International Education Day | ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় 'বিপ্লব' আনেন এই 'নায়ক'রা! জানুন সেইসব মহান ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে যারা ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় আনেন বদল!
শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছর ২৪সে জানুয়ারি পালিত হয় আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস। এদিন জানুন সেই সব মহান ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে যারা বদলে দিয়েছেন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানব জাতি যেমন উন্নত হচ্ছে, তেমনই উন্নত হচ্ছে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সমাজ। আর এই উন্নতির নেপথ্যে যে জিনিসের সবথেকে বেশি অবদান রয়েছে তা হলো 'শিক্ষা'। বর্তমানে সমাজের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে হলে নূন্যতম শিক্ষা অতি আবশ্যিক। আজ যেমন বিশ্বের প্রত্যেক অংশে শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, স্কুল-কলেজ রয়েছে এক সময়ে তা ছিল না। শিক্ষার অধিকারের জন্য বিশ্বের নানান স্থানে নানানভাবে বিপ্লব হয়েছে। যার ফল আজকের বিশ্বব্যপি শিক্ষা ব্যবস্থা। তবে এখনও অনেকেই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। ফলে বিশ্বব্যাপি শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে, বিশ্বে শান্তি এবং উন্নতি বজায় রাখতে এবং শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে সমাজে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছর ২৪সে জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস (International Education Day)।
আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসের তাৎপর্য । Significance of International Education Day :
২০১৮ সালের ৩রা ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (UNGA) প্রতি বছর ২৪ সে জানুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস' হিসাবে উদযাপনের জন্য প্রস্তাব পাস করে। এরপরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ২৪সে জানুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস পালন করা হয়। সেক্ষেত্রে জাতিসংঘ (UN)সাধারণ পরিষদ নাইজেরিয়া এবং অন্যান্য সদস্যের ৫৮টি রাষ্ট্র প্রস্তাবটির নেপথ্য ভূমিকায় ছিল। শান্তি, স্থায়ী উন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্ঠিগত কল্যাণের জন্য শিক্ষাকে আরও বিস্তার করার লক্ষ্যেই এই দিন পালন করা হয়। অর্থাৎ ব্যক্তি মানুষ তথা সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্যই শিক্ষার আরো বিকাশ ঘটাতেই আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস পালন করা হয়।
ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার বিপ্লবকারী 'নায়ক' । Revolutionary 'Heroes' of Indian Education System :
ভারতের শিক্ষার অধিকার এবং উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য এক এক যুগে এক এক 'নায়ক' এসে তাদের অবদান রেখেছেন। সকলের শিক্ষার অধিকার থেকে শুরু করে মহিলাদের শিক্ষার অধিকার, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা-আজ ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার নেপথ্যে অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে বেশ কিছু ভারতীয়র। এরকমই বেশ কিছু 'নায়ক'দের কথা এবং তাদের ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদান সম্পর্কে তুলে ধরা হলো।
ডাঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন । Dr. Sarvepalli Radhakrishnan :
ডাঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন (Dr. Sarvepalli Radhakrishnan) ভারতের অন্যতম সেরা শিক্ষক ছিলেন। দার্শনিক ‘ভারতরত্ন’ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনকে সম্মান, শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি দেশের সকল শিক্ষক সম্মান জানাতে তাঁর জন্ম তারিখ, অর্থাৎ ৫ই সেপ্টেম্বর ভারতে পালন করা হয় শিক্ষক দিবস। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র স্কুলে নয়, বাড়িতেও তাদের আলোকিত করেছিলেন। তিনি শিক্ষাকে একটি জীবনব্যাপী শেখার প্রক্রিয়া হিসেবে প্রচার করেছেন যা আত্ম-অন্বেষণ এবং স্ব-বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান একজন বিশিষ্ট দার্শনিক, একজন শক্তিশালী বক্তা, ভারতের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি ছিলেন দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এবং মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য তিনি শিক্ষায় বিরাট অবদান রেখেছিলেন।
মদন মোহন মালব্য । Madan Mohan Malaviya :
মদন মোহন মালবিয়া (Madan Mohan Malaviya) এর শিক্ষার একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি পুঁথিগত শিক্ষা ছাড়াও ছাত্রদের চরিত্র গঠনে খুব মনোযোগী ছিলেন। তিনি ছাত্রদের খুব কাছের এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শদাতা ছিলেন। মদন মোহন মালব্য ভারতীয় সংস্কৃতিকে অনেক মূল্য দিতেন। তিনি ভারতীয় এবং আধুনিক শিক্ষার পদ্ধতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি একটি বিখ্যাত ভারতীয় প্রতিষ্ঠান, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-প্রতিষ্ঠা করেন।
সাবিত্রীবাই ফুলে ও জ্যোতিরাও ফুলে । Savitribai Phule and Jyotirao Phule :
ভারতে মহিলাদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে বহু যুগ ধরে বহু ব্যক্তিত্ব আন্দোলন করে সমাজে পরিবর্তন এনেছেন। সাবিত্রীবাই ফুলে ছিলেন এরকমই ব্যক্তিত্ব যিনি মহিলাদের শিক্ষা ও লিঙ্গের সমান করার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। এমনকি সাবিত্রীবাই ফুলেই ভারতের প্রথম মহিলা শিক্ষক। তাঁর শিক্ষার পদ্ধতি সামাজিক ন্যায়বিচারের মধ্যে নিহিত ছিল এবং তিনি শিক্ষায় ভাষার ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সাবিত্রীবাই ফুলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বহুভাষিক করে তোলেন যাতে ভাষার ভিন্নতার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে কাউকে বঞ্চিত না হতেই হয়।
অন্যদিকে, সাবিত্রীবাই ফুলের স্বামী জ্যোতিরাও ফুলের অবদানও ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অনস্বীকার্য। তিনি মহিলাদের শিক্ষার অধিকারের জন্য ১৮৪৮ সালের আগস্টে, ফুলে পুনেতে শ্রী ভিড়ের বাড়িতে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় খোলেন। পাশাপাশি স্ত্রী সাবিত্রীবাই ফুলেকে শিক্ষার জন্য সর্বদা অনুপ্রেরণা দিতেন জ্যোতিরাও ফুলে। জ্যোতিরাও ফুলে ও সাবিত্রীবাই ফুলে মিলে মেয়েদের পাশাপাশি দলিত পরিবারের শিশুদের জন্য আরও ১৮টি বিদ্যালয় তৈরী করেন।
রাজা রামমোহন রায় । Raja Rammohan Roy :
সমাজকে উন্নত, শিক্ষক করতে এবং মহিলাদের অধিকার অর্জনে ও তাদের ওপর হওয়া পাশবিক অত্যাচার রুখতে রাজা রাম মোহন রায়ের অবদান (Raja Ram Mohan Roy contribution) সম্পর্কে যত বলা হয় তত যেন কম। বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রথার মতো কুসংস্কারিক মহিলাদের ওপর হওয়া অত্যাচার বন্ধ করতে গোটা সমাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রাজা রাম মোহন রায়। এর পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে এবং মহিলাদের শিক্ষার জন্য নানান পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। ভারতীয়দের পশ্চিমা বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন এবং চিকিৎসা শেখাতে বিশ্বাসী ছিলেন রাজা রাম মোহন রায়। ভারতীয় নারীদের শিক্ষা আগে থেকেই খ্রিস্টান মিশনারিদের লক্ষ্য ছিল, কিন্তু অভিজাত হিন্দুদের মধ্যে এই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করেছিলেন তিনি। রাজা রাম মোহন রায়ের অবদান (Raja Ram Mohan Roy contribution শুধুমাত্র হিন্দু কলেজ (পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ নামে পরিচিত), সিটি কলেজ এবং ঔপনিবেশিক কলকাতা জুড়ে অসংখ্য ইংরেজি স্কুলের মতো প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই নয়, নারীদের শিক্ষিত করা নেপথ্যেও রয়েছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । Ishwar Chandra Vidyasagar :
রাজা রাম মোহন রায়ের মতোই নারীদের অধিকার নিয়ে সমাজের সঙ্গে লড়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও। তিনি নারী শিক্ষা ভান্ডার নামে একটি তহবিল সংগঠিত করেছিলেন এবং পরিবারকে তাদের মেয়েদের স্কুলে ভর্তির অনুমতি দেওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে গিয়ে প্রচার চালাতেন। তিনি প্রায়ই হিন্দু দেশপ্রেমিক, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা এবং সোমপ্রকাশের মতো সমসাময়িক ইংরেজি এবং বাংলা প্রকাশনার মাধ্যমে নারী শিক্ষার জন্য প্রচারণা চালাতেন। তিনি শুধুমাত্র বাংলা জুড়ে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় খোলার পাশাপাশি ১৮৪৯ সালে ভারতের প্রথম স্থায়ী বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিলেন। এছাড়াও ছোটদের বর্ণাক্ষর শেখানোর জন্য তাঁর রচিত 'বর্ণ পরিচয়' এর ভূমিকা বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় আজও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
বি আর আম্বেদকর । BR Ambedkar :
ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ভারতীয় সংবিধানের প্রধান স্থপতি যিনি দেশের দলিত অধিকারের জন্য অন্যতম আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন। সকলকে শিক্ষাদান, নারীদের অধিকার, দলিতদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজে অধিকারের জন্য বি আর আম্বেদকরের অবদান অতুলনীয়। আম্বেদকর একই স্কুল এবং কলেজে পুরুষদের সঙ্গে শিক্ষিত হওয়ার জন্য মহিলাদের অধিকারের পক্ষে সমর্থন করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারী শিক্ষা তাদের দুটি উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে: তাদের নিজস্ব ক্ষমতায়ন, এবং তাদের মাধ্যমে অন্যদের ক্ষমতায়ন। তাঁর জোর ছিল সামাজিক মুক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার উপর যাতে হতাশ শ্রেণীগুলি তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মর্যাদা উন্নত করতে পারে।
ডাঃ এ পি জে আব্দুল কালাম । Dr. APJ Abdul Kalam :
ডাঃ এ পি জে আব্দুল কালাম বা 'মিসাইল ম্যানের' অবদান ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশেষত বিজ্ঞান ও মহাকাশ বিজ্ঞানের সাফল্য ও উন্নতির নেপথ্যে এক মেরুদণ্ডের মতো। তাঁর অনুপ্রেরণায় ও তাঁর অবদানের জন্যই ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (Indian Space Research Organization) বা ইসরো (ISRO) বিশ্বব্যাপী মহাকাশ বিজ্ঞানে ইতিহাস লিখছে। এপিজে আব্দুল কালামের শিক্ষা বিষয়ে উক্তি (Apj Abdul Kalam quotes on education) আজও যুবদের বড় অনুপ্রেরণা। ডাঃ এ পি জে আব্দুল কালামের শিক্ষার ভাষা হল সহানুভূতি। তিনি সর্বদা বিশ্বাস করতেন যে তরুণ প্রজন্ম কাঁচের ছাদ ভেঙে ভারতের মেরুদণ্ড হতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের জীবন গঠনের জন্য শেখার প্রতি ভালবাসা এবং আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিলেন তিনি। এপিজে আব্দুল কালামের শিক্ষা বিষয়ে উক্তি (Apj Abdul Kalam quotes on education) গোটা ভারত এমনকি বিশ্বের ছাত্রছাত্রীদের-যুবদের শিক্ষা ও আরও জানার জন্য উৎসাহ করেছিল এবং আজও করে। তিনি তাঁর ছাত্রদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শেখাতেও বিশ্বাস করতেন।
প্রসঙ্গত, উপরোক্ত ব্যক্তিত্ব ছাড়াও ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা, মহিলাদের শিক্ষার অধিকারের জন্য অসংখ্য মানুষ অবদান রাখেন। তবে আজও ভারতের বহু অংশে শিক্ষার নূন্যতম ব্যবস্থার অভাব, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। ইউনেস্কো-র মতে, বিশ্বব্যাপী ২৪৪ কোটি শিশু এবং যুবরা স্কুলে পড়তে পারে না, শিক্ষার অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত থাকে। একইসঙ্গে সারা বিশ্বের ৭৭১ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নিরক্ষর রয়েছেন বলে জানা যায় ইউনেস্কোর রিপোর্ট দ্বারা। আফ্রিকা ও অন্যান্য একাধিক দেশের মতো বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন অংশেও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা এমনকি নূন্যতম শিক্ষা ব্যবস্থা টুকুওনেই। গোটা দেশবাসীকে শিক্ষিত করা দ্বারা কেবল নিরক্ষরতার হার কম করাই নয় সমাজকেও উন্নত করা সম্ভব। মনে রাখার দরকার, সমাজকে উন্নত করা, একে অপরকে সাহায্য করা সমাজের অংশ হিসেবে কর্তব্য আমাদের সকলেরই।