RD Burman | টুবলু থেকে কীভাবে হয়ে উঠলেন 'পঞ্চম'? আরডি বর্মনের জন্মবার্ষিকীতে ফিরে দেখা!
আরডি বর্মনের সংগীত পরিচালনার প্রথম কাজেই রেগে যান বাবা শচীন দেব বর্মন। বিয়ারের বোতলে ফুঁ দিয়ে বের করেছিলেন বিশেষ সুর।
নাম 'পঞ্চম' হলেও সুরে, গানে, প্রতিভাতে তিনিই প্রথম। যদি তিনি সংগীত জগতে না পা রাখতেন তাহলে হয়তো ভারতের সংগীত জগৎ বিশেষত হিন্দি গানের জগৎ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। ইনি হলেন, সবার প্রিয় পঞ্চম দা (Pancham Da) অর্থাৎ আরডি বর্মন (RD Burman)। পুজোর প্যান্ডেলে 'চোখে চোখে কথা বলো' না চললে যেন আসে না পুজো পুজো ভাব। 'মনে পরে রুবি রায়', 'যেতে যেতে পথে হলো দেরি'র মতো আরডি বর্মনের একাধিক গান আমাদের সকলের জীবনের সঙ্গে জড়িত। এই সব গানের স্রষ্টা আরডি বর্মনের জন্মবার্ষিকীতে ফিরে দেখা।
আরডি বর্মনের জন্ম । Birth of RD Burman :
১৯৩৯ সালের ২৭সে জুন তিলোত্তমার বুকে অর্থাৎ কলকাতাতে জন্ম নেন রাহুল দেব বর্মন (Rahul Dev Burman)। আরডির জন্ম থেকেই যোগ সুরের সঙ্গে। কারণ তৎকালীন সময়ে দেশের সংগীত জগতে ও সাধারণ জনতার মুখে একটাই নাম, শচীন দেব বর্মন (Sachin Dev Burman )। সংগীত জগতের প্রতিষ্ঠিত মুখ শচীন দেব বর্মন ও নামকরা গীতিকার মীরা দাশগুপ্তর (Meera Dasgupta) সন্তান আরডি বর্মন। আরডি বর্মনের বেড়ে ওঠা ৩৬/১ সাউথ এন্ড পার্ক, কলকাতা-২৯ এর ঠিকানায়। পড়াশোনা, খেলাধুলোর সঙ্গে জোরকদমে চলতে থাকে তাঁর গানের চর্চাও। ছোটবেলায় সংগীত শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ব্রজেন বিশ্বাস (Brazen Biswas), উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের (Ustad Alauddin Khan) মতো সংগীতজ্ঞদের।
সুরের জগতে পথ চলা আরডি বর্মনের । RD Burman's Step into the World of Music :
বাল্যকাল থেকেই সুরের প্রতিভা দেখতে শুরু করেন আরডি। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া 'ফ্যান্টুস' (Fantus) ছবিতে মাত্র নয় বছর বয়সেই একটি গানে প্রথম সুর দেন তিনি। এরপর ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া 'ছোটে নবাব' (Chhote Nawab) সিনেমার একটি গানেও সুর দিয়েছেন আরডি। এরপর 'চলতি কা নাম গাড়ি' (Chalti Ka Naam Gaadi), 'কাগজ কে ফুল' (Kagaj Ke Phool'), 'তেরে ঘোরকে সামনে' (Tere Ghar Ke Samne) ইত্যাদি ছবিতে বাবা শচীন দেব বর্মনের সহকারী হিসেবে কাজ করেন আরডি। তবে তাঁর সংগীত পরিচালক হিসেবে পথ চলা শুরু হয় ১৯৬৫ সালে।
প্রথম থেকেই বর্মনের এক গোছের ধারা থেকে বেরিয়ে নতুনত্বের প্রতি ছিল টান। চেয়েছিলেন গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে পশ্চিমী প্রভাব নিয়ে কাজ করার। আর সেই সুযোগই তিনি প্রথম পান অন্তরঙ্গ বন্ধু-অভিনেতা মেহমুদ সাহেবের (Mehmood Sahab) থেকে। 'ভূত বাংলা' (Bhoot Bangla) সিনেমায় প্রথম সুরের দায়িত্ব পান আরডি বর্মন। তৎকালীন সময়ে বিশ্ব সংগীত জগতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন এলভিস প্রেসলির (Elvis Presley) ট্যুইস্ট ড্যান্স (Twist Dance)। আরডিও হাঁটলেন এই ড্যান্সের পথে। প্রথম সুরকারের দায়িত্ব পেয়েই লিখলেন 'আও ট্যুইস্ট করে'। সুরও দেন তিনি গানে গলা দেন মান্না দে (Manna Dey)। প্রথম কাজেই বাজিমাত করলেন আরডি বর্মন। সকলেই আরডি বর্মনের গানের সঙ্গে উঠলেন মেতে। তবে আরডি বর্মনের কাজ নিয়ে বেশ রেগে যান বাবা শচীন দেব বর্মন। ছেলে এরকম ধরণের গান বাজারে চলবে না বলেই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শচীন দেব বর্মনের। তবে তৎকালীন সময়ে পুরোনো ধারা পাল্টে ফেলেছিলো ভারতের সংগীত জগৎ। সে বিষয়ে শচীন দেব বর্মনের আশ্বাস না থাকলেও নিজের কাজের ওপর আশ্বাস, ভরসা ছিল আরডি বর্মনের।
বর্মনের জীবনে 'আশা'-র আলো । RD Burman and Asha Bhosle :
পশ্চিমী প্রভাব টেনে দেশের হিন্দি, বাংলা উভয় গানের জগতই কাঁপাতে শুরু করেন আরডি বর্মন। 'আজা আজা ম্যায় হুঁ পেয়্যার তেরা', 'ও হাসিনা জুলফাওয়ালি জানে জাঁহা', 'ও মেরে সোনা রে'-র মতো একাধিক গানে জমে তখন গোটা দেশ। এক এক অনবদ্ধ গান, সুর সৃষ্টি করে আরডি বেরিয়ে আসেন বাবা শচীন দেবের ছায়া থেকে। ততদিনে তৈরী হয় আরডি বর্মনের নিজস্ব এক পরিচয়।
সত্তরের দশকে যখন আরডির সুর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন তাঁরই জীবনে আসেন নতুন সদস্য। ১৯৬৬ সালে রীতা প্যাটেল (Rita Patel) নামের এক অনুরাগীকে বিয়ে করেন আরডি বর্মন। তবে সুরের জগতের রাস্তার মতো এই রাস্তা মসৃণ ছিল না। বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে যায় স্ত্রীর সঙ্গে। তবে সেই অবস্থাতেও একের পর এক অনবদ্দ গান ও সুরের সৃষ্টি করেন আরডি বর্মন। বিবাহ বিচ্ছেদের পরেই লেখেন 'মুসাফির হুঁ ইয়ারো'। বহু বছর আগেও যেমন এই গান হয়ে উঠেছিল বিচ্ছেদের পরে প্রেমিক-প্রেমিকাদের সঙ্গী, আজও বিজয় রয়েছে সেই ধারাই।
তবে আরডির জীবন বদলাতে আসেন দেশের আরও এক রত্ন , সংগীত শিল্পী আশা ভোসলে (Asha Bhosle)। ১৯৮০ সালে আরডি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন আশাকে। এরপর নিজের সুরে ও স্ত্রী আশা ভোসলের কণ্ঠে তৈরী করেন পর পর হিট গান। যা আজও নবীন।
টুবলু থেকে 'পঞ্চম দা' । Story of Pancham Da :
দেশের সংগীত জগতে সংগীত শিল্পী, সুরকার ও অভিনেতাদের মধ্যে তিনি আরডি বর্মনের থেকেও বেশি পঞ্চম দা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। আরডির বাবা মায়ের আদরের টুবলু থেকে পঞ্চম হওয়ার পিছনেও রয়েছে সুর। এক সাক্ষাতে তিনি নিজেই বলেন, ছোটবেলায় যখন তিনি কাদতেন তখন নাকি তাঁর গলায় সপ্তসুরের পঞ্চম সুর অর্থাৎ পা বেরাত। সেখান থেকেই তার নাম পঞ্চম রাখা হয়। একাধিক সাক্ষাৎকারেও রাহুল দেববর্মণ জানিয়েছেন, এই নামটি তাঁকে দিয়েছেন অশোক কুমার (Ashok Kumar)।
তবে নাম সুরের কারণে হলেও অনেকের মতে রাহুল দেব বর্মন নাকি নিজের কর্মজীবনের গোড়াতেই বুঝে গিয়েছিলেন যে হিন্দি ছবির গানের জন্য তাঁর কণ্ঠ একেবারেই মানানসই নয়। কিন্তু তাতে দমিয়ে রাখেননি নিজের প্রতিভা। যে গানে যখন যেভাবে প্রয়োজন পড়েছে, নিজের ভোকাল কর্ড (Vocal Cord) বদলে সেই প্রয়োজন মিটিয়েছেন এবং মানুষের মন জয় করেছেন পঞ্চম দা। ভয়েস মডুলেশন (Voice Modulation) করে রাগী-কর্কশ স্বরটা নিজের ট্রেডমার্কই বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। যার সব থেকে অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে, 'শোলে' ছবির 'মেহবুবা' গানটি, 'হম কিসিসে কম নহিঁ' ছবির 'তুম কেয়া জানো' গানের মেডলি অংশ, 'পুকার' ছবির 'সমন্দর মে' বা 'অপনা দেশ' ছবির 'দুনিয়া মে' গানের প্রিলিউড।
কেবল গলার স্বর বদলেই নয়, নানা রকম আসবাব দিয়েও ভাজঁতেন সুর। বিয়ারের বোতলে ফুঁ দিয়ে বিশেষ রিদম তৈরি করেছিলেন শোলে' ছবির জনপ্রিয় গান 'মেহবুবা'র জন্য। 'ইয়াদোঁ কি বারাত' ছবির গান 'চুরা লিয়া'র শুরুতেই যে টুংটাং শব্দে সবাই মেতে ওঠে সেই শব্দ আরডি বর্মন এনেছিলেন কাপ-প্লেটে টোকা মেরে। এমনকিসহকারী মারুতি রাওয়ের পিঠে চাপড় মেরে সেই আওয়াজ ব্যবহার করেছিলেন 'ডার্লিং ডার্লিং' ছবির 'রাত গয়ি, বাত গয়ি সমঝো' গানে। এরকম কত না কি সুর, শব্দের খেল দেখিয়েছেন আরডি বর্মন।
তবে সুরের রূপকথা থিম যায় ১৯৯৪ সালে। মেট্রো ৫৫ বছর বয়সেই হঠাৎ অসুস্থতায় পরে না ফেরার দেশে চলে যান আরডি বর্মন। কথায় আছে, সংগীতশিল্পী, সুরকারদের মৃত্যু হয়না, কারণ তাঁরা বেঁচে থাকেন তাদের গানে-সুরে। ঠিক তেমনই আরডি বর্মন চলে গেলেও তাঁর সৃষ্ট এক এক গান, সুর আজও যেমন অমর তেমন তিনিও অমর।
- Related topics -
- বিনোদন
- আরডি বর্মন
- সঙ্গীতশিল্পী
- গান
- ভারত
- শহর কলকাতা