বিনোদন

Rabi Ghosh Biography | নেশা ছিল শরীরচর্চা, হতে চেয়েছিলেন বডিবিল্ডার! 'নায়কে'র চরিত্রে অভিনয় না করেই 'নায়ক' রবি ঘোষ!

Rabi Ghosh Biography | নেশা ছিল শরীরচর্চা, হতে চেয়েছিলেন বডিবিল্ডার! 'নায়কে'র চরিত্রে অভিনয় না করেই 'নায়ক' রবি ঘোষ!
Key Highlights

বডিবিল্ডার হতে চেয়েছিলেন সেরা বাঙালি অভিনেতা রবি ঘোষ। তবে বেছে নেন অভিনয় জগৎ। লিড চরিত্রদের ছাড়া বাকিদের দিকে নজর যায় না দর্শকদের। তবে কিছু কিছু এমন অভিনেতা রয়েছেন, যাঁরা নিজেদের অভিনয় দিয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করেছেন। তাঁর মধ্যে অন্যতম হলেন রবি ঘোষ।

পুরো নাম তাঁর রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। তবে বাংলা সিনেমা জগতে তথা গোটা বিশ্বেই তিনি পরিচিত 'রবি' নামে। আবার ভক্তদের কাছে তিনিই 'বাঘা', তিনিই 'হরিদাস', তিনিই 'ধনঞ্জয়'। বলা হয় যে চরিত্রই হোক না কেন, তিনি এমনভাবেই তা অভিনয় করতেন যেন মনেই হতো না চরিত্রটি কাল্পনিক। তবে প্রথমে কিন্তু সেই দক্ষ বাঙালি অভিনেতা (Bengali actor) হতে চেয়েছিলেন বডিবিল্ডার। খেতে পছন্দ করলেও, খুবই মেপে আহার করতেন। প্রিয় খাবার ছিল লুচিও পাঁঠার মাংস। এদিকে স্কুলের সহপাঠী ছিলেন উত্তম কুমারের ছোটভাই তরুণ চট্টোপাধ্যায়। বলা যেতে পারে বডিবিল্ডার হতে গিয়ে হয়ে যান অভিনেতা। চিনে নিন বাংলা সিনেমা জগতের অমর অভিনেতা রবি ঘোষ (Rabi Ghosh)কে।

শৈশব ও শিক্ষা :

২৪সে নভেম্বর ১৯৩১ সালে কোচবিহারে মামার বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন রবি ঘোষ (Rabi Ghosh)। রবি নামে পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি। রবি ঘোষের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বাংলাদেশের বরিশালের লোক। রবি ঘোষের বাবা জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার চাকরির সুবাদে পরিবার নিয়ে থাকতেন কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে। প্রথমে স্বাধীনতা পূর্বে কোচবিহার জেনকিন্স স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন রবি। এরপর ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৭ সালে কলকাতার 'সাউথ সাবাআরবান মেন স্কুল' থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। উল্লেখ্য, সেই সময়ে স্কুলে রবির সহপাঠী ছিলেন উত্তম কুমারের ছোটভাই তরুণ চট্টোপাধ্যায়, তথা অভিনেতা তরুণ কুমার। পরবর্তীতে এই দুই সহপাঠী মিলিয়েই একাধিক সিনেমা এমনকি প্রচুর মঞ্চনাটক করে জিতেছেন অসংখ্য দর্শকের মন।

ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ইন্টারপাস করে আশুতোষ কলেজ-এ গ্রাজ্যুয়েশনের জন্য ভর্তি হন রবি। তিনি আশুতোষ কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৯ সালে এবং সেই কলেজেরই নৈশ বিভাগ শ্যামাপ্রসাদ কলেজে বি.কম-এ ভর্তি হন। এরপর ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত তিনি ব্যাঙ্কশাল আদালত (Bankshall Court) এ কাজ করেন। তবে ব্যাঙ্কশাল আদালত (Bankshall Court) এ চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১ সালে সেসব পাট চুকিয়ে পাকাপাকি অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন রবি ঘোষ।

বডিবিল্ডার থেকে অভিনেতা রবি ঘোষ :

কৈশোর থেকেই রবি ঘোষ স্বপ্ন দেখতেন বডিবিল্ডার হবেন। সেভাবেই চলত তাঁর শরীরচর্চা। তাঁর শরীরের গঠন ও সৌষ্ঠবও ছিল দেখার মতো। নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন কলেজের ব্যায়ামাগারেই। কারণ রবির দু'চোখে তখন শুধু বডি বিল্ডার হওয়ার স্বপ্ন। তখনকার সময়ে একটা নিম্নমধ্যবিত্ত ছেলের বডি বিল্ডার হয়ে ওঠার স্বপ্ন ছিল বিশাল ব্যাপার। তবে অভাবের সংসারে ভাই-বোনদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার পর নিজের শরীরচর্চা বজায় রাখতে বেশি পুষ্টিকর খাবার, ফল, দুধ এসব খাওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা ঘোষদস্তিদার পরিবারের ছিল না। এদিকে তাঁর  বাবাও চাইতেন ব্যায়াম আর অভিনয়ের ভূত মাথা থেকে বার করে ছেলে চাকরিতে মনোযোগী হোক। মা অবশ্যই এই বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছেন ছেলেকে। 

 ছোটবেলার থেকে বডিবিল্ডিঙের সঙ্গে ভালোবাসা ছিল অভিনয়ের ওপরও। ফলে শরীর চর্চার সঙ্গে চলতো অভিনয়। কলেজে ভর্তি হয়ে বন্ধুদের নিয়ে রবি গড়ে তোলেন ‘বন্ধুমন’ নাটকের দল। মহড়া চলত আশুতোষ কলেজের ছাদেই। এরপর  চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে অভিনয় জগতের সঙ্গে যুক্ত হন পঞ্চাশের দশকে। ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে অভিনয়জীবন শুরু করেন তিনি। মাত্র ৩০ সেকেন্ডের অভিনয় ছিল রবি ঘোষের। কিন্তু তাতেই মন জিতে নেন পরিচালক উৎপল দত্তের (Utpal Dutt)। অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন মৃণাল সেনও (Mrinal Sen)।  এরপর অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শ মেনে উৎপল দত্তের নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত হন রবি ঘোষ। ১৯৫৯ সালের ৩১ সে ডিসেম্বর উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে এলটিজির নিবেদনে ‘অঙ্গার’ নাটকের প্রথম শো ছিল তাঁর।উল্লেখ্য, এই শোয়ের পাঁচদিন আগেই বাবাকে হারিয়েছিলেন অভিনেতা। কাছা গলায় দিয়ে অভিনয় করলেন প্রথম রজনীতে। তিনশো রাত্রির উপর ‘হাউসফুল’ থাকে ‘অঙ্গার’। মঞ্চে উৎপল দত্ত, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভা সেন, নিমাই ঘোষের মতো বিরাট মাপের অভিনেতারা থাকতেও এই নাটকের জন্য বছরের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার।

নায়ক না হয়েও 'নায়ক' রবি ঘোষ :

 সমসাময়িক নায়কদের চেয়ে অনেক সুগঠিত ছিল রবি ঘোষের শরীর। কিন্তু তখন নায়ক হওয়ার জন্য দরকার পড়ত অভিনয়ের, আর খানিকটা সুন্দর মুখেরও। অভিনয়ে সেরা হলেও উত্তম-সৌমিত্র-বসন্ত যুগে 'সুন্দর মুখ' ছিল না রবি ঘোষের। তাই পেলেন না রবি নায়কের রোল। বাবার ভবিষ্যৎ বাণীই সত্যি হল। কিন্তু অভিনয়টা তো খাঁটি, যেটা দিয়েই লেজেন্ড হয়ে উঠলেন তিনি। যে কোনও চরিত্রকেই 'কাল্পনিক' থেকে জীবিত করে তুলতেন তিনি। রবি ঘোষ কোনোদিনই নায়কের পাঠ পাননি। বহু সময়ে পোস্টারে উত্তম-সৌমিত্রর পাশে জায়গাও পেতেন না তিনি। তবে তাতে কিছুই যায় আসতো না তাঁর। অভিনয়টাই ছিল সব কিছু। নায়কের পাঠ না পেয়েও কিন্তু 'নায়ক' রবি ঘোষ। চলচ্চিত্রে খ্যাতনামা অভিনেতারা থাকতেও বহু ক্ষেত্রে দর্শকদের নজর কাড়তেন নিজের দিকে। হিন্দিতে যখন 'গল্প হলেও সত্যি'র রিমেকে 'বাবুর্চি'র চরিত্রে রাজেশ খান্না অভিনয় করলেন তখন 'সুপারস্টার হিরো ' হয়েও স্টারডমে যেন 'ধনঞ্জয়'ই এগিয়ে রইলেন। সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা, দীনেন গুপ্ত থেকে অঞ্জন চৌধুরী। সব ধারার ছবিতে দশকের পর দশক রবি ঘোষ অনন্য, কি কমেডি কি অন্যধারার অভিনয়।

কেবল 'ধনঞ্জয়'র ক্ষেত্রেই নয়। সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray)  গুপি গাইন বাঘা বাইন (Goopy Gyne Bagha Byne) ছোটদের সিনেমায় 'বাঘা'ও এক প্রকার নায়কই বটে। এক সময়ে ১৯৬৮সালে সত্যজিৎ রায়র নির্মিত গুপি গাইন বাঘা বাইন (Goopy Gyne Bagha Byne) চরিত্রে রবি ঘোষের অভিনয় চলচ্চিত্রজগতে একটি মাইলফলক। 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'য় পানু প্রাণকেষ্টর চরিত্রেও অসামান্য রবি ঘোষ। মৃণাল সেনের কোরাস সিনেমাটির শুরুতেও তাঁকে দেখা যায়। তরুণ মজুমদার অনেক ছবিতেই রবি ঘোষকে নিয়ে কাজ করেন, যেমন ঠগিনী, রূপসী, শহর থেকে দূরে৷। বিজয় বসুর 'বাঘিনী'র ভিলেন রোলেও রবি দুরন্ত। একে একে  অভিযান, অরণ্যের দিনরাত্রি, হীরক রাজার দেশে, গুপী বাঘা ফিরে এলো, পদ্মা নদীর মাঝি-সহ বেশকিছু উপমহাদেশখ্যাত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

পরিচালনা ও সম্মান :

সেরা বাঙালি অভিনেতা (Bengali actor) তালিকার ঊর্ধে থাকা রবি ঘোষ কেবল অভিনয়ই নয়, যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালনার সঙ্গেও। তিনি নিধিরাম সর্দার চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন। পাশাপাশি তিনি চলাচল থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। গুপী গাইন বাঘা বাইন চলচ্চিত্রে অনবদ্ধ অভিনয়ের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বিখ্যাত বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে অংশ নেন। রবি ঘোষ  ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

রবি ঘোষের অভিনয় তাঁর রক্তে ছিল। তবে নেশা ছিল শরীরচর্চা। চোখধাঁধানো বডি বিল্ডার হয়েও, সেটি বাংলা ছবিতে বিন্দুমাত্র ব্যবহার না করে, 'হরিপদ একজন বেঁটেখাটো সাদামাটা লোক'-সম রবি ঘোষ অভিনয়টাকেই তাঁর পেশিশক্তি বানিয়েছিলেন। তবে বডিবিল্ডারই হওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। অবশেষে হয়ে যান অভিনেতা। অবশ্য তিনি যে অভিনয় জগৎ বেছে নেনে তা সকলেরই সৌভাগ্য। তাঁর অভিনয় অতি সহজেই দর্শকদের মন কেড়েছে। হাস্যরসের মাধ্যমে বাস্তবিক ঘটনাগুলিকে তুলে ধরতেন দর্শকদের সামনে। সেই সময় নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে তাঁর নামও নেওয়া হতো। সাধারণত সিনেমায় লিড চরিত্রদের ছাড়া বাকিদের দিকে নজর যায় না দর্শকদের। তবে কিছু কিছু এমন অভিনেতা রয়েছেন, যাঁরা নিজেদের অভিনয় দিয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করেছেন। তাঁর মধ্যে অন্যতম হলেন রবি ঘোষ। তাঁর হাত ধরে পাল্টে গিয়েছিল বাংলা কমেডির স্টাইল। তবে তিনি কমেডির সঙ্গে সিরিয়াস চরিত্রেও নিজের অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছেন। এককথায় বলতে গেলে, সব চরিত্রই অবলীলায় দর্শকদের সামনে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন এই লেজেন্ডারি অভিনেতা।