Ratan Tata | বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের সম্পত্তির ৬৫ শতাংশই, ছিলেন মাটির মানুষ, জানুন কীভাবে রতন টাটা হয়ে উঠলেন ভারতের 'রতন'

Thursday, October 10 2024, 10:25 am
highlightKey Highlights

২০১৪ সালে, টাটা গ্রুপ আইআইটি বোম্বেকে ৯৫ কোটি টাকা অনুদান দেয় এবং গরিব মানুষ এবং সম্প্রদায়ের প্রয়োজনের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তির বিকাশের উদ্যোগ নেয়। মূলত সেই উদ্দেশ্যেই টাটা সেন্টার ফর টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন (টিসিটিডি) গঠন করা হয়। অন্তত ৩০টি স্টার্টআপ সংস্থায় বিনিয়োগ করেছেন টাটা। বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের সম্পত্তির ৬৫ শতাংশই। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় টাটা হল গড়ে তোলা হয় টাটা ট্রাস্টের ৭০ মিলিয়ন ডলার অনুদানে।


ভারত যেন  হারিয়ে ফেললো তার 'রতন'। ৯ অক্টবর, বুধবার রাতে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডির এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন শিল্পপতি রতন টাটা (Ratan Tata)। আজ পূর্ণ রাষ্ট্রী মর্যাদায় তাঁকে শেষ বিদায় জানানো হচ্ছে। পার্সি প্রথায় নয়, বরং বৈদ্যুতিন চুল্লিতে দাহ করা হবে রতন টাটার দেহ। তাঁর আগে জনসাধারণ যাতে তাঁর প্রতি শেষবারের মতো শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রতন টাটার শেষকৃত্যে অংশ নিতে আজ মুম্বই গিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এছাড়াও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে থেকে শুরু করে শরদ পাওয়ার, দেবেন্দ্র ফড়ণীস, উদ্ধব ঠাকরে সহ বহু রাজনীতিবিদ শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন রতন টাটাতে। আরও অনেক বিশিষ্টজন উপস্থিত হয়েছেন রতন টাটাকে শেষ বিদায় জানাতে। শিল্পপতি মুকেশ আম্বানিও পরিবার সমেত পৌঁছেছেন রতন টাটাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে। সেখানে যান হর্ষ গোয়েঙ্কাও। 

কেবল ভারতের অন্যতম শিল্পপতির জন্যই নয়, তাঁর দয়ালু মনোভাব, সমাজসেবা এবং দৃষ্টিভঙ্গির জন্য রতন টাটা মানুষের মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আপামর ভারতবাসীর নয়নমণি। প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ভারতের এই অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক গ্রুপের দায়িত্ব সামলেছেন। পেয়েছেন একাধিক সম্মান। জেনে নেওয়া যাক রতন টাটার জীবন কাহিনী এবং তাঁর সম্পর্কে কিছু আশ্চর্জনক তথ্য।

রতন টাটার জীবন কাহিনী :

১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর, বম্বের প্রসিদ্ধ পার্সি জরাথুস্ট্রিয়ান টাটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রতন টাটা। টাটা গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটার পালিত পুত্র রতনজি টাটার পুত্র নাভাল টাটার সন্তান রতন টাটা। মা সুনি টাটা ছিলেন জামশেদজির ভাইঝি। তাঁর নিজের ভাই জিমি টাটা ও সৎভাই নোয়েল টাটা। তবে ১৯৪৮ সালে মাত্র দশ বছর বয়সে তাঁর বাবা ও মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং তাই তিনি তাঁর ঠাকুমা, নওয়াজবাই টাটার কাছে বেড়ে ওঠেন। রতন টাটা অবিবাহিত। মজার ব্যাপার হল, চার বার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাঁর প্রায় বিয়ে হয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু নানা কারণে বিয়ে করতে পারেননি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে লস অ্যাঞ্জেলেসে কাজ করার সময়ে তিনি প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে ভারতও চিন যুদ্ধের কারণে মেয়েটির বাবা মা তাঁকে ভারতে পাঠানোর বিরোধিতা করেন। ফলে আর বিয়ে করেননি রতন টাটা।

রতন টাটা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মুম্বইয়ের ক্যাম্পিয়ন স্কুলে পড়াশোনা করেন, তারপরে ক্যাথেড্রাল এবং জন কনন স্কুল এবং সিমলার বিশপ কটন স্কুল সিমলায় পড়াশোনা করেন। তিনি ১৯৫৫ সালে নিউ ইয়র্ক সিটির রিভারডেল কান্ট্রি স্কুল থেকে ডিপ্লোমা লাভ করেন। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে নিজের আলমা মাটর কর্নেল ইউনিভার্সিটিকে ৫০ মিলিয়ন ডলার দান করেন টাটা। কর্নেলের দীর্ঘ ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় অঙ্কের ডোনেশন।

রতন টাটা ১৯৬১ সালে টাটা গ্রুপে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তবে তাঁর প্রথম কাজ ছিল টাটা স্টিলের শপ ফ্লোর পরিচালনা করা। টাটা স্টিলের কারখানায় সাধারণ কর্মী হিসেবে তাঁর কেরিয়ার শুরু। ১৯৯১ সালে টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হিসেবে প্রবাদপ্রতিম জে আর ডি টাটা পদত্যাগ করলে উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নেওয়া হয় রতন টাটাকে। তার আগে ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান রতন টাটা। 

২০০৪ সালে টিসিএস (TCS) প্রতিষ্ঠা করেন রতন টাটা। তাঁর নেতৃত্বে, টাটা গ্রুপ ইস্পাত প্রস্তুতকারক কোরাস, ব্রিটিশ মোটরগাড়ি সংস্থা জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার এবং ব্রিটিশ চা সংস্থা টেটলির সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা টাটা কোম্পানিকে সারা বিশ্বের নজরে নিয়ে আসে। ২০০৯ সালে তিনি ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে সস্তা গাড়ি তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন এবং ১ লক্ষ টাকা দামের টাটা ন্যানো বাজারে নিয়ে এসেছিলেন।  সেই বছরই টাটা ন্যানো গাড়ির প্রকল্পের মূল কারখানা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরকে বেছে নেন তিনি। সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানা তৈরি না হলে সেটি সরিয়ে নিয়ে যান গুজরাটের সানন্দে। তবে সেভাবে সাফল্য দেখেনি ন্যানো। কিন্তু সানন্দের কারখানায় তৈরি হচ্ছে টাটার ইলেকট্রিক গাড়ি টাইগর। 

২০১২ সালে টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হিসেবে সরে যান রতন টাটা। তাঁর জায়গায় আসেন টাটা গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক আংশিদার ও আত্মীয় সাপুরজি পালোনজি গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার সাইরাস মিস্ত্রি। যদিও ২০১৬ সালে সাইরাসকে সরিয়ে ফের অন্তর্বর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে টাটা গ্রুপের দায়িত্ব তুলে নেন তিনি। এরপর ২০১৭ সালে নটরাজন চন্দ্রশেখরনকে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নেন টাটা। এই সিদ্ধান্তে এই প্রথমবার টাটা পরিবারের একেবারে বাইরের কেউ পরিবারের এই পদে আসেন। 

রতন টাটা তাঁর সেবামূলক কাজের জন্যও পরিচিত ও সম্মানিত। তাঁর নেতৃত্বে, টাটা গ্রুপ ভারতের স্নাতক শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮ মিলিয়ন ডলারের টাটা স্কলারশিপ ফান্ডের ব্যবস্থা করে। ২০১০ সালে, টাটা গ্রুপ হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল (এইচবিএস) এ একটি এগজিকিউটিভ সেন্টার নির্মাণের জন্য ৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। ২০১৪ সালে, টাটা গ্রুপ আইআইটি বোম্বেকে ৯৫ কোটি টাকা অনুদান দেয় এবং গরিব মানুষ এবং সম্প্রদায়ের প্রয়োজনের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তির বিকাশের উদ্যোগ নেয়। মূলত সেই উদ্দেশ্যেই টাটা সেন্টার ফর টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন (টিসিটিডি) গঠন করা হয়। অন্তত ৩০টি স্টার্টআপ সংস্থায় বিনিয়োগ করেছেন টাটা। বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের সম্পত্তির ৬৫ শতাংশই। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় টাটা হল গড়ে তোলা হয় টাটা ট্রাস্টের ৭০ মিলিয়ন ডলার অনুদানে। ২০১৪ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিটউট অফ সায়েন্সের সেন্টার অফ নিউরোসায়েন্সে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য করে টাটা গোষ্ঠী। উদ্দেশ্য, এই বিপুল টাকায় আগামী পাঁচ বছরে অ্যালঝাইমার্সের চিকিৎসা গবেষণায় উন্নতিসাধন।  

এছাড়াও রতন টাটা সুপরিচিত সারমেয়দের প্রতি ভালোবাসার জন্য।জামশেদজি টাটার সময় থেকেই বোম্বে হাউসে বর্ষাকালে রাস্তার কুকুরদের ভিতরে ঢুকতে দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে। সেই ঐতিহ্য অব্যাহত রাখেন রতন টাটা। তাঁর বোম্বে হাউসের সদর দফতরে সাম্প্রতিক সংস্কারের পরে রাস্তার কুকুরদের জন্য একটি কেনেল রয়েছে। এই কেনেলে রাস্তার কুকুরদের জন্য খাবার, জল, খেলনা দেওয়া হয়। সেখানে একটি খেলার জায়গাও রয়েছে তাদের জন্য। এছাড়াও রাস্তায় থাকা অবহেলিত পশুদের জন্য নানানভাবে সাহায্য করেছেন রতন টাটা। 

রতন টাটা পদ্মভূষণ, পদ্ম বিভূষণ সম্মানে ভূষিত। এছাড়াও হার্ভার্ড, কার্নেগি, এমআইটি, কর্নেলের মতো সারা পৃথিবীর অসংখ্য প্রিমিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। এবার রতন টাটাকে ভারত রত্ন দেওয়ার দাবি উঠল মহারাষ্ট্র সরকারের তরফ থেতে। এই মর্মে একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বে মারাঠা ক্যাবিনেটে একটি প্রস্তাবনা পাশ করানো হয়েছে। পাশাপাশি জানানো হয়েছে, এই নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানানো হবে।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File