জীবন ও জীবনী

Acharya Prafulla Chandra Ray | বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়! জানুন তাঁর সম্পর্কে নানান তথ্য!

Acharya Prafulla Chandra Ray | বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়! জানুন তাঁর সম্পর্কে নানান তথ্য!
Key Highlights

রসায়ন, বিজ্ঞান, শিক্ষা, মানবকল্যান, স্বাধীনতা সকলেই রয়েছে আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অনিস্বীকার্য অবদান। জানুন তাঁর সম্পর্কে কম চর্চিত বিষয়।

তাঁকে বলা হয় 'ভারতের রসায়নের পিতা' । তবে নিজের সাফল্য এবং অবদানের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন, তিনি নাকি ভুলবশত রসায়নবিদ হয়ে গেছেন। কেবল রসায়নবিদ হিসেবে বা 'বেঙ্গল কেমিক্যাল' (Bengal Chemical)  ও মার্কারির (Mercury) আবিষ্কার করার জন্যই নয়, তাঁর শিক্ষক হিসেবে, বৈজ্ঞানিক হিসেবে অবদান, এমনকি ভারতের স্বাধীনতায় তাঁর অবদানের জন্যও আজও গোটা  বিশ্ব জুড়ে তাঁর বহুল চর্চা। ইনি আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (Acharya Prafulla Chandra Roy)।

 গত ২রা আগস্ট ছিল আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ১৬২ তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৬১ সালের ২রা আগস্ট যশোর জেলার অন্তর্গত কপোতাক্ষ নদীর তীরবর্তী রাড়ুলী গ্রামে জন্ম নেন পি সি রায়।  পিতা হরিশ্চন্দ্র রায় এবং মাতা ভুবনমোহিনী দেবীর পুত্র আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়  ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত তুখোড় এবং প্রত্যুৎপন্নমতি। সাত ভাইবোনের মধ্যে প্রফুল্ল চন্দ্র ছিলেন তৃতীয় সন্তান। বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাকালীনই রসায়নে আগ্রহ দেখাতে থাকেন তিনি। ফলে এই পথেই হাটেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। 

অজৈব এবং জৈব নাইট্রেটের রসায়নে তার অবদান আজও গোটা বিশ্বে চর্চিত। এই 'মাস্টার অফ নাইট্রেটই' প্রমাণ করেন কীভাবে পারদের সঙ্গে লঘু নাইট্রিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় মার্কিউরাস নাইট্রেট তৈরি করা যায়। এছাড়াও, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, সালফার ঘটিত জৈব পদার্থ এবং প্লাটিনাম, ইরিডিয়াম কিংবা সোনা সম্বলিত জৈব রাসায়নিকের যৌগ তৈরি করে রসায়নের জগতে নতুন পথ দেখান আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র। আবিষ্কার করেছিলেন ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়এস্টার। কিন্তু এই সকল বিষয়ে কম বেশি আমরা সকলেই জানি। আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বিষয়ে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা জানেন না অনেকেই।

 ১. হেয়ার স্কুলে পড়াশোনা । Hair school student : 

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, প্রথমে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কিছু সময় বাদেই আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন তিনি।এর ফলে কয়েক বছরের জন্য তাঁকে স্কুল থেকে বিরতি নিতে হয়। এই সময়ে, তিনি আত্ম-অধ্যয়নে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।  

২. ডিগ্রীহীন কিংবদন্তি রসায়নবিদ । A legendary Chemist Without a Degree : 

স্নাতক ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৮৮২ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে (University of Edinburgh) গৃহীত হন। এমনকি সেখানে সম্মানজনক গিলক্রিস্ট পুরস্কার বৃত্তিও (Gilchrist Award Scholarship) পান তিনি। তৎকালীন সময়ে শুধুমাত্র ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেছিলেন আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। খাতায় কলমে ডির্গ্রী নয়, নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং কঠোর পরিশ্রম দাঁড়ায় তিনি তাঁর প্রতিভা গোটা বিশ্বকে প্রমাণ করেছিলেন এবং রসায়নে নতুন পথের দিশা দেখিয়েছিলেন।

৩. ইউরোপের বাইরে সর্বপ্রথম রয়্যাল সোসাইটি দ্বারা সম্মানিত । Honored by the Royal Society : 

ভারতীয় রসায়নবিদ এবং শিক্ষাবিদ প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ইউরোপের বাইরে প্রথম ব্যক্তি যিনি রয়্যাল সোসাইটি অফ কেমিস্ট্রি (Royal Society of Chemistry) দ্বারা স্থাপিত একটি রাসায়নিক ল্যান্ডমার্ক ফলক (Chemical Landmark Plaque)  দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন। এই ফলকটি রসায়নের ক্ষেত্রে তাঁর বিশাল অবদানের একটি প্রমাণ, যার মধ্যে রয়েছে ভারতে প্রথম ওষুধ কোম্পানির বিকাশ এবং দেশে আধুনিক রসায়নের প্রবর্তন। তার উত্তরাধিকার বিশ্বজুড়ে রসায়নবিদ এবং বিজ্ঞানীদের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

৪. প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্য সম্মানসূচক ডক্টরেট । Honorary Doctorate for Prafulla Chandra Roy : 

আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় অসংখ্য সম্মানসূচক ডিগ্রির প্রাপক ছিলেন। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রশংসা ছিল ১৮৮৭ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্য  ডক্টর অফ সায়েন্স ডিগ্রি (Doctor of Science degree)। তৎকালীন সময়ে এই ডিগ্রি বা সম্মানসূচক কারুর জন্যই পাওয়া অসাধারণ কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই সম্মানসূচক লাভ করে গোটা দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন তিনি।

৫. পরোপকারী পি.সি. রায়ের উত্তরাধিকার: নাগার্জুন পুরস্কার । Philanthropic P.C. Roy's Legacy: Nagarjuna Award : 

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অবদান রসায়ন, বিজ্ঞান বাদেও ছিল মানব কল্যাণে। একজন মানবহিতৈষী ছিলেন তিনি। পিসি রায়  নাগার্জুন পুরস্কারে (Nagarjuna Award) সম্মানিত হন। পুরস্কারের সঙ্গে তিনি পেয়েছিলেন অনুদানও। সেই অনুদান তিনি তুলে দেন  ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলের কল্যাণে। এই অনুদান প্রয়োজনীয় সংস্থান এবং ছাত্র ও শিক্ষকদের সহায়তা করে। রায়ের উদারতা এবং শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রতি প্রতিশ্রুতি, সম্প্রদায়ের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।  যার ফলে কেবল বিজ্ঞানে অবদানের জন্যই তাঁর মহত্বের জন্যও আজও তাকে সম্মান জানান গোটা ভারতবাসী।

৬. বেঙ্গল রিলিফ কমিটি । Bengal Relief Committee :

১৯২৩ সালে উত্তরবঙ্গের বিধ্বংসী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত গৃহহীনদের সাহায্য করার জন্য আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেঙ্গল রিলিফ কমিটি। এই কমিটি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ প্রদানের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিল। একাধিকমহর্ষির এই কমিটিতে অংশ নিয়েছিলেন এবং ত্রাণ সংগ্রহে হাত বাড়িয়েছিলেন। পিসি রায়ের প্রচেষ্টাতেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের জীবন পুনর্গঠন করতে পেরেছিলো।

৭. ভারতের প্রথম রসায়ন বিদ্যালয় । India's first chemistry school :

১৯২৪  সালে, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কেমিস্ট রে রূপান্তরিত কেমিস্ট্রি স্কুল ইন্ডিয়ান স্কুল অফ কেমিস্ট্রি (Chemistry Indian School of Chemistry) প্রতিষ্ঠা করেন, যা ভারতে রসায়নের অগ্রগতির জন্য নিবেদিত একটি অগ্রগামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত। এই স্কুলটি ছিল দেশের প্রথম রসায়ন স্কুল যা দ্রুত রসায়নের অধ্যয়নের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই স্কুল সারা দেশের শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করে। রায়ের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন একটি স্কুল তৈরি করার যা শিক্ষার্থীদের রসায়নের ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তিতে শেখার সুযোগ দেবে এবং সফল রসায়নবিদ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও জ্ঞান প্রদান করবে।

৮.  ভারতের প্রথম রসায়নের অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপক । India's first Temporary Assistant Professor of Chemistry : 

১৮৮৯সালে, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কলকাতার মর্যাদাপূর্ণ প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁকেই প্রথম ভারতে অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয়। এটি তাঁর কর্মজীবনের একটি প্রধান মাইলফলক ছিল। পাশাপাশি এই ঘটনা বিজ্ঞান ও শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘ এবং বিশিষ্ট যাত্রার সূচনা করেছিল।

বিজ্ঞান ও শিক্ষা জগতে আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। বিজ্ঞানের মাধ্যমে দেশের উন্নতি সাধন করা তথা পরাধীন ভারতীয়দের আত্মমর্যাদাকে বাড়ানোই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী বীরদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর সহানুভূতি। জাতিভেদ ,বাল্যবিবাহ ,পণপ্রথা প্রভৃতি হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন তিনি। ভূমিকম্প ,বন্যা ,দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয় তিনি অকাতরে দান করেছিলেন। ভারত স্বাধীন হলেও, আজও দেশের কোণায় কোণায় রয়েছে আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অবদান।