Netaji Subhas Chandra Bose | 'আমাদের একজন নেতাজী ছিলেন।' দুর্বিনীত হিটলারের রাজত্বে যিনি পত্তন করেছিলেন আস্ত এক ভারতীয় ফৌজের, কেমন ছিল সেই দুঃসাহসিক অভিযান?

Thursday, January 23 2025, 5:03 pm
highlightKey Highlights

৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩, নাৎজি সৈন্যে ভরা এক জার্মান সাবমেরিন রওনা দিলো মাদাগাস্কার এর দিকে। সাবমেরিনে ছিলেন এক ভারতীয়, নাম 'মাৎসুদা'। প্রায় আড়াই মাস পর তাঁকে এক জাপানি সাবমেরিনে তুলে দেওয়া হলো। কে ইনি? তিনি জাপানি সাবমেরিনেই বা উঠলেন কেন? এঘটনার শিকড় খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৪১এ। যখন ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিচ্ছে ভারতীয় সিংহেরা। তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আরেক পুরুষ সিংহ "সুভাষ চন্দ্র বোস "। ভারতবর্ষের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে স্বাধীনতার দিকে।


৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩, এক জার্মান সাবমেরিন রওনা দিলো মাদাগাস্কার এর দিকে। নাৎজি সৈন্যে ভরা সেই সাবমেরিনে ছিলেন এক ভারতীয়, নাম 'মাৎসুদা'। প্রায় আড়াই মাস পর তাঁকে এক জাপানি সাবমেরিনে তুলে দেওয়া হলো। কে এই ভারতীয়? তিনি জাপানি সাবমেরিনেই বা উঠলেন কেন? এ ঘটনার শিকড় খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৪১ সালে!

মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তির মধ্যে একদিকে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অন্যদিকে ভারতে চলছে স্বাধীনতার লড়াই। কলকাতায় এলগিন রোডের বাড়িতে গৃহবন্দী রয়েছেন সুভাষ চন্দ্র বোস। বাড়ির চারপাশে সশস্ত্র পাহারা। সুভাষ ঠিক করলেন পালাতে হবে! ভারতকে স্বাধীনতা পাইয়ে দিতে গেলে চাই বহিঃশক্তির অনুমোদন, সৈনবল। জার্মানি কিংবা জাপানের মত দেশ যদি একবার ভারতকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে দেয় তবে ইংরেজদের তাড়ানোয় কোনো বাধা থাকবে না। যেমন কথা তেমন কাজ! কখনও ট্রাভেলিং ইন্সপেক্টর, কখনও মুখ বধির আফগান ছদ্মবেশে ইংরেজ সরকারের হাতের মুঠো থেকে পালিয়ে নেতাজি পৌঁছলেন কাবুলের সোভিয়েত এম্ব্যাসিতে। তবে সেখান থেকে কোনো সাহায্য মিললো না। ততোদিনে টনক নড়েছে ব্রিটিশ সরকারের। গুপ্তচর পাঠিয়ে তাঁকে খুনের পরিকল্পনা করলেও ব্যার্থ হলো ব্রিটিশরাজ। ইতিমধ্যেই আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া হয়ে জার্মানি পৌঁছোলেন সুভাষ। মাথায় তখন একটাই চিন্তা— স্বদেশের স্বাধীনতা!

Trending Updates

 প্রায় ১ বছর চেষ্টা করার পর হিটলারের সাথে দেখা করতে পেরেছিলেন সুভাষ। তাকে জানিয়েছিলেন ইতালি ও জাপান ভারতকে স্বাধীন দেশ ঘোষণা করতে রাজি হয়েছে; এখন বাকি জার্মানি। কিন্তু হিটলার সেই পথে হাঁটলেন না। ভারত অনেকদূর, কোনো সাহায্যের বিনিময়েই তিনি সুভাষের প্রস্তাবে রাজি হলেন না। তবে হিটলারকে প্রভাবিত করলো সুভাষের ব্যক্তিত্ব। সুভাষকে তিনি জার্মানিতে নিজের কার্যকলাপ চালানোর অবাধ ছাড়পত্র দিলেন। এরই ফলস্বরূপ জার্মানি থেকে প্রথমবার ভারতে সম্প্রচারিত করা হয় ‘আজাদ হিন্দ রেডিও।’ ভারতবাসী জানলেন তিনি আছেন, তিনি চেষ্টা করছেন স্বদেশের স্বাধীনতার জন্যে।

সুভাষের ‘নেতাজি’ হওয়া:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে বহু ভারতীয় লড়াই করছিল। তাঁদের মধ্যে নাৎজিদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে জার্মানির কারাগারে আটক ছিল বহু ভারতীয়। সুভাষের অনুরোধে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হলো। এই বন্দীদের নিয়েই সুভাষ চন্দ্র বসু পত্তন করলেন তাঁর প্রথম সেনাবাহিনী। এরাই প্রথম সুভাষকে 'নেতাজি' হিসেবে সম্মোধন করা শুরু করলেন। সুভাষ পরিণত হলেন ' নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস' এ। এদিকে যত দিন যেতে লাগলো বিশ্বযুদ্ধ তত ভয়ানক আকার নিতে থাকলো। হিটলার এবং নাৎজি জার্মানি পরাস্ত হতে থাকলো। নেতাজি বুঝলেন এবার তাঁকে এদেশ ছাড়তে হবে। জাপানে তখন ছিলেন রাসবিহারী বোস। তাঁর আমন্ত্রণে জাপান যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলেন নেতাজি। বাহিনী গোটাতে থাকলেন। অবশেষে ১৯৪৩ এর ৯ই ফেব্রুয়ারি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপে এক জার্মান সাবমেরিনে করে পৌঁছলেন মাদাগাস্কার এর সমুদ্রতটে। একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ পাচার হয়ে গেলো জাপানিজ সাবমেরিনে।

জাপান ও নেতাজি :

১৬ই মে ১৯৪৩ এ জাপানের টোকিও পৌঁছন তিনি। দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী তোজোর সাথে। তোজো নেতাজিকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। সর্বসমক্ষে এক ভাষণে তোজো জানালেন ' ভারতের স্বাধীনতার জন্যে যেকোনো রকম সাহায্য করতে রাজি তিনি।' আজাদ হিন্দ রেডিওর মাধ্যমে এই খবর ভারতে পৌঁছলো। এর ফলে জাপান ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরী হলো। 

জাপানে রাসবিহারী বসুর তৈরী INA বাহিনীর কমান্ডার হন তিনি, বাহিনীর নতুন নামকরণ হয় 'আজাদ হিন্দ ফৌজ'। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তৈরী এই বাহিনীতে হিন্দু থেকে মুসলিম সব ধর্মের মানুষ যোগ দেন। এখান থেকেই তিনি বাহিনীর উদ্দেশ্যে 'দিল্লি চলো ' স্লোগান দেন। সিঙ্গাপুরে নতুন সরকার গঠন করেন নেতাজি। এর দু,মাস পর ১৯৪৩ এর ডিসেম্বরে জাপানিজ সরকার আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ থেকে ব্রিটিশদের তাড়াতে সক্ষম হন। এই দুটি দ্বীপ তাঁরা উপহার হিসেবে দেন নেতাজিকে। এই আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জই হচ্ছে ব্রিটিশ সরকারের শাসন থেকে মুক্ত প্রথম ভারতীয় ভূখণ্ড। এখানে স্বাধীন ভারতের পতাকাও উত্তোলিত হয়।

নেতাজির অন্তর্ধান :

এরপর জল গড়ায় অনেকদূর। নেতাজি বার্মাতে নিজের বাহিনী নিয়ে সরে যান। ১৯৪৫ এর মে মাসে জার্মানি বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়। তাঁর কিছুদিন পর হিরোশিমা নাগাসাকি পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পর জাপান আত্মসমর্পন করে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ১৭ই অগাস্ট দুপুরে নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের একটি সভা ডাকেন নেতাজি। সেদিনই দুপুরে তাঁর কিছু বিশ্বস্ত অফিসারদের নিয়ে বিমানে জাপানের তাইহোকুতে পৌঁছন তিনি। সেখান থেকে রাশিয়ার মাঞ্চুরিয়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। সেইমতো ১৮ই অগাস্ট তাইহোকু থেকে বিমান ওড়ে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে। শেষবারের মতো নেতাজিকে দেখা যায় বিমানে উঠতে। বিমান ওড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রবল বিস্ফোরণ ঘটে। যদিও নেতাজির মৃত্যু নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন বিমান দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি, ছদ্মবেশে বেঁচে ছিলেন আরো অনেক দিন। তবে প্রাথমিক অনুমান, এই বিস্ফোরণেই মৃত্যু হয় ভারতের বিস্ফোরক নেতা ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস' এর। এক যুগের অবসান ঘটে। ভারত হারায় এক বলশালী ব্যক্তিত্বের নেতাকে। যিনি বেঁচে থাকলে আজ হয়তো আপোষ নয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জয়গাথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকতো ইতিহাসের পাতায়।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File