জীবন ও জীবনী

নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদার জীবনকাহিনি,  Nawab Sir Syed Shamsul Huda biography in Bengali

নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদার জীবনকাহিনি,  Nawab Sir Syed Shamsul Huda biography in Bengali
Key Highlights

নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা অবিভক্ত বাংলার ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের প্রথম ভারতীয় মুসলিম প্রেসিডেন্ট। তিনি একাধারে ছিলেন আইনজীবী, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সংবাদপত্র সম্পাদক, বঙ্গীয় আইন পরিষদ ও বেঙ্গল এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য তথা কলকাতা হাইকোর্টের পূর্ববঙ্গের প্রথম বিচারপতি ।

জন্ম ও পরিবার ও শৈশব, Birth and parentage and childhood days 

সৈয়দ শামসুল হুদা ১৮৬২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার গোকর্ণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমানে 'গোকর্ণ নবাব বাড়ি কমপ্লেক্স' নামে পরিচিত। তাঁর পিতা সৈয়দ রিয়াজত উল্লাহ পেশায় ছিলেন আইনজীবী, তথা ফার্সী কবি, এবং তৎকালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দুরবীন পত্রিকার সম্পাদক।

তাছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত দুটো ফার্সী পান্ডুলিপি “ফাওয়াদ-ই-শামসিয়া” এবং “ইসতিলাহাতুল সুয়ারা” -র প্রনেতা হিসাবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অন্যদিকে নবাব শামসুর হুদার দাদা সৈয়দ শাহ শরাফত উল্লাহও ছিলেন একজন আইনজীবী এবং চট্টগ্রামে বিচার বিভাগের সাব-জজ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এক কথায় শামসুল হুদা উত্তরাধিকারী সূত্রে ঐসব গুনাবলীর অধিকারী হন। 

জ্ঞানার্জন, Education 

সৈয়দ শামসুল হুদা পিতার অধীনে নিজ বাড়িতেই  প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে আরবি, ফারসি, উর্দু, বাংলা এবং ইসলাম বিষয়ক জ্ঞান আহরণ করেছিলেন; এরপর তিনি ঐতিহ্যগত শিক্ষা সম্পন্ন করার জন্য কলকাতার হুগলি উচ্চ মাদ্রাসায় ভর্তি হন।

পরবর্তী সময়ে নবাব শামসুর ১৮৮৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ব্যাচেলর অফ আর্টস (বিএ) ডিগ্রি এবং ১৮৮৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের স্নাতক (বিএল) ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৮৮৯ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে থেকে ফারসি ভাষায় স্নাতকোত্তর (এমএ) ডিগ্রি লাভ করেন।  

আরও পড়ুন :  

কর্মজীবন, Career life 

সৈয়দ শামসুল হুদা প্রতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুসলিম পণ্ডিত হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

হুদা বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন এবং তাঁর সমসাময়িক প্রজন্মের সবচেয়ে বাগ্মী, স্পষ্টভাষী এবং শিক্ষিত মুসলমানদের একজন হয়ে উঠেছিলেন।  বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে মুসলিম পণ্ডিত, নেতা এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

হুদা ১৮৮৫ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় আরবি ও ফারসি ভাষার প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন, কিন্তু  দুই বছর পরই কলকাতা হাইকোর্টে আইন অনুশীলন করার জন্য মাদ্রাসা ত্যাগ করেন এবং ধীরে ধীরে রাজনীতিতে যুক্ত হন।

শামসুল হুদাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৯৪ সালে ফেলোশীপ প্রদান করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯০২ সালে তাঁকে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েই “ঠাকুর আইন অধ্যাপক” হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সেখানে অধ্যাপনার সময় দন্ডবিধি সংক্রান্ত আইন বিষয়ে তিনি যেসব ধারাবাহিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেইগুলো পরবর্তী সময়ে “ব্রিটিশ দন্ডবিধি আইন” (The Principle of the Low of Crimes in British India) শীর্ষক দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সেসময় থেকে তাঁর আইন অভিজ্ঞতার খ্যাতি দেশময় ছড়িয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন  :

রাজনৈতিক কার্যকলাপ, Political activities 

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৮৮৫ সালে কলকাতার হিন্দু নেতাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই রাজনৈতিক সংস্থার মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিম সহ ভারতের সমস্ত জনজাতিকে প্রতীকী করার প্রস্তাব করা হয়েছিল।  সিএসআই স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আবদুল লতিফ এবং সৈয়দ আমীর আলী সহ বিশিষ্ট ভারতীয় মুসলিম নেতারা প্রথমে এই রাজনৈতিক সংস্থাকে তাদের পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন।  কিন্তু পরবর্তীকালে হিন্দু কংগ্রেস নেতারা দেশভাগের চর্চা শুরু করেন। 

মুসলিম নেতারা ১৮৯৫ সালে কংগ্রেসের রাজনৈতিক মনোভাব এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে কলকাতা ইউনিয়নের দ্বিতীয় বার্ষিক সভা ডেকেছিলেন। সৈয়দ শামসুল হুদা "ভারতীয় রাজনীতি এবং মোহাম্মদীয়রা" শিরোনামে নিজের বক্তৃতায় ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক শাসন তুলে ধরেন এবং কংগ্রেসকে আরও ঐক্যবদ্ধ এবং কার্যকর রাজনৈতিক সংস্থা করার পরামর্শ দেন ও এর জন্য বিভিন্ন উপায় বলে দেন।

এইভাবে তিনি রাজনৈতিক সংলাপের শীর্ষে উঠে আসেন।  একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে হুদার প্রথম ভূমিকা ছিল ১৯০৫ সালের বাজেটের বিরোধিতা করা, যেখানে কলেজ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য খরচ ছিল মূলত কলকাতার নিকটবর্তী জেলাগুলির জন্য। 

তিনি পূর্ব বাংলার জন্যও এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয় বৃদ্ধির নীতির প্রস্তাব করেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এবং অভিজাত হিন্দুদের দ্বারা বিরোধিত হয়ে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের জন্য সুবিধাজনক প্রমাণিত হয়েছিল। তিনি ১৯০৪ সালে রাজশাহীতে প্রাদেশিক মহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন।  নবার শামসুর ১৯১১ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের নেতা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন , আবার ১৯১২ থেকে ১৯১৯ সাল অবধি হুদা বাংলার নির্বাহী পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। 

তিনি ১৯১৪ সালে নবাব  উপাধিতে ভূষিত হন।  নবাব শামসুর ১৯১৭ সালে কলকাতা হাইকোর্টে একজন বিচারপতি মনোনীত হন, বিচারপতি সৈয়দ আমীর আলীর পরে বাংলা থেকে দ্বিতীয় মুসলিম হিসেবে তিনি এই আসন দখল করেন।

মুসলিম শিক্ষার্থীদের প্রতি সদয়তা, Kindness towards muslim students 

বাংলার মুসলিম ছাত্রদের কঠিন সময়ে হুদা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন । তিনি কলকাতায় গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়গামী মুসলিম ছাত্রদের জন্য একটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।  ১৮৯৮ সালে এলিয়ট মাদ্রাসা ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠার জন্য, তিনি সরকারের কাছ থেকে তহবিলের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ পেয়েছিলেন। অবশিষ্ট ৫৪০০ টাকা নবাব আবদুল লতিফ মেমোরিয়াল কমিটি কর্তৃক অনুদান দেওয়া হয়।


পরবর্তী সময়ে তিনি মোটা অঙ্কের টাকা মঞ্জুর করেন এবং কলকাতায় মুসলমানদের জন্য একটি সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ৯০০০০০ টাকার জমি ক্রয় করেন।

১৯১৫ সালে, নবাব শামসুর নিজের পৈতৃক সম্পত্তিতে,  গোকর্ণ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যার নামকরণ তাঁর সমবয়সী মামার নামে করা হয়েছিল।  এটি ছিল নাসিরনগর উপজেলার হিন্দু ও মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথম সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়।

শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতন ও বিদ্বান হিসাবে সৈয়দ শামসুল হুদা নতুন সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন যার সম্বন্ধে তিনি নিজের ভাষায় লিখেছেন:
"আমি মনে করি, নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হওয়ার ফলে পূর্ববাংলার প্রতি সকলেরই ব্যক্তিগত মনোযোগ আকর্ষিত হয়েছে। বিভাগপূর্বকালে বিপুল পরিমাণ অর্থ কলকাতার অদূরে অবস্থিত জেলাসমুহে ব্যয় করা হতো। সেরা কলেজ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমুহ ভারতের রাজধানী অভ্যন্তরে অথবা তার কাছাকাছি এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন উভয় প্রদেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল, বাংলা এখন থেকে একাকী ঐ সকল সুবিধাদি পাওয়ার অধিকারী। আমরা বিগত বছরের সঞ্চিত অবহেলার এক ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকারী তাই আমরা যদি বড়অঙ্কের অর্থ নিজভূমের উন্নয়নের স্বার্থে রেখে দেয়ার দাবী করি তবে তাতে নিন্দা করার কিছু নেই।"

বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার বিকাশ,  Spread of journalism in bengali 

বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার বিকাশের ক্ষেত্রেও নবাব শামসুর হুদার বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি একটি বাংলা সংবাদপত্র ‘সুধাকর’ নামে প্রকাশ করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে ‘মিহির ও সুধাকর’ নামক সংবাদপত্রের প্রকাশনা স্বত্ব ক্রয় করেছিলেন। একজন ভারতীয় মুসলিমকে ১৮৮৯ সালে প্রথম ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘মহামেডান অবজারভার’-প্রকাশ করার জন্য তিনি আর্থিক সাহায্যও প্রদান করেছিলেন এবং নবাব নিজেই তা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

জীবনাবসান, Death

শেষ বয়সে নবাব শামসুর হুদা কলকাতার ২১১ নং লয়ার সার্কুলার রোডে থাকতেন।  তিনি ১৯২২ সালের ১৪ অক্টোবর পরলোক গমন করেন।  মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। তিলজলা পৌর কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল।

উপসংহার, Conclusion

নবাব সৈয়দ শামসুর হুদা নিজের সদয় মেজাজের দরুন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনেক বন্ধু বানিয়েছিলেন। তিনি অনেক উচ্চ দপ্তরে বিভিন্ন সেবা প্রদান করেছিলেন, কিন্তু বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এর শাসনকালে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে জনসাধারণের জন্য তাঁর সেবামূলক কাজ তাঁকে বিশেষ ভাবে স্মরণযোগ্য করে রেখেছে । অক্লান্ত এবং শক্তিশালী বীর রূপে, হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে নবাব শামসুর সকলের বিশ্বাসভাজন এক বিরল সম্মানের উল্লেখযোগ্য অধিকারী।

আরও পড়ুন  :

প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions

সৈয়দ শামসুল হুদা কবে জন্মগ্রহণ করেন?

১৮৬২ সালে।

সৈয়দ শামসুলের পিতা কে ছিলেন?

সৈয়দ রিয়াজত উল্লাহ।

সৈয়দ শামসুল হুদা কে?

নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা অবিভক্ত বাংলার সংস্কারকৃত লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের প্রথম ভারতীয় মুসলিম প্রেসিডেন্ট।

নবাব সৈয়দ শামসুল হুদার জীবনাবসান কবে হয়?

১৯২২ সালে।