Kongthong Village | ভারতের এই গ্রামে গেলে শুনতে পাবেন ভিন্ন রকমের 'শিস'! 'শব্দ' নয়, গ্রামবাসীদের নাম এই সুর! জানুন 'হুইসলিং ভিলেজ' সম্পর্কে!

হুইসলিং ভিলেজ তথা কংথং গ্রামে সকল গ্রামবাসী তাদের একে অপরকে ডাকেন শিসের শব্দের মাধ্যমে। সৌন্দর্য্য উপভোগ করার সঙ্গে এই বিরল প্রথার সাক্ষী থাকতে যেতে পারেন হুইসলিং ভিলেজে।
জল-জঙ্গল-পাহাড়-ঝরনায় ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই গ্রামে গেলে প্রায়ই শুনতে পাবেন লম্বা শিসের শব্দ (Whistle sound)। পাখির কুহু ডাকের মতোই সুরেলা এই শিসের শব্দ কিন্তু আসলে আমার আপনার মতোই এক ব্যক্তির নাম! অবাক করা লাগলেও সত্যিই এরকম ঘটনার সাক্ষী মেঘালয়ের হুইসলিং ভিলেজ (Whistling Village) অর্থাৎ ‘শিসের গ্রাম’। এই গ্রাম তথা কংথং গ্রাম (Kongthong Village) এ সবাই সবাইকে শব্দ উচ্চারণের বদলে সুর করে নাম ডেকে থাকে।

শিলং থেকে প্রায় ৫৩ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত কংথং গ্রাম (Kongthong Village)। এখানের সৌন্দর্য ভোলার মতো নয়। চোখে লেগে থাকবে এখানকার সরল জীবন। শহুরে সব রমক ব্যস্ততাকে পিছনে ফেলে এই ভারতীয় গ্রাম (Indian Village) এর মানুষ নিজের ছন্দেই চলে। কান পাতলে শোনা যাবে পাখির আওয়াজ, গাছের পাতায় হাওয়ার দোলায় নতুন নানা শব্দ। সঙ্গে গ্রামবাসীদের শিস যেন উপরি পাওনা। এই গ্রামের বাসিন্দারা একে অপরকে নামে ডাকেন না। বরং শিস দিয়ে সুর করে ডাকেন। স্থানীয়দের ভাষায় একে বলে জিঙ্গরই লবেই। নবজাতকের জন্মের পর মা যে ঘুমপারানিয়া গান গেয়ে ওঠেন, সেটাই হয়ে যায় শিশুর নাম। সেই সুরই হয়ে ওঠে নবজাতকের পরিচয়। প্রতিটা মায়ের গলা সুর আলাদা হয়। তাই সেই সুর চিনতে খুব বেশি সমস্যা হয় না। এই গ্রামে বাস করেন প্রায় ৬৫০ জন মানুষ।
আরও পড়ুন : অর্কিড হাউস থেকে হেরিটেজ বাংলো-কাঞ্চনজঙ্ঘা সবই পাবেন এখানে! এবার শীতে কম দিনে ঘুরে আসুন তাকদাহ থেকে!
তবে কংথং গ্রামের প্রতিটা মানুষের দুটো করে নাম রয়েছে। একটা এই শিসের শব্দ (Whistle sound)। আর একটা খাতায়-কলমে ভাল নাম। ফলে, এক্ষেত্রে শিসের সুরকে ডাকনাম বললেও ভুল হবে না। আবার এই শিসের সুরও দু’প্রকার। একটা সংক্ষিপ্ত, যা খুব বেশি হলে ১০ সেকেন্ডের শিস। আর একটা দীর্ঘ, অর্থাৎ ৩০ সেকেন্ডের সুর। সাধারণত বনে-জঙ্গলে এবং পাহাড়ের এই শিসের সুর ব্যবহার করা হয় একে অপরে ডাকতে। বলা হয়, জন্মের সঙ্গে ব্যক্তি তার নিজস্ব বিশিষ্ট সুর নিয়ে জন্মান। যা মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় সেই সুর। এই গ্রামের প্রত্যেক মায়েরা তাদের সন্তানের জন্মের পরেই তার জন্য একেবারে আলাদা একটি শিসধ্বনি তৈরি করেন। এমন একটি ধ্বনি, যা ওই গ্রামে কারও নেই। আর সেই ধ্বনিই হবে তাঁর নাম। বলা ভালো স্থানীয় নাম। এই প্রথা বহু যুগ ধরেই চলে আসছে, যার ফলে মেঘালয়ের এই গ্রামের আরেক নাম হুইসলিং ভিলেজ (Whistling Village)।

মেঘালয়ের পূর্ব খাসি জেলায় অবস্থিত এই গ্রামের প্রথা চালু হয় তা জানা নেই কারোর। ওই গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, কেন এমন প্রথা চালু হয় তা স্পষ্টভাবে জানা নেই। তবে মনে করা হয় এই ভারতীয় গ্রাম (Indian Village) এর পূ্র্বপুরুষরা অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতেই এটা চালু করেছিলেন। বর্তমানে গ্রামের বাসিন্দারা সেই প্রথাই বজায় রেখেছেন। বলা বাহুল্য, এই গ্রামের পুরুষ ও মহিলাদের জন্য এই 'নামের' সুর আলাদা। মহিলাদের নামের সুর যেমন অনেকটা সুরেলা, সেখানের পুরুষদের নামের সুরে থাকে কিছুটা পুরুষালি ভাব। উল্লেখ্য, মেঘালয়ের এই গ্রামের এই বিরল এবং অভিনব সংস্কৃতির জন্যই মেঘালয়ের গ্রামটি সম্প্রতি উঠে এসেছে পৃথিবীর পর্যটন মানচিত্রে। এমনকি ওয়ার্ল্ড টুরিজম অরগানাইজেশন (World Tourism Organization) কংথং গ্রামকে বেছে নিয়েছে ‘বেড়ানোর সেরা গ্রাম’-এর তালিকার জন্যও। ভারতের আরও দু’টি গ্রামও নির্বাচিতের তালিকায় রয়েছে।

কংথং গ্রামের বাসিন্দারা সকলেই স্বনির্ভর। গ্রামবাসীরা মধু সংগ্রহ করে তা জৈব মধু রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় পারদর্শী। মধুই হয়ে ওঠে এই গ্রামের অত্যন্ত বিক্রয়যোগ্য পণ্য এবং রাজ্যের নিজস্ব পণ্যগুলির মধ্যে একটি, যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে এই গ্রামকে। নিজেদের গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সম্পদকে রক্ষা করতে গ্রামবাসীরা সদা তৎপর। গ্রামে রয়েছে পরিবেশবান্ধব পর্যটন ব্যবস্থা। কংথং যাওয়ার সেরা সময় অক্টোবর থেকে এপ্রিল। শিলং থেকে গাড়ি ভাড়া করে সোজা পৌঁছে যেতে পারেন হুইসলিং ভিলেজ। সময় লাগবে ঘণ্টা তিনেক। এই হুইসলিং ভিলেজে রাত্রিযাপনের জন্য ট্রাভেলার্স নেস্ট এবং ব্যাম্বু হাট রয়েছে। এখানে ঘুরতে গেলে মাথায় রাখেবন,পর্যটক-প্রিয় গ্রাম কংথং। কিন্তু ‘সুরের গ্রাম’-এর কিছু নিজস্বতা আছে। নিরিবিলি গ্রাম এটি। এছাড়াও পরিচ্ছনতা এই গ্রামের প্রধান সম্পদ। সুতরাং এমন কিছু করবেন না যাতে পরিচ্ছনতা, পরিবেশ নষ্ট হয়। এছাড়া গ্রাম ঘোরার সময় সঙ্গে একজন গাইড রাখলে ভালো হয়। গ্রামের মানুষ সুর বিনিময় করে কী কথা বলতে চাইছে, তা বুঝিয়ে দেবেন ওই গাইড। তা ছাড়া এখান থেকে কিছু ট্রেকিং রুট আছে। কাছেই রয়েছে লংস্ল্যাং ভিউপয়েন্ট। আশেপাশে কিছু ফল্সও আছে। কাছে- দূরে কিছু রুট ব্রিজও আছে। এগুলো সব হাঁটাপথ। উল্লেখ্য, শিসের নামকরণ বা শিসের মাধ্যমে কথা বলার সংস্কৃতি পৃথিবীর নানা দেশেই রয়েছে। তুরস্ক বা ক্যানারি দ্বীপের বিভিন্ন জায়গার এই সংস্কৃতি ইতিমধ্যেই ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে।