বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

Horseshoe Crab | ডাইনোসরের থেকেও বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে বসবাস! হর্সশু কাঁকড়ার এক লিটার নীল রক্তের দাম ১১ লক্ষ কেন জানেন?

Horseshoe Crab | ডাইনোসরের থেকেও বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে বসবাস! হর্সশু কাঁকড়ার এক লিটার নীল রক্তের দাম ১১ লক্ষ কেন জানেন?
Key Highlights

হর্সশু কাঁকড়া প্রায় ৪৫ কোটি বছর আগে থেকেই পৃথিবীতে রয়েছে। এর নীল রক্ত ওষুধ, প্রতিষেধক এবং জীবাণুমুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের পরীক্ষায় অমূল্য রতনের মতো ব্যবহৃত হয়। জানুন এই সুপ্রাচীন জীব সম্পর্কে।

নানান আশ্চর্যের সমাহার আমাদের পৃথিবী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য করে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র। বিজ্ঞান মতে পৃথিবীতে ৮.৭ মিলিয়ন রকমের উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তবে এর মধ্যে মানবজাতি কেবল ১.২ মিলিয়ন প্রকার জীবকেই শনাক্ত করতে পেরেছে। এই ১.২ মিলিয়ন জীবের মধ্যে যেমন রয়েছে গাছপালা, পোকামাকড়, স্থলজীব তেমনই রয়েছে অসংখ্য সামুদ্রিক জীব ও গাছপালা। বলা হয় পৃথিবীর স্থলভাগের থেকে জলভাগের অধিকাংশ এখনও সম্পূর্ণভাবে আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি মনুষ্য জাতি। কারণ সমুদ্রের মধ্যে একটা সীমা পর্যন্তই যেতে পারে মানুষ। ফলে সীমা ছাড়িয়ে আর কী কী প্রাণীর বসবাস রয়েছে তা অজানা। এমনকি যেসব সামুদ্রিক জীব শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে সেইসব জীব সম্পর্কেও সবাই অবগত নন। এরকমই এক প্রাণী হলো হর্সশু কাঁকড়া (Horseshoe Crab)। ভাবছেন হয়তো কাঁকড়া তো সবাই চেনে, এতে নতুন কী? আসলে এই কাঁকড়া ডাইনোসরের চেয়েও বেশি পুরাতন। কমপক্ষে ৪৫০ মিলিয়ন বছর ধরে এই গ্রহে বসবাস করছে তারা। এখানেই চমক শেষ নয়, এই কাঁকড়ার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল আমি-আপনি-মানব জাতিও! এই কাঁকড়ার এক লিটার রক্তের দাম ১১ লক্ষ টাকা!

হর্সশু কাঁকড়া । Horseshoe Crab :

ডায়নোসর আসার প্রায় ৪৫ কোটি বছর আগে থেকেই পৃথিবীতে রয়েছে এই হর্সশু কাঁকড়া। অশ্বক্ষুরের ন্যায় দেখতে উপবৃত্তাকার এই কাঁকড়াটিকে কাঁকড়া বলা হলেও প্রজাতিগত দিক থেকে মাকড়সার সঙ্গে বেশি মিল রয়েছে এটির। আর এই কাঁকড়ার নীল রক্তই বহুমূল্য। সাধারণত সামুদ্রিক কাঁকড়া (Sea Crab) যেমন দেখতে হয় তার থেকে অনেকটাই আলাদা। শরীরের পাশে যেন ঘোড়ার নালের আকৃতি। এমনই এক বিলুপ্তপ্রায় কাঁকড়া প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে, পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু গত প্রায় ৫-৭ বছর ধরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে তারা।

এই হর্সশু কাঁকড়াগুলিকে সাধারণত জীবন্ত জীবাশ্ম হিসাবে উল্লেখ করা হয়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এরা এদের রূপবিদ্যা কমবেশি অপরিবর্তিত রেখেছে। বিজ্ঞান অনুযায়ী, এই বিশেষ জীবটি প্যালিওজোয়িক যুগে অর্থাৎ প্রায় ৫৪০ থেকে ২৪৮ মিলিয়ন বছর আগে, ট্রিলোবাইটের সঙ্গেই বিবর্তিত হয়েছিল। ট্রাইলোবাইট নামক আদিম আর্থ্রোপড প্যালিওজোয়িক যুগের শেষে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু হর্সশু কাঁকড়াটি প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরের বিলুপ্তি, ক্রিটেসিয়াস-টারশিয়ারি (কেটি) বিলুপ্তির ঘটনা-সহ বেশ কয়েকটি গণবিলুপ্তি থেকে বেঁচে গিয়েছিল।

কোথায় দেখতে পাওয়া যায় হর্সশু কাঁকড়া?

এই হর্সশু কাঁকড়া সাধারণত বাংলার উপকূলরেখা বরাবর অগভীর উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করে। এ ধরনের মেরিন চেলিসেরেট আর্থ্রোপড প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এখন নৃতাত্ত্বিক কার্যকলাপ, সামাজিক এবং পরিবেশগত কারণে এরা ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। চারটি হর্সশু কাঁকড়ার চারটি ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে দু’টি পাওয়া যায় ভারতে (India)।  এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বকখালী সমুদ্র সৈকত (Bakkhali Sea Beach), নামখানা (Namkhana) ও দীঘা সৈকত (Digha Beach) এও এই ধরণের কাঁকড়ার দেখা পাওয়া গিয়েছিলো। ভারতে যে ধরণের হর্সশু কাঁকড়া দেখতে পাওয়া যায় তা হল - Tachypleus Gigas এবং Carcinoscorpius Rotundicauda ৷

২০১৪-১৫ সালে ভারতের জুওলজিক্যাল সার্ভে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে বলা হয়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের কিছু এলাকায় ট্যাকিপ্লাস গিগাস পাওয়া যায় যথেষ্ট পরিমাণে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বকখালী সমুদ্র সৈকত (Bakkhali Sea Beach), ক্যানিং, নামখানা (Namkhana) এবং সাগর দ্বীপপুঞ্জের উপকূলরেখা বরাবর প্রায় ১০০টি কাঁকড়া দেখা গিয়েছিল। পাশাপাশি পূর্ব মেদিনীপুর উপকূল বরাবর দীঘা সৈকত (Digha Beach), শঙ্করপুর, মন্দারমণিতে এই সংখ্যাটা ছিল ২০০-৩০০। কিন্তু মনুষ্য জাতির কারণে বিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে তারা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হর্সশু কাঁকড়ার সংখ্যা হ্রাসের পিছনে প্রাথমিক কারণ হল উপকূলের ক্ষয় এবং নৃতাত্ত্বিক কার্যকলাপ। মহিলা কাঁকড়া প্রজননের জন্য একটি বালুকাময় স্তর পছন্দ করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলে পলির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই তারা এই এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত বাঁধ, যান্ত্রিক নৌকার ব্যবহার এবং চিনা মাছ ধরার জালের কারণে প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যায়।

ভারত সরকারের বায়োটেকনোলজি বিভাগের তরফে করা সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায়, এই অঞ্চলগুলিতে মাত্র একটি বা দুটি পুরুষ কাঁকড়া রয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে দিঘায় ২৩৬টি ট্যাকিপ্লাস গিগাস পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে প্রায় ১৮০টি কাঁকড়া দম্পতিকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল। শঙ্করপুরে ছিল মোট ১৬১ কাঁকড়া, এর মধ্যে প্রায় ১২০টি কাঁকড়া দম্পতি চিহ্নিত করা গিয়েছিল। সাগর দ্বীপে ৬৭টির মধ্যে প্রায় ৩২টি দম্পতি এবং ফ্রেজারগঞ্জে ৫৯টির মধ্যে প্রায় ২০টি দম্পতি চিহ্নিত করা হয়েছিল। একই সময়ে প্রেন্টিস দ্বীপে ৮১টির মধ্যে ৪০টি মিলন জোড়া দেখা গিয়েছিল। ক্যানিংয়ে মোট ৭৪টির মধ্যে প্রায় ৩০টি মিলন জোড়া পাওয়া যায়। এই জরিপটি মূলত বর্ষার পর থেকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস করা হয়। কিন্তু গত দুই বছরে, এই অঞ্চলে কোনও মিলন জোড়া দম্পতির খোঁজ মেলেনি এবং এমনকী, পুরুষ কাঁকড়ার সংখ্যাও বাংলার উপকূলে একেবারেই কমে গিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

চিকিৎসার ক্ষেত্রে হর্সশু কাঁকড়া ও নীল রক্ত :

শুধু প্রাগৈতিহাসিক বৈশিষ্ট্যই নয়, বরং এই বিশেষ প্রজাতির কাঁকড়ার রক্ত ওষুধ, প্রতিষেধক এবং জীবাণুমুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের পরীক্ষায় একটি মূল্যবান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।  যার ফলে এই কাঁকড়ার এক লিটার রক্তের দাম প্রায় ১১ লক্ষ টাকা। হর্সশু কাঁকড়ার মিল্কি-নীল রক্তে লিমুলাস অ্যামিবোসাইট লাইসেট (LAL) নামে একটি বিশেষ জমাট বাঁধা পদার্থ থাকে, যা ওষুধের নমুনাগুলিতে এন্ডোটক্সিন (endotoxin) নামক একটি দূষক শনাক্ত করে। এই রক্তের অসাধারণ ক্ষমতার জন্য লিমিউলাস বা অশ্বক্ষুরাকৃতি কাঁকড়ারা যে কোনও ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং বিষাক্ত পদার্থ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই রক্তের গুরুত্ব অপরিসীম। কাঁকড়ার রক্তে অ্যামিবোসাইট আছে। এই অ্যামিবোসাইটে মাত্র এক লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগ ব্যাকটিরিয়ার উপস্থিতিতে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। যেখানে স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে সময় লাগে ৪৮ ঘণ্টা।

এই Limulus amebocyte lysate বা LAL ব্যবহার শুরু হয় সত্তরের দশকে। বিজ্ঞানীরা ১৯৭০ সাল থেকে চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম এবং ভ্যাকসিনে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিত পরীক্ষায় করতে এই সামুদ্রিক কাঁকড়া (Sea Crab)এর  রক্ত ব্যবহার করছে। এই রক্তের অসাধারণ ক্ষমতা বলে যেকোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং বিষাক্ত পদার্থ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। সামান্যতম ব্যাকটিরিয়ার উপস্থিতিও তাই বুঝতে পারে এটি। চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বা ভ্যাকসিনেও ব্যাকটিরিয়ার উপস্থিতি পরীক্ষায় ব্যবহার হয় এটি।

মেরুদণ্ডী প্রাণীরা সাধারণত হিমোগ্লোবিনে লোহার উপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রক্তে অক্সিজেন পরিবহণ করে থাকে। কিন্তু এই ধরণের কাঁকড়া ও এদের মতো জীবদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আলাদা। এরা হিমোসায়ানিনের সাহায্যে অক্সিজেন পরিবহণ করে। এতে তামার উপস্থিতির কারণে রক্তের রঙ নীল হয়। আর এই নীল রক্তই প্রতিষেধক, ওষুধ এবং চিকিৎসা ডিভাইস পরীক্ষা করতে এক অমূল্য সম্পদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ২০২০ সালের জুলাই মাসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দ্বারা প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ প্রতিষেধক চালু করার জন্য এই কাঁকড়ার রক্তই চাবিকাঠি ছিল। অধ্যাপক বিশ্বাসের মতে, গত দুই বছরে, কোভিড ভ্যাকসিনের একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ ছিল এন্ডোটক্সিন সনাক্তকরণের পরীক্ষা। এলএএল সমৃদ্ধ হর্সশু কাঁকড়ার রক্ত ছিল ত্রাণকর্তা। গত কয়েক দশক ধরে, ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প যে কোনও প্রতিষেধক বা ওষুধে এন্ডোটক্সিন শনাক্তকরণের জন্য একটি অনন্য ভূমিকা পালন করে এসেছে।

প্রতি বছর প্রায় ছয় লক্ষ কাঁকড়া ধরা হয় আমেরিকার সমুদ্রতট থেকে। এর মধ্যে তাদের থেকে ৩০ শতাংশ রক্ত নেওয়া হয়। এই কাঁকড়ার হৃদপিন্ডের কাছে সামান্য ছিদ্র করে ৩০% রক্ত বের করা হয়। এই প্রক্রিয়ার পর কাঁকড়াগুলোকে তাদের জায়গায় ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার কারণে ১০-২০ শতাংশ কাঁকড়া মারাও যায়, ফলে স্ত্রী কাঁকড়ারা প্রজননের সমস্যার মুখোমুখি হয়। ফলে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজার্ভেশন অব নেচার’ (Union for the Conservation of Nature) একে ‘ভালনারেবল’ বলে ঘোষণা করে ‘রেড লিস্ট’-এ রেখেছে। আগামী ৪০ বছরে আমেরিকায় এই কাঁকড়ার সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যাবে, জানিয়েছে আইইউসিএন। তবে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে এই প্রজাতির সংরক্ষণ।