Dabur | কলকাতার কোনও এক গলি থেকে পথচলা শুরু, বর্তমানে দেশ-বিদেশের ঘরে 'ডাবর'! জানুন এক বাঙালির ডাক্তার থেকে ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার গল্প!
ডাবরের মধু,তেল, শ্যাম্পু, মাজন কম বেশি সকল ভারতীয়র ঘরেই পাওয়া যায়। এই ডাবরই তার পথ চলা শুরু করেছিল আয়ুর্বেদিক ওষুধ বানানো থেকে শুরু করে। জানুন ডাবর কোম্পানির অজানা ইতিহাস।
'ডাবর' (Dabur)! এই শব্দটির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। দাঁতের মাজন হোক কিংবা তেল বা মধু, এক সময়ে বাংলা ও বাঙালির ঘরে ঘরে ছিল ডাবরের রাজত্ব। কেবল বাংলাই নয়, দেশ এমনকি বিদেশেও এখন পৌঁছে দিয়েছে এই কোম্পানির অসংখ্য পণ্য। ডাবর কোম্পানি প্রায় ১৩৯ ধরে আমাদের নানান পণ্য পরিষেবা দিয়ে উপকৃত করে চলেছে। ভারতীয় বহুজাতিক ভোক্তা পণ্য কোম্পানি 'ডাবর' নামটি সম্পর্কে সকল ভারতীয় অবগত থাকলেও আমরা অনেকেই জানিনা এই কোম্পনির গড়ে ওঠা, বড় হয়ে ওঠার গল্প। জেনে নিন কম বেশি আমার-আপনার দৈনন্দিন যোবনের সঙ্গী ডাবরের 'সাফল্যের ইতিহাস'।
তিলোত্তমার কোল থেকেই এই সংস্থার পথ চলা শুরু। ভারতের বৃহত্তম দ্রুত চলন্ত ভোগ্য পণ্য (FMCG) কোম্পানিগুলির মধ্যে একটি ডাবর। আয়ুর্বেদিক ওষুধ থেকে শুরু করে তেল, শ্যাম্পু, ফ্রুট জুস্, ওষুধের মতো অসংখ্য পণ্য নিয়ে ব্যবসা করছে কোম্পানিটি। দেশ বিদেশে নামকরা এই ডাবরের যাত্রা শুরু হয়েছিল অবিভক্ত বাংলা থেকে। ডাবর কোম্পানির মালিক (Dabur Company Owner)ও বাঙালি। আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছরেরও বেশি আগে, ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে কলকাতায় এস কে বর্মণ (SK Burman) নামে একজন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার বসবাস করতেন। বর্মন বাবুর বেশিরভাগ সময়ই কাটতো নিজের হাতে রোগ নিরাময়ের জন্য আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরী করার পেছনে। তৎকালীন সময়ে ঘরে ঘরে ম্যালেরিয়া ও কলেরার মতো রোগের ছড়াছড়ি। রোগী নিরাময়ের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজের হাতে তৈরী করেছিলেন আয়ুর্বেদিক ওষুধ।
ম্যালেরিয়া ও কলেরার চিকিৎসার জন্য অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছিল না বহু বঙ্গবাসীদের কাছে। তবে ডাক্তার বর্মনের তৈরী করা আয়ুর্বেদিক ওষুধ পাওয়া যেত সাশ্রয়ী দামে। প্রাণঘাতী রোগ নিরাময়ে দরিদ্রদের সাহায্যের জন্যই এই ঔষধের দাম কম রাখেন বর্মন বাবু। আগাগোড়াই আয়ুর্বেদের ওপর সবারই বিশ্বাস। ফলে সাশ্রয়ী আয়ুর্বেদিক ওষুধের জন্য ডাক্তার বর্মনের নামডাক শুরু হয় কলকাতার সীমানা পেরিয়ে দূর-দূরান্তের গ্রাম ও শহরেও। তবে কম সময়ে সকলের কাছে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। যার ফলে অন্য উপায় খুঁজে বের করলেন এস কে বর্মন। মেইল-অর্ডারের মাধ্যমে দূরের শহর-গ্রামের রোগীদের ওষুধ পাঠানোর পরিকল্পনা মাথায় আসে তাঁর।
'ডাবরে'র নামেই বাঙালিয়ানা :
১৮৮৪ সালে নিজের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার করেন ডাক্তার এসকে। যেহেতু কোম্পানির শুরুতে উদ্দেশ্য ছিল, কম দামে জনসাধারণের কাছে ডাক্তার এসকের তৈরী আয়ুর্বেদিক ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, তাই কোম্পানির নামে অর্থাৎ 'ডাবরে'র নামেই রাখা হয় 'ডাক্তারে'র ছোঁয়া। ডাক্তার এসকে বর্মন - এর ডাক্তারের থেকে 'ডা' এবং নিজের পদবি- 'বর্মনে'র প্রথম অংশের অক্ষর নিয়ে কোম্পানির নাম 'ডাবর'-ইংরেজিতে 'Dabur' রাখেন ড. এসকে বর্মন।
আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরী থেকে বহুজাতিক ভোক্তা পণ্য কোম্পানি :
ড. এসকের পর ডাবর কোম্পানির দায়িত্ব চলে যায় পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। প্রতিষ্ঠার তিন দশকেরও বেশি সময় পর, ১৯১৯ সালে, ডাক্তার এস কে-র সন্তান সিএল বর্মণ (CL Burman) ওষুধ নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য একটি ইউনিট স্থাপন করেন। ওষুধ উৎপাদন করার জন্য মেশিনও চালু করেন তিনি। সময়ের সঙ্গে ক্রমেই বড় হতে থাকে ডাবর কোম্পানির পরিসর। বাজারে আসতে থাকে আরও ভিন্ন রকমের অসংখ্য ডাবরের পণ্য (Dabur Products)। সিএল বর্মণের পর ধীরে ধীরে ডাবরের দায়িত্ব পেলেন সিএল বর্মনের দুই ছেলে পুরান ও রতন চাঁদ-র কাছে। পণ্য উৎপাদন অংশের দেখাশোনা করতেন পুরান, আর রতন তদারকি করতেন ওষুধ বিক্রির দিকে। তখনও পর্যন্ত কেবল ওষুধই তৈরী করতো ডাবর। তবে ১৯৪০-এর দশকে অন্যান্য পণ্য তৈরী করার পরিকল্পনার পথে হাঁটে এই বাঙালি কোম্পানি।
আজও বয়োজ্যেষ্ঠদের ডাবরের পণ্য (Dabur Products) এর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা ডাবরের আমলা তেলের নামটাই আগে নেবেন। কারণ ওষুধ তৈরীর পর সর্বপ্রথম আমলা দিয়ে চুলের তেল উৎপাদন শুরু করে ডাবর। কেবল বাংলাতেই নয়, গোটা ভারতে আমলা দিয়ে সর্বপ্রথম তেল তৈরি করে যে কোম্পানিটিই। নতুন প্রজন্মের হাত ধরে 'নতুনে'র সঙ্গে বেড়ে উঠছিলো ডাবর। বর্মন পরিবারের তিন প্রজন্মের সকলেই প্রতিদিন খাবার খাওয়ার সময়ে একসঙ্গে বসতেন এবং ডাবরের ব্যবসা কীভাবে আরও পরিসর করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা করতেন। বর্মণ পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা ছোটদের ব্যবসা চালানো শেখাতেন। পর পর প্রজন্ম ধরে এই প্রথাই চলতে থাকে।
কলকাতার বাইরে স্থানান্তর :
১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০-এর দশকে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে কলকাতা। তৎকালীন সময়ে পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন দানা বাঁধছিল। র্একদিকে যেমন ট্রেড ইউনিয়নগুলোও অত্যন্ত শক্তিশালী এবং আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছিল। অন্যদিকে শ্রমিকরা ব্যবসায়ীদের তাদের শ্রেণীশত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করছিলেন। সমগ্র পরিস্থিতির প্রভাব পড়ছিলো শিল্প-কারখানার ওপর। যার ফলে বিখ্যাত বিড়লা গ্রুপ এবং স্টেট ব্যাংক অভ ইন্ডিয়ার মতো একে একে কোম্পানিগুলি কলকাতা থেকে তাদের প্রধান কার্যালয় অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায়। এই ঘটনা থেকে ব্যতিক্রম ছিল না ডাবরও। বর্মন পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় উত্তরে, নয়াদিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হবে ডাবরের প্রধান কার্যালয়। সেই মতো ১৯৭২ সালে ডাবরের প্রধান কার্যালয় সরিয়ে নেওয়া হয় নয়া দিল্লিতে। সেখান থেকেই চলতে থাকে ডাবর কোম্পানি। ১৯৯৮ সাল নাগাদ বর্মণ পরিবারের চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের হাতে চলে যায় ডাবরের দায়িত্ব। এরপর আরও বাড়তে থাকে ডাবরের পণ্য তালিকা (Dabur Product List)। চুলের তেল, চ্যবনপ্রাশ থেকে শুরু করে টুথপেস্টসহ নানা পণ্য তৈরি করতে আরম্ভ করে ডাবর।
বিজনেস স্ট্র্যাটিজি :
প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করলেও, পণ্য সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও ব্যবসায় বিশেষ লাভ করছিলো না ডাবর। ফলে বিশেষজ্ঞর পরামর্শের খোঁজে বর্মন পরিবার পৌঁছায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির কাছে। এই কোম্পানি বর্মন পরিবারের ব্যবসা পরিচালনার ধারণা থেকে কিছুটা অন্যরকমের পরামর্শ দেয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি বলে, বর্মণদের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ পরিবারটিকে কোম্পানির প্রতিদিনের পরিচালনায় অংশগ্রহণ করা বন্ধ করতে হবে। তার বদলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ফিন্যান্সিয়াল অফিসার-সহ অন্যান্য বড় বড় পদে বাইরে থেকে বা কোম্পানির মধ্যে থেকে পেশাদারদের নিয়োগ দিতে হবে। বর্মন পরিবার ডাবর থেকে বেতন না পেলেও তারা কোম্পানির শেয়ার পাবেন। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদেও বর্মণ পরিবারের সদস্যদেরও পদ বজায় থাকবে। পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমেই তারা কোম্পানির ভবিষ্যতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে কোনো নতুন পণ্য বাজারে আনা, সেটি কোন দেশ বা নতুন কোন শহরে বিক্রি করা হবে, উৎপাদন কেন্দ্র কোন জায়গায় স্থাপন করতে হবে এবং কী পরিমাণ উৎপাদন করতে হবে এই সমস্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বর্মণ পরিবারের বাইরের পেশাদারদের দিয়ে।
বর্মণ পরিবারের প্রজন্মগত ভাবে চলে আসা বিজনেস স্ট্র্যাটিজি থেকে অনেকটা আলাদা এই স্ট্র্যাটিজি ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। শুরুতে উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করা কঠিন হলেও হাল ছাড়েন নি বর্মন পরিবার। নানান ওঠা-পড়া নিয়ে এগোতে থাকে ডাবর। এই নয়া উদ্যোগ ধীরে ধীরে বর্মনরা এতটাই মেনে নেয় যে ২০০৯ সালে বর্মণ প্রজন্মের পঞ্চম প্রজন্ম আনন্দ বর্মণের কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালীন বাজারে নতুন ফ্লেভারের হাজমোলা আনার কথা ওঠে। তবে সেই ফ্লেভার খোদ আনন্দ বর্মণের পছন্দ হয় না, কিন্তু তা পছন্দ হয় তৎকালীন সিইও সুনীল দুগ্গালের এমনকি অন্যান্য কর্মীদেরও। ফলে হাজমোলার স্বাদ নিজের পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও সেটি বাজারে আনার সিদ্ধান্ত নেন আনন্দ বর্মণ এবং উল্লেখযোগ্যভাবে সেটি হয়ে ওঠে বেশ জনপ্রিয়।
ঘরে ঘরে 'ডাবর' :
বর্তমানে ডাবর কোম্পানির মালিক (Dabur Company Owner) বা চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন আনন্দ বর্মণ এবং ডাবর ইন্ডিয়ার ভাইস চেয়ারম্যান আছেন আনন্দ বর্মণের খুড়তুতো ভাই মোহিত মালহোত্রা। এছাড়াও বর্মণ পরিবারের একটি কাউন্সিল রয়েছে যা বর্মণদের এবং ডাবরের বোর্ড ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে ইন্টারফেস হিসাবে কাজ করে। তারা কৌশল নির্ধারণ করে। বর্মণ পরিবারের চার সদস্য-অমিত, মোহিত, আদিত্য ও সাকেত রয়েছেন পরিচালনা পর্ষদে।
ডাবরের মধু (Dabur Honey) হোক কিংবা মাজন, তেল, শ্যাম্পু, হাজমোলা, ডাবরের নানান পণ্য কম বেশি রয়েছে প্রায় সকল ভারতীয়র ঘরে। ডাবরের ভেষজ বা আয়ুর্বেদিক পণ্যের সংখ্যা ২৫০টিরও বেশি, যার মধ্যে রয়েছে কাশির সিরাপ ডাবর হনিটাস ও নারীদের স্বাস্থ্য টনিক ডাবর অশোকারিষ্ট-র মতো ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ। ডাবরের পণ্য তালিকা (Dabur Product List) তে রয়েছে ডাবরের মধু (Dabur Honey), হেয়ার কেয়ার, ওরাল কেয়ার, হেলথকেয়ার, স্কিনকেয়ার, হোম যত্ন ও খাবারের মতো নানান পণ্য। বর্তমানে কোম্পানিটি মূলত পাঁচটি ফ্ল্যাগশিপ ব্র্যান্ডের মাধ্যমে কাজ করে-প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যসেবা পণ্যের প্রধান ব্র্যান্ড হিসেবে ডাবর, প্রিমিয়াম পারসোনাল কেয়ারের জন্য ভাটিকা, হজমের জন্য হজমোলা, ফলের রস ও পানীয়ের জন্য রিয়েল এবং ব্লিচ ও স্কিনকেয়ার পণ্যের জন্য ফেম। ভারতের ১২টি স্থানে এবং দেশের বাইরে ৮টি উৎপাদন কারখানা তৈরী করা ডাবর এক সময়ে ছিল কলকাতার একটি গলির ছোট এক উৎপাদন কারখানা, এক ডাক্তারের স্বপ্ন।
- Related topics -
- দেশ
- ব্যবসায়ী
- বাঙালি
- সাফল্যের কাহিনী
- ভারত
- জীবন ও জীবনী
- বাণিজ্য