জীবন ও জীবনী

হীরালাল সেন~ এক বাঙালির চিত্রগ্রাহকের   জীবনী, Filmmaker Hiralal Sen biography in bengali

হীরালাল সেন~ এক বাঙালির চিত্রগ্রাহকের   জীবনী, Filmmaker Hiralal Sen biography in bengali
Key Highlights

হীরালাল সেন ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে বিবেচিত হয়।  তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। ভারতের প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা হিসেবে এবং  ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কৃতিত্বও পেয়েছেন তিনি । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯১৭ সালে একটি অগ্নিকাণ্ড তাঁর সমস্ত চলচ্চিত্রসমূহ ধ্বংস করে দেয়।

জন্ম ও শৈশবকাল, Birth and childhood 

হীরালাল সেন ১৮৬৬ সালের আগস্ট মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর আদি নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে আনুমানিক ৮০ কিলোমিটার দূরে মানিকগঞ্জের বাগজুরী গ্রামে।

তিনি ঐ অঞ্চলের একজন বৈদ্য জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল বাংলার অভিজাত শ্রেণীর অন্তর্গত । সেনের পিতা চন্দ্রমোহন সেন ছিলেন একজন সফল আইনজীবী । পিতা চন্দ্রমোহন সেন এবং মাতা বিধুমুখী দেবীর আট জন সন্তানদের মধ্যে দ্বিতীয়  ছিলেন হীরালাল সেন। 

সেনের শৈশব কাটে কলকাতায়। স্কুলে পড়া শেষ করার পরপরই হীরালাল সেন তৎকালীন কলকাতায় চলে যান এবং সেখানকার একটি কলেজে ভর্তি হন।  তাঁর কলেজের সময়কালে অর্থাৎ তরুণ ছাত্র বয়সেই ফটোগ্রাফি শিল্পের প্রতি গভীর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। ১৮৯০ সালের মধ্যে, তিনি ফটোগ্রাফিতে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বেশ কয়েকটি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন এবং মানিকগঞ্জ ও কলকাতায় তাঁর ফটোগ্রাফিক স্টুডিও চালু করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে তাঁর ভাই মতিলাল সেনের সহায়তায় তিনি লন্ডনে চার্লস আরবানের ওয়ারউইক ট্রেডিং কোম্পানি থেকে একটি আরবান বায়োস্কোপ কিনেছিলেন।

চলচ্চিত্র জগতে কাজের শুরু, Hiralal Sen started career in film industry 

হীরালাল সেনের ব্যবসায়িক দক্ষতার অভাব ছিল যার সাহায্যে হয়তো তিনি চলচ্চিত্র মাধ্যমটির সাথে বাণিজ্যিক সাফল্য সহজেই খুঁজে পেতেন । বাবা চন্দ্রনাথ সেন তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য আর্থিক সহায়তা করেছিলেন।  সেন একটি সিনেমাটোগ্রাফ মেশিন কিনতে সেকালে রাজকীয়ভাবে  ৫০০০ টাকা খরচ করেছিলেন। 

প্রজেকশন সরঞ্জাম সহ সমগ্র যন্ত্রপাতি ইংল্যান্ড থেকে কিনতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর ভাই মতিলালের সাথে, সেন ১৮৯৮ সালে দ্য রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি স্থাপন করেন, যা ছিল ভারতের প্রথম সিনেমা কোম্পানি। 

আরও পড়ুন  

প্রথম দিকে, তাঁরা ইংল্যান্ডের কোম্পানিগুলির দ্বারা নির্মিত চলচ্চিত্রগুলি ক্রয় করতেন এবং ধনীদের পার্টি এবং বিবাহে সেগুলি দেখাত।  এগুলি ছিল মূলত ইংরেজদের দ্বারা কলকাতা ও ভারতের রাস্তায় দৈনন্দিন জীবনের চিত্রায়িত ছবি।

কর্মজীবন, Career life 

হীরালালের চলচ্চিত্র তৈরির সৃজনশীল কর্মজীবন ১৯১৩ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। হীরালাল সেন চল্লিশটিরও বেশি শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছিলেন।  কলকাতায় অমরেন্দ্র দত্তের ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনয় করা নাট্য প্রযোজনা থেকে তিনি যে ছবিগুলি তৈরি করেছিলেন তার বেশিরভাগই চিত্রিত দৃশ্য। ১৯০১ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে তিনি ভ্রমর, হরিরাজ এবং বুদ্ধদেব সহ ক্লাসিক থিয়েটারের জন্য অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। 

তাঁর দীর্ঘতম চলচ্চিত্র ১৯০৩ সালে নির্মিত হয়েছিল এবং এর শিরোনাম ছিল আলিবাবা এবং চল্লিশ চোর।  এছাড়াও তিনি কমিশন নিয়ে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্র এবং নিউজফিল্ম নির্মাণ করেন।  তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে জাবাকুসুম হেয়ার অয়েল এবং এডওয়ার্ডস টনিকের বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে চলচ্চিত্র ব্যবহার করেন। ১৮৯৮ সালে, কলকাতার স্টার থিয়েটার সিনেমা প্রদর্শন শুরু করে। 

সেন এবং তাঁর ভাই মতিলাল বুঝতে পেরেছিলেন যে চলচ্চিত্র ভবিষ্যতের একটি মাধ্যম হতে চলেছে। পরবর্তী সময় হীরালাল সেন জনজীবন, প্রকৃতি, রাজনৈতিক ঘটনা প্রভৃতি নিয়েও চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন। অন্যদের বানানো ফিল্ম দেখিয়ে টাকা কামিয়ে হীরালাল সন্তুষ্ট হননি। 

তিনি নিজে ফিল্ম তৈরি করতে চেয়েছিলেন।  অমরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কুসুম কুমারীর সাথে হীরালাল সেনের একটি ফলপ্রসূ সম্পর্ক ছিল, তাঁরা স্টার্ট থিয়েটারে অভিনয় করতেন। হীরালাল সেন তাঁদের সাথে সহযোগিতা করেন এবং ক্লাসিক থিয়েটার দ্বারা নির্মিত তাঁর কিছু নাটকের চিত্রগ্রহণ করেন।  প্রথমদিকে, থিয়েটারে স্টেজ শো-এর বিরতিতে এগুলো দেখানো হতো।

ভারতের প্রথম রাজনৈতিক ছবি, The first political movie in India 

১৯০৪ সালে হীরালাল সেন লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগ করার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে একটি জনসমাবেশ চলচ্চিত্র রূপে নিজের ক্যামেরার মাধ্যমে তৈরি করেন।  সমাবেশের বিশালতা রেকর্ড করার জন্য, তিনি ট্রেজারি বিল্ডিংয়ের উপরে ক্যামেরা স্থাপন করেছিলেন যাতে তিনি প্রায় দুই মাইল প্রসারিত বিশাল জনতার পটভূমিতে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি সহ বক্তাদের ছবি তুলতে পারেন।

১৯০৫ সালে,হীরালাল সেন একটি "আমাদের নিজস্ব তৈরি প্রকৃত স্বদেশী চলচ্চিত্র" বিজ্ঞাপন দেন।  ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯০৫ তারিখে কলকাতার টাউন হলে সেনের তৈরি "বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বিক্ষোভ এবং স্বদেশী আন্দোলন" নামক চলচ্চিত্র নথিভুক্ত করা হয় । সমালোচক সমিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এটি ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। 

ব্যবসার অবনতি,  Degradation in business 

সময়ের সাথে সাথে আমদানি করা চলচ্চিত্রগুলির সাথে প্রতিযোগিতা করা হীরালাল সেনের কাছে কঠিন হতে শুরু করে। প্রতিযোগিতামূলক অন্য চলচ্চিত্রগুলির পরিকাঠামো এবং প্রযুক্তিতে আরও ভাল আয়ত্ত থাকা ছিল এর কারণ । 

আরও পড়ুন : 

আর্থিক কষ্ট এবং স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে বাধ্য হয়ে, তিনি শেষ পর্যন্ত ব্যবসা বন্ধ করে দেন । এর কিছুদিন পরেই ১৯১৭ সালের অক্টোবরে, সেনের সমস্ত চলচ্চিত্রগুলি দুর্ঘটনাক্রমে এক অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যায়। অসুস্থ ও দেউলিয়া হয়ে যাওয়া হীরালাল সেন এই নিষ্ঠুর সংবাদ পেয়েছিলেন যে রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানির পুরো স্টক যে গুদামটিতে রয়েছে সেখানে আগুন লেগেছে।


অগ্নিকাণ্ড তার তৈরি প্রতিটি চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং সেগুলির সাথে ভারতের প্রথম দিকের সিনেমার ইতিহাসের অনেক প্রমাণও ধ্বংস হয়ে যায়। এরফলে তিনি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন, এবং কয়েকদিন পর মারা যান।

হীরালাল সেনের সম্পাদনাসমূহ, Assets of Hiralal Sen 

● আলিবাবা এবং চল্লিশ চোর (১৯০৩)।
● ভ্রমর ।
● হরিরাজ ।
● বুদ্ধদেব ।
● কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বিক্ষোভ এবং স্বদেশী আন্দোলন (22শে সেপ্টেম্বর 1905)  ।

মৃত্যু,Death

হীরালাল সেনের পরবর্তী বছরগুলো ছিল হতাশা ও অর্থনৈতিক কষ্টে ভরা। জীবনের শেষ বছরের দিকগুলিতে তিনি এমন কঠিন সময়ের মধ্যে পড়েছিলেন যে তাঁকে তাঁর প্রিয় ক্যামেরাটি একজন সুদগ্রহীতার কাছে বিক্রি করতে হয়েছিল।
তাঁর দুর্দশা আরো ভয়ানক হয়ে পড়ে যখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। হীরালাল সেন ১৯১৭ সালের ২৯ অক্টোবর কলকাতায় মারা যান।  

সম্মাননা প্রাপ্তি, Awards and recognition 

হীরালাল সেনের স্মৃতি চিহ্নস্বরূপ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র বিভাগ ‘হীরালাল সেন স্মৃতি পুরস্কার’ প্রবর্তন করেছে। ২০১২ সালে, তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার পরের বছর, ২০ শতকের শুরুতে সেযুগের নীরব চলচ্চিত্রগুলি যেভাবে প্রদর্শিত হতো সেভাবে প্রদর্শনের জন্য কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ একটি উন্মুক্ত মঞ্চ স্থাপন করেছিল।

সেই প্ল্যাটফর্মের নাম দেওয়া হয় হীরালাল সেন মঞ্চ।  বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ ঢাকায় "উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা" এর মৃত্যুশতবার্ষিকী স্মরণে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।  সেখানে হীরালাল সেন কে নিয়ে লেখা একটি বইও প্রকাশ করা হয়েছে।

উপসংহার, Conclusion 

যদিও দাদাসাহেব ফালকে- কে ভারতের প্রথম ফিচার ফিল্ম ডিরেক্টর হিসাবে স্মরণ করা হয়, কিন্তু হীরালাল সেন সিনেমা তৈরির করার কাজে প্রথম ভারতীয় একজন। ১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকে দেশের প্রথম ফিচার ফিল্ম রাজা হরিশচন্দ্র পরিচালনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

আরও পড়ুন  :

এতেই পরিস্কার হয় যে ইতিহাসের পাতায় লেখা প্রতি অক্ষর বর্ণে বর্ণে সত্যি হয়না, একজনের কৃতিত্বে অন্যজনের ভাগও বসে যায় অনেক ক্ষেত্রে। তবে হীরালাল সেনের মৃত্যুর একদশক পরে হলেও তাঁর জীবনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে একটি চলচ্চিত্র। পরিচালক অরুণ রায় নিজের সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন সেনের জীবনী ইতিহাস। হীরালাল সেনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কিঞ্জল নন্দী। ২০২১ সালে মুক্তি পায় সেই সিনেমাটি।

প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions

হীরালাল সেন কে ছিলেন?

একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার, তিনি ভারতের প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্র এবং সম্ভবত ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কৃতিত্বও পেয়েছেন।

হীরালাল সেন কবে জন্মগ্রহণ করেন?

১৮৬৬ সালে।

হীরালাল মাতা পিতার নাম কি?

পিতা চন্দ্রমোহন সেন এবং মাতা বিধুমুখী দেবী

হীরালাল সেন কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

মানিকগঞ্জের বাগজুরী গ্রামে।

হীরালাল সেনের মৃত্যু কবে হয়?

১৯১৭ সালে।