী পোশাক শিল্পী হন। তাই এ বিষয় নিয়ে পড়াশোনার জন্য বাড়ি থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়াও দুষ্কর হয়ে ওঠে। তবে থামেননি সব্যসাচী। নিজের যাবতীয় বই বিক্রি করে ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ফ্যাশন টেকনোলজি’-তে ভর্তি হন তিনি। তবে এর আগে তিনি প্রথমে চিকিৎসা এবং পরে অর্থনীতি নিয়েও পড়াশোনা করেন।

বন্ধুর জন্য বানানো জামা থেকে সাফল্যের উড়ান : 

১৯৯১ সালে ‘নিফট’  থেকে পাশ করে পরপর দুটি প্রদর্শনী করেন সব্যসাচী। তার পর সোজা মুম্বই। সে বছরই তিন জন কারিগর নিয়ে তৈরি করেন সব্যসাচীর পোশাক (Sabyasachi Dresses) ব্র্যান্ড ‘সব্যসাচী’ (Sabyasachi)।  বন্ধু সেলিনা জেটলি (Celina Jaitley) মিস ইন্ডিয়া কনটেস্টে (Miss India contest) যাবে, তাই পোশাক বানালেন সব্যসাচী।  খাদির নানা রঙের কাপড়ের পট্টি জুড়ে স্কার্ট সঙ্গে হল্টার টপ, আর মাথায় পাগড়ি, ব্যাস! বন্ধু সেলিনার প্রতিযোগিতার জন্য বানানো পোশাক যেন পিঁপড়ের কাছে মিষ্টির মতো। চারিদিকে হইচই পড়ে গেল সব্যসাচীর পোশাক নিয়ে। এর পরেই ব্রিটিশ কাউন্সিল ও একটি নামী ইংরেজি পত্রিকার উদ্যোগে ট্রেনিংয়ের জন্য তাঁর লন্ডন যাত্রা।

নিজের যাবতীয় বই বিক্রি করে ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ফ্যাশন টেকনোলজি’ তে শিক্ষা নিয়ে ফ্যাশন দুনিয়া জয় করেন সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়
নিজের যাবতীয় বই বিক্রি করে ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ফ্যাশন টেকনোলজি’ তে শিক্ষা নিয়ে ফ্যাশন দুনিয়া জয় করেন সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়

 এরপর সব্যসাচীর সাফল্যের উড়ান চলে নিজের মতো। এদিকে সঞ্জয় লীলা ভংশালীর (Sanjay Leela Bhansali) হাত ধরে ‘ব্ল্যাক’ ছবিতে প্রথম পোশাক পরিকল্পনা আর প্রথম পদক্ষেপেই জাতীয় পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ পোশাক পরিকল্পনার জন্য সম্মান পান সব্যসাচী। এর পর একে একে ‘বাবুল’, ‘লাগা চুনরি মে দাগ’, ‘রাবণ’, ‘গুজারিশ’, ‘পা’, ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’, ‘ ইংলিশ ভিংলিশ’-এর মতো বিভিন্ন ধারার ছবিতে পোশাক পরিকল্পনার দায়িত্ব সামলেছেন সব্যসাচী। ক্রমেই খ্যাতি পেতে থাকে 'সব্যসাচী' ব্র্যান্ড। শুধু নারী ও পুরুষের পোশাকে থেমে থাকা নয়। সব্যসাচী বাচ্চাদের পোশাকও বানাতে শুরু করলেন। 

বলিউডের (Bollywood) তাবড় তাবড় নায়িকা ও সুন্দরীরা সব্যসাচীর পোশাকে মহিমান্বিতা। বর্তমানে প্রথম সারির অভিনেতা-অভিনেত্রী নিজেদের বিয়ের মতো বিশেষ দিনেও ভরসা করেন সব্যসাচীকেই। বিদ্যা বালন, অনুষ্কা শর্মা, দীপিকা পাড়ুকোন, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, পত্রলেখা রাও, ক্যাটরিনা কইফ, আলিয়া ভট্ট- সকলেই তাদের বিয়েতে পড়েছেন নয় সব্যসাচীর লেহেঙ্গা (Sabyasachi Lehenga) নাহয় সব্যসাচীর শাড়ি (Sabyasachi Sarees)। কলকাতা, নয়া দিল্লি, মুম্বই এবং হায়দরাবাদ-  ভারতের এই চারটি জায়গায় রয়েছে সব্যসাচী বিপণি। এছাড়া দেশের বাইরে ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যাটলান্টা, লন্ডন এবং দুবাইয়েও রয়েছে সব্যসাচীর নিজস্ব বিপণি। 

বলিউডের তাবড় তাবড় অভিনেতাদের প্রথম পছন্দ সব্যসাচীর পোশাক
বলিউডের তাবড় তাবড় অভিনেতাদের প্রথম পছন্দ সব্যসাচীর পোশাক

২০২১ সালে আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন সব্যসাচী। ৩৯৮ কোটি টাকা দিয়ে সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের ব্র্যান্ডে নিজেদের অংশীদারিত্ব গড়ে সেই গোষ্ঠী। হাত মিলিয়েছেন বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন সংস্থা ‘এইচ অ্যান্ড এম’- (H&M')এর সঙ্গেও।  সিঙ্গাপুর, দিল্লি, মুম্বই ফ্যাশন উইকের পাশাপাশি , ফ্যাশনের মক্কা মিলানে (Milan) একমাত্র ভারতীয় ডিজাইনার হিসেবে আমন্ত্রিত হন সব্যসাচী। লন্ডন, নিউ ইয়র্কের সম্ভ্রান্ত ফ্যাশন শো-তেও আমন্ত্রিত হয়েছেন তিনি। দেশে বিদেশে বহু আমন্ত্রণ, পুরস্কার, শো। অগুনতি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ২০২১ সালেই ভারতের প্রথম পোশাক শিল্পী হিসাবে নিজের কাজ দেখানোর সুযোগ পান নিউ ইয়র্কের ১২২ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক ফ্যাশন বিপণি ‘বার্গডর্ফ গুডম্যান’-এ (Bergdorf Goodman' in New York)। হুগলির যে ছেলে কলকাতায় এসে বিষণ্ণতার কারণে নিজেকে শেষ করতে চেয়েছিলো বর্তমানে সে দুনিয়ার ব্যস্ততম পোশাক শিল্পীদের মধ্যে প্রথম সারির একজন।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File