'বিজ্ঞানের পুরোধা-"আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় | Biography of Acharya Sir Prafulla Chandra Ray
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন একাধারে বৈজ্ঞানিক, শিক্ষক, রসায়নবিদ দেশপ্রেমিক এবং দানবীর।
ভূমিকা | Introduction of Acharya Sir Prafulla Chandra Ray
ভারতবর্ষের জাতীয় ইতিহাসে বাঙালি~ প্রতিভা এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিল। কাব্য, সাহিত্য, চিত্রকলা ইত্যাদির পাশাপাশি গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ,উদ্ভিদবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে বাঙালির বিস্ময়কর অবদানের কথা আজ শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয়। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় বৈজ্ঞানিক, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুর সহকর্মী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন একাধারে বৈজ্ঞানিক, শিক্ষক, রসায়নবিদ দেশপ্রেমিক এবং দানবীর। সেই বাঙালি মহাজীবনের জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্ণ হল কিন্তু আজও তিনি নিজ কর্মমহিমায় আপামর বাঙালির জীবনে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন | Birth and educational life of Acharya Sir Prafulla Chandra Ray
১৮৬১ সালের ২রা আগস্ট যশোর জেলার অন্তর্গত কপোতাক্ষ নদীর তীরবর্তী রাড়ুলী গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা হরিশ্চন্দ্র রায় এবং মাতা ভুবনমোহিনী দেবীর পুত্র আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত তুখোড় এবং প্রত্যুৎপন্নমতি। পিতা হরিশ্চন্দ্র ছিলেন যশোরের সেরেস্তাদার। তাঁর শিক্ষাজীবনের সূত্রপাত ঘটে বাবার প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে। কিন্তু পেটের অসুখের কারণে তাঁর অধ্যয়ন ব্যাপকরূপে বিঘ্নিত হয়ে পড়ে । ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় প্রত্যাগমন করে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন । পরবর্তীকালে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে কলেজ ফাইনাল তথা এফ এ পরীক্ষায় (ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসি) দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন ও প্রেসিডেন্সী কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হন এবং পর্যায়ক্রমে সেই কলেজ থেকেই 'গিলক্রাইস্ট' বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিলেত যাত্রা করেন । ১৮৮২ সালে সেখানে বসবাস করাকালীন তিনি বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে রসায়নশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণার জন্য এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত পিএইচডি ও ডি.এস.সি ডিগ্রি লাভ করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের 'হোপ' পুরস্কারে ভূষিত হন।১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্বদেশ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
কর্মজীবন | Acharya Sir Prafulla Chandra Ray’s career
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। পরবর্তীকালে ১৯১১খ্রিষ্টাব্দে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন।১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ও পরবর্তী সময়ে তিনি বিজ্ঞান কলেজের, রসায়ন বিভাগে 'পালিত অধ্যাপক' হন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ অবধি তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। অধ্যাপনায় ছাত্রদের আকর্ষণ করার অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ডক্টর রায়। ছাত্রদের গবেষণার কাজে উৎসাহিত করার জন্য ভারতে একটি রাসায়নিক বিজ্ঞান গোষ্ঠীর সৃষ্টি করে এ দেশে রসায়ন চর্চা ও গবেষণার পথ প্রশস্ত করেন তিনি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিভিন্ন ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সর্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন।১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম রাসায়নিক দ্রব্য ও ওষুধ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন তিনি যা 'বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড' নামে খ্যাতির শিখরে ওঠে। বাংলার বিভিন্ন শিল্পোন্নতি বিধানে এবং ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারে তাঁর ছিল অদম্য উৎসাহ। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর উৎসাহে ও প্রেরণা এবং অর্থসাহায্যে 'ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি' প্রতিষ্ঠিত হয়। বেকারি, ট্যানারি ,এনামেল কারখানা, পটারি, জুতোর কারখানা, কালি তৈরির কারখানা এসব উদ্যোগ নিয়ে কেউ তাঁর কাছে গেলে তিনি তাকে প্রত্যাখ্যান করেননি। তিনি এই সব ক্ষুদ্র শিল্পকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিক সাহায্য করেছিলেন।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার | Scientific discoveries of Acharya Sir Prafulla Chandra Ray
একসময় আচার্য নিজেই বলেছিলেন, "I became a chemist by mistake", নিজেকে ঠাট্টা নয়; সারাজীবনের স্বরূপ উপলব্ধি করলে বোঝা যায় তিনি হয়তো মিথ্যে বলেননি। বয়স যখন চৌত্রিশ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর বিজ্ঞান আবিষ্কারের জন্য বহুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।তাঁর লক্ষ্য ছিল মৌল আবিষ্কার করে রসায়ন জগতে অমর হওয়া। রসায়ন জগতে দুটো অস্থায়ী জিনিস একত্রিত হয়ে যে একটি স্থায়ী যৌগ তৈরি হতে পারে এমন বিশ্বাস গবেষকদের মধ্যে ছিল না। প্রফুল্ল রায় প্রমাণ করলেন, পারদের সঙ্গে লঘু নাইট্রিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় কী ভাবে মার্কিউরাস নাইট্রাইট তৈরি হতে পারে ।
I became a chemist by mistake.
তবে নাইট্রাইট আবিষ্কারে ব্যর্থ হলেও সোনা ও প্ল্যাটিনাম গোত্রের বিশেষ বিশেষ যৌগ প্রস্তুতে তাঁর সাফল্য আধুনিক রসায়নে গুরুত্বপূর্ণ।এই পদার্থটি ছাড়া আরও যেসব শ্রেণির যৌগ তৈরির লক্ষ্যে প্রফুল্লচন্দ্র সফল হন সেগুলো হলো অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইট, সালফার- ঘটিত জৈব পদার্থ এবং প্ল্যাটিনাম, ইরিডিয়াম কিংবা সোনা সম্বলিত জৈব রাসায়নিক।তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেছিলেন। নতুন পদার্থের সংশ্লেষণ ছাড়াও ঘি, মাখন, তেলের রাসায়নিক বিশ্লেষণ নিয়েও গবেষণা করেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র, যার উদ্দেশ্য ছিল ভেজাল নির্ধারণ করা।
প্রকাশিত গ্রন্থাবলি | Published books of Acharya Sir Prafulla Chandra Ray
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আত্মচরিত গ্রন্থটির নাম, 'Life and experience of a Bengali Chemist' এবং ইংরেজি ও বাংলায় রচিত বহু গ্রন্থ তাঁর সাহিত্য সাধনার পরিচয় বহন করে। তাঁর আত্মচরিত ইংরেজিতে লেখা হলেও বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং পাঁচ বছরের মধ্যে আত্মচরিত এর বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হয়।এ ছাড়া বাংলায় লেখা, 'বাঙালির মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার' এবং "অন্নসমস্যায় বাঙালির পরাজয় ও তাহার প্রতিকার', তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ, 'হিস্ট্রি অফ হিন্দু ক্যামিস্ট্রি' দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।চড়ক, সুশ্রুত, বাণভট্ট, বৃন্দ, চক্রপাণি কিংবা নাগার্জুন যে দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন সেই সব অজানা তথ্যকে প্রফুল্লচন্দ্র দু খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন এবং সেটিই ছিল তাঁর দীর্ঘ গবেষণায় সমৃদ্ধ রচনা।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা | Recognition and honor of Acharya Sir Prafulla Chandra Ray
‘‘আচার্য’’ হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বীকৃতি লাভ করেন শিক্ষকতার জন্য । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তৃতীয়বারের জন্য ইংল্যান্ডে গিয়ে সি আই ই লাভ করেন ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে। আরও কিছু বিশেষ স্বীকৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে প্রাপ্ত ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি , ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে মহীশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আচার্য এই ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন।ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ১৯১৯ খ্রীস্টাব্দে নাইট উপাধিতে ও তিনি ভূষিত হন।
অবদান | Contribution of Acharya Sir Prafulla Chandra Ray
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে নিজ উদ্যোগে একটি কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর পিতার নামানুসারে আর,কে,বি,কে হরিশ্চন্দ্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । ১৯১৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজ ,যা পি.সি কলেজ নামে খ্যাত সেটি বর্তমানকালে বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এক বিরাট অবদান রেখেছে ।
স্বদেশপ্রীতি | Patriotism of Acharya Sir Prafulla Chandra Ray
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। বিজ্ঞানের মাধ্যমে দেশের উন্নতি সাধন করা তথা পরাধীন ভারতীয়দের আত্মমর্যাদাকে বাড়ানোই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী বীরদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর সহানুভূতি ।সব ধরনের জাতীয় শিক্ষা ,শিল্পোদ্যোগের প্রতি অকৃপণ সহায়তা ও মানবকল্যাণে অর্জিত অর্থের অকাতর বিতরণ তাঁকে দেশবাসীর সামনে বিশিষ্ট করে তুলেছে। এই মহান বিজ্ঞানী ক্লাসে বাংলায় লেকচার দিতেন এবং তাঁর বাচন শৈলী ছিল অসাধারণ । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শিক্ষার উন্নতিকল্পে তিনি প্রায় দু লক্ষ টাকা দান করেন। দরিদ্র ছাত্রদের অর্থসাহায্যও তিনি করতেন। জাতিভেদ ,বাল্যবিবাহ ,পণপ্রথা প্রভৃতি হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন তিনি।ভূমিকম্প ,বন্যা ,দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয় তিনি অকাতরে দান করেছিলেন।
প্রয়াণ | Acharya Sir Prafulla Chandra Ray’s death
১৬ জুন ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ,কলকাতায়, ৮২ বছর বয়সে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে।
উপসংহার | Conclusion
পরাধীন ভারতবর্ষে যেখানে বাঙালি তথা ভারতবাসীর মেধাকে ইংরেজরা নিজেদের থেকে নিম্নমানের বলে মনে করত সেই সময়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের আবির্ভাব ,তাঁর মেধা ও গবেষণা প্রমাণ করিয়ে দিয়েছিল যে ভারতবাসীরও ইংরেজের থেকে কোনো অংশে কম নয় ।শুধু তাই নয় রসায়ন শিক্ষার প্রসারে তাঁর উদ্যোগী ভূমিকা চিরস্মরণীয়।আজীবন তিনি দেশের মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন ।তাই তাঁর কর্মের মূল্যায়ন করতে গিয়ে শুধু তাঁর গবেষণা নয়, দেশের ও জাতির প্রতি এই মহান কর্মযোগীর ত্যাগের কথা স্মরণ করা এবং তার দ্বারা উদ্ভূত হওয়াই হবে আমাদের প্রধান কর্তব্য ।
প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কবে কোথায় জন্মগ্রহণ করেন ?
১৮৬১ সালের ২রা আগস্ট যশোর জেলার অন্তর্গত কপোতাক্ষ নদীর তীরবর্তী রাড়ুলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
প্রফুল্ল চন্দ্রের পিতা মাতার নাম কী ?
পিতা হরিশ্চন্দ্র রায় এবং মাতা ভুবনমোহিনী।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কর্মজীবনের সূচনা কীভাবে হয়েছিল?
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয়।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আত্মচরিত গ্রন্থের নাম কী ?
Life and experience of a Bengali Chemist"
কত খ্রিস্টাব্দে ডাক্তার পি.সি রায় 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত হন?
১৯১৯ খ্রীস্টাব্দে 'নাইট' উপাধিতে তিনি ভূষিত হন।
কত খ্রিস্টাব্দে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রয়াণ ঘটে?
১৬ জুন ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ,কলকাতায়, ৮২ বছর বয়সে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে।
- Related topics -
- জীবন ও জীবনী
- আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
- জীবনী সাহিত্য