জীবন ও জীবনী

বিখ্যাত লেখক  আহমদ ছফার জীবনী, Biography of novelist Ahmad Chafa in Bengali

বিখ্যাত লেখক  আহমদ ছফার জীবনী, Biography of novelist Ahmad Chafa in Bengali
Key Highlights

আহমদ ছফা একজন বাংলাদেশী লেখক, চিন্তাবিদ, ঔপন্যাসিক, কবি, দার্শনিক এবং বুদ্ধিজীবী ছিলেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং সলিমুল্লাহ খান সহ অনেকেই সোফাকে মীর মোশাররফ হোসেন এবং কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক বলে মনে করেন।

জন্ম ও পরিবার, Birth and family 

আহমেদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০শে জুন, চট্টগ্রাম জেলার গাছবাড়িয়ায় এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর পিতা ছিলেন হেদায়েত আলী এবং মা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন আহমদ ছফা । ছফা বিয়ে না করলেও বেশ কিছু নারীর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল;  তাদের মধ্যে শামীম সিকদার এবং সুরায়া খানমের সাথে তাঁর সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য ।

শিক্ষাজীবন, Education

Also read :

আহমদ ছফা চট্টগ্রামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। তারপর  তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার আহমদ শরীফ নামক একজন শিক্ষকের ধমক খেয়ে ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দেন।  ১৯৬৭ সালে, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। 

সেই সালেই, আবদুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানে "বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৃদ্ধি কারণ " এই বিষয়ের উপর পিএইচডি করার জন্য বাংলা একাডেমি তাঁকে ফেলোশিপ প্রদান করে।  যদিও ছফা তাঁর পিএইচডি প্রোগ্রাম শেষ করেননি।

কর্মজীবন, Career

আহমদ ছফা ১৯৬০-এর দশকে লেখক হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। সাহিত্যে নিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর বড় ভাই আবদুস সোবি সমর্থন করেছিলেন। আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ও গ্রন্থ ছিল 'সূর্য তুমি সাথী '(১৯৬৭) ।

সমালোচক আনিসুজ্জামান এবং আরও অনেকে ছফার রচিত "বাঙালী মুসলমানের মন" গ্রন্থকে বাংলা ভাষায় রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ নন-ফিকশন বইগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করেন।  ছফার লেখা 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' (A New Mode of Intellectualism, 1972) বইটি বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীদের সাধারণ সুবিধাবাদী প্রবণতা, এবং বাংলাদেশে বাস্তব বস্তুগত পরিবর্তন আনতে তাদের ব্যর্থতাকে চিত্রিত করেছে।

Also read

ছফার রচিত প্রতি উপন্যাসে ছিল ভাষার ব্যবহারিক সতেজতা। তিনি বিভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা চালিয়ে যেতেন এবং বিভিন্ন সাহিত্যে তাঁর উৎকৃষ্ট বর্ণনা সমূহ তাঁর রচনাশৈলী কে এক অভিনবত্ব প্রদান করেছিল। তিনি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কথাসাহিত্যের দ্বারা  সামাজিক, আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক সূক্ষ্মতার সাথে বাংলাদেশকে চিত্রিত করেছে। 

সমালোচকরা বাস্তববাদের সাথে মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতাকে চিত্রিত করে তাঁর জটিল চরিত্রায়নের প্রশংসা করেছেন।  এছাড়াও আবুল ফজল ছফা রচিত "ওঙ্কার" (The Om, 1975) কে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক অভিব্যক্তি বলে মনে করেন। 

Read also  :

'গাভী বিত্তান্ত' (A Tale of a Cow, 1995) দলীয় রাজনীতি ও দুর্নীতির সাথে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে লিখিত একটি অন্যতম ব্যঙ্গমূলক উপন্যাস ।  তাছাড়াও 'পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ' (টেলস অফ ফ্লাওয়ারস, ট্রিস এবং বার্ডস, 1996) বাংলাদেশের পাখি, গাছপালা এবং গাছের সাথে ছফার আধ্যাত্মিক সংযুক্তি বর্ণনা করে ।  তাঁর কিছু দীর্ঘ কবিতার মধ্যে 'প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা' এবং 'বস্তি উজার' অন্যতম।
একজন ভালো সংগঠক হিসেবে ছফা বাংলাদেশ লেখক শিবির প্রতিষ্ঠায় লেখক আহমেদ শরীফের সাথে তৎকালীন অন্যান্য লেখকদের একত্রিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। 

যুবক বয়সে ছফা অল্প সময়ের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন।  তিনি ঢাকায় বস্তি তে বসবাসকারী শিশুদের জন্য বেশ কয়েকটি বিনামূল্যের স্কুলও খুলেছিলেন।  তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সম্প্রীতি কমিটি (১৯৯২-৯৪), তরঙ্গ (১৯৯৩-৯৬), নাগরিক শক্তি (১৯৯৫) ইত্যাদিও সংগঠিত করেছিলেন।

ছফার উল্লেখযোগ্য কিছু সৃষ্টি, Notable creations of Ahmad Chafa

আহমদ ছফা ১৮ টি নন-ফিকশন বই, ৮ টি উপন্যাস, ৪ টি কবিতার সংকলন, ১ টি ছোট গল্পের সংকলন এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন।

● বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২)

● বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১)

● ওঙ্কার (১৯৭৫)

● একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮)

● অলাতচক্র (১৯৯৩)

● গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫)

● অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬)

● পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬)

● যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮)

● ফাউস্ট (১৯৮৬)

বিতর্ক ও সমালোচনা

একটি বোহেমিয়ান জীবনধারা, এবং স্পষ্টভাষী প্রকৃতির জন্য, আহমদ ছফা তাঁর জীবদ্দশায় একটি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। রাহাত খান একবার তাঁকে পাগল বলেও সম্বোধন করেছেন । 

হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরীন এবং আরও কয়েকজনের সাথে আহমদ ছফার মতবিরোধ এবং পরবর্তীকালে লেখালেখির মাধ্যমে একে অপরের নিন্দার বিষয়টি একসময় খুব আলোচিত হয়েছিল এবং এখনও নতুন প্রজন্মের লেখকদের সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায়। একজন পেশাদার লেখক হিসেবে ছফা আর্থিক কষ্টও সহ্য করেছিলেন, যদিও তিনি অনেককে তাদের প্রয়োজনে সাহায্য করার জন্য নিজের অমিতব্যয়িতার জন্যও পরিচিত ছিলেন। 

অনেকে অনুমান করেন যে ছফা তাঁর জীবনের প্রথম দিকে আর্থিক সাহায্যের জন্য প্রায়ই আবদুর রাজ্জাকের দারস্ত হতেন। ছফা বাংলায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির 'দ্য গ্রিন বুক' প্রকাশ করতে সাহায্য করেছিল।

মৃত্যু, Death

সাহিত্য জীবনের শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ছফা প্রধান সম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদক বা উপদেষ্টা সম্পাদক হিসাবে অনেক সংবাদপত্র, সাপ্তাহিক এবং মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত করেছিলেন।  ছফা ২০০১সালের ২৮ জুলাই ঢাকার একটি হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বিকল হওয়ার কারণে মারা যান।  তাঁকে মিরপুর স্থিত 'শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান' -এ দাফন করা হয়েছিল।

আহমদ ছফার প্রভাব ও অনুপ্রেরণা, Influence of Ahmad Chafa

আহমদ ছফাকে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁকে "সুবিধাবাদের বিরোধিতাকারী" লেখক এবং সত্যবাদী - নির্ভীক  একজন "আদর্শবাদ ও প্রগতিশীল সংস্কৃতির চ্যাম্পিয়ন" হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

● মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন "এটি আমাদের বড় সৌভাগ্য যে ছফার মতো একজন প্রতিভা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে"।   
● সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, "ছফা ছিলেন জাতির সর্বদা আপোষহীন বিবেক, সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে।"  
● হুমায়ূন আহমেদ ছফাকে একজন অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী লেখক বলে অভিহিত করেছেন এবং ছফাকে তার "গুরু" হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
● "আহমেদ সোফা রাস্ট্রশোভা" এবং 'সেন্টার ফর এশিয়ান আর্ট অ্যান্ড কালচার'- এর সাথে প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আহমেদ সোফা মেমোরিয়াল বক্তৃতার আয়োজন করেন। 
● চট্টগ্রামের 'চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়' -এর একজন শিক্ষক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আহমেদ ছফা সেন্টার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁর কাজগুলোর স্মৃতিচারণ করে।

 আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার এবং ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত সাদাত আলী আকন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।  ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। আহমদ ছফার উপন্যাস এবং গল্পগুলি প্রায়শই নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়। গাজী তানজিয়া রচিত কালের নায়ক (দ্য হিরো অফ দ্য এজ, 2014) আহমেদ ছফার জীবনের উপর ভিত্তি করে একটি উপন্যাস।

উপসংহার, Conclusion

ছফা এবং তাঁর কাজগুলি হুমায়ূন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ, সহ অনেক লেখক, যথা ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান প্রমুখ ছাড়াও চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রশিল্পী, এবং বুদ্ধিজীবীদের আজও প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions

আহমদ ছফা কে ছিলেন?

আহমদ ছফা একজন বাংলাদেশী লেখক, চিন্তাবিদ, ঔপন্যাসিক, কবি, দার্শনিক এবং বুদ্ধিজীবী ব্যাক্তিত্ব ছিলেন।

আহমদ ছফা কবে জন্মগ্রহণ করেন?

আহমেদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০শে জুন, চট্টগ্রাম জেলার গাছবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

আহমদ ছফার প্রথম গ্রন্থ কোনটি?

আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ও গ্রন্থ ছিল 'সূর্য তুমি সাথী '(১৯৬৭)।

আহমদ ছফার মৃত্যু কবে হয়?

২০০১ সালে।

ছফা বাংলাদেশ সরকার দ্বারা কোন পুরস্কার পান?

২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।