WB Rath Yatra 2023 | পুরী বাদেও কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যেই একাধিক জায়গায় ধুমধাম করে পালন হচ্ছে রথযাত্রা উৎসব!

Thursday, December 21 2023, 2:33 pm
highlightKey Highlights

কলকাতার ইসকন থেকে শুরু করে মাহেশ, রথতলার মতো একাধিক জায়গায় রথযাত্রার জন্য ভিড় ঢল ভক্তদের। সঙ্গে রয়েছে রথের মেলাও।


সকাল থেকেই এদিন গোটা দেশে চারিদিকে পুজো পুজো আভাস। ওড়িশা (Odisha) বাদেও পশ্চিমবঙ্গে (West Bengal) রথযাত্রা (Rath Yatra 2023) উপলক্ষে সাজো সাজো রব। সেজে উঠেছে ছোট থেকে বড় সকল মন্দির। রাজ্য জুড়ে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে মন্দিরে ভিড় ভক্তদের। অনেকেরই রথযাত্রায় পুরী (Puri) যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও, নানা কারণে তা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে কয়েকটি বিখ্যাত রথযাত্রা। যাতে অংশ নিয়ে মনে হবে যেন এসেছেন পুরীতেই।

রথযাত্রা উপলক্ষে সেজে উঠছে গোটা দেশ 
রথযাত্রা উপলক্ষে সেজে উঠছে গোটা দেশ 

পশ্চিমবঙ্গের সবেচেয়ে বিখ্যাত রথযাত্রার মধ্যে শীর্ষে  রয়েছে মাহেশের রথযাত্রা। প্রায় ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি ধ্রুবনন্দ ব্রহ্মচারী দ্বারা শুরু হয় এই রথযাত্রা। কথিত আছে, সাধক ধ্রুভানন্দ ব্রহ্মচারী ৬২৭ বছর আগে পুরীতে গিয়ে প্রভু জগন্নাথকে ভোগ নিবেদনের জন্য স্বপ্নাদেশ পান। কিন্তু শ্রীক্ষেত্রে গিয়েও তিনি ভোগ দিতে পারেননি। শোনা যায়, ফিরে এসে তিনি ফের স্বপ্নাদেশ পান, গঙ্গায় ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে বিগ্রহ তৈরির জন্য। পাশাপাশি মানা হয়, মাহেশের রথের চূড়ায় একটি নীলকণ্ঠ পাখি বসে থাকে। পুরীর রথযাত্রা শুরু হলে সে উড়ে যায়। এরপরেই রথ তার যাত্রা শুরু করে অর্থাৎ চলতে শুরু করে। মানা হয়, এই নীলকণ্ঠ পাখিটি শুধু প্রধান পুরোহিতই দেখতে পান।

প্রায় ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাশি সময় থেকে শুরু হয় মাহেশের রথযাত্রা  
প্রায় ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাশি সময় থেকে শুরু হয় মাহেশের রথযাত্রা  

আগে কাঠের রথ থাকলেও,  ১৩৭ বছর আগে তৈরী করা হয় লোহার রথ। যা তৈরী করে মার্টিন বার্ন কোম্পানী (Martin Burn Company)। ১২৫ টন ওজনের এই রথ ৫০ ফুট উঁচু এবং এতে রয়েছে ১২টি চাকা। বর্তমানে এই রথের দেখভাল করেন কলকাতা শ্যামবাজারের বসু পরিবার। চারতলা বিশিষ্ট এই রথের একতলায় চৈতন্যলীলা, দ্বিতীয় তলে কৃষ্ণলীলা এবং তৃতীয় তলে রামলীলা চিত্রিত আছে। চার তলায় বসানো হয় বিগ্রহ। যেহেতু, নারায়ণই কলিকালের জগন্নাথ, সেই কারণে নারায়ণ শিলাকেই প্রথমে রথে চড়ানো হয়। তারপর সুভদ্রা, বলরাম এবং সব শেষে রথে তোলা হয় জগন্নাথ দেবকে। প্রতি বছর মাহেশের রথযাত্রায় অংশ নেন এ রাজ্যের ছাড়াও ভিন রাজ্যের বাসিন্দারাও। এবছরেও অন্যথা হয়নি তার। রথযাত্রা ছাড়াও জগন্নাথ মন্দিরের পাশে স্থানপিঁড়ির মাঠে মেলাও ভক্ত ও আম জনতার জন্য বড় আকর্ষণ।

মায়াপুর । Mayapur :

এক সময়ে মায়াপুর আর রাজাপুর নামের দু’টি গ্রাম ছিল। রাজাপুরের বেশিরভাগই ছিলেন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ। কথিত আছে যে, ৫০০ বছর আগে এক পুরোহিত স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। যার পর থেকেই রথযাত্রার সূচনা করা হয় এখানে। তবে মায়াপুরের মন্দির থেকে কিন্তু রথ বের হয়না। বরং রথে চড়ে বলরাম, জগন্নাথ এবং সুভদ্রা আসেন এই মন্দিরে।  সেখানে ৮দিন থেকে ৯ দিনের মাথায় রথে চড়েই আবার ফেরত যান রাজাপুর।

৫০০ বছর আগে এক পুরোহিত স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর থেকেই রথযাত্রার সূচনা করা হয় মায়াপুরে
৫০০ বছর আগে এক পুরোহিত স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর থেকেই রথযাত্রার সূচনা করা হয় মায়াপুরে

ইসকন । Iskon :

কলকাতার ইসকনের রথযাত্রা পুরীর রথযাত্রার পর হয়ে উঠেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা। ১৯৭২ সালে ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য, কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি অভয় চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে রমরমা করে পালন করা হয় এখানে রথযাত্রা। চলতি বছর ইসকনের রথযাত্রা ৫২ বছরে পড়ল।

চলতি বছর ইসকনের রথযাত্রা ৫২ বছরে পড়ল
চলতি বছর ইসকনের রথযাত্রা ৫২ বছরে পড়ল

এবারের রথযাত্রায় ইসকন বিশ্বব্যাপী ১৭০টিরও বেশি দেশে এবং ৮০০টিরও বেশি শহর ও জনপদে রথযাত্রার আয়োজন করবে। যুদ্ধরত দুই দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়ার ভক্তরাও মিলবেন জগন্নাথ প্রেমের এই ধারায়। এবারের রথযাত্রার মহোৎসবে বিশেষ ও প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee)। এদিন মিন্টো পার্কের (Minto Park) কাছে ৩সি,অ্যালবার্ট রোডের (উত্তম কুমার সরণি) ইসকন মন্দির থেকে দুপুর ১টায় রথযাত্রার উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী। এবার ভক্তরা নিজেদের বাড়িতে রান্না করা নিরামিষ ভোগ জগন্নাথদেবকে নিবেদন করতে পারবেন। সরাসরি পূজারিরা রথেই তা পুজো করে ফেরত দেবেন ভক্তদের।

এবারের রথযাত্রার মহোৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 
এবারের রথযাত্রার মহোৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 

রথতলা । Rathtala :

কলকাতায় ২০০ বছর ধরে ধুমধাম করে রথযাত্রা পালন করা হয় কামারহাটির (Kamarhati) রথতলায়। জায়গা ভিন্ন হলেও এখানকার রথযাত্রা যেন পুরো পুরীর রথযাত্রার মতোই। কথিত আছে, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বেলঘরিয়ার রথ তলার মতিলাল সেন ঠাকুরবাড়ির রথ দর্শনে এসেছিলেন। তখন বেলঘরিয়ার (Belghoria) এক বাসিন্দা ছোট্ট একটি লোহার রথ দিয়েছিলেন স্থানীয় ক্লাবে। আড়িয়াদহ রথ তলা থেকে দেড় ফুটের জগন্নাথ দেব সেই রথে চড়েই রথের দিন মাসির বাড়ি যেতেন। সেই রথ আজও চলে বেলঘরিয়ার রথতলায়। কিন্তু নবকলেবরে বদলেছে জগন্নাথ দেবের আকার।  এই রথ তলার জগন্নাথ দেবের রথের কাঠ এই বছর এসেছে গন্ধমাধভ পাহাড় থেকে। ৩৩ ফুট উচ্চতার রথে চেপে এদিন রথতলা থেকে মাসির বাড়ি ফিরবেন জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা। রথযাত্রার পাশাপাশি রথতলা বিখ্যাত রথের মেলার জন্যও

২০০ বছর ধরে ধুমধাম করে রথযাত্রা পালন করা হয় রথতলায়  
২০০ বছর ধরে ধুমধাম করে রথযাত্রা পালন করা হয় রথতলায়  

আমাদপুর । Amadpur:

 বর্ধমান জেলার মেমারি অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম আমোদপুর বা আমাদপুর। গ্রাম ছোট্ট হলেও, এই গ্রামে রথযাত্রা পালন করা হয় ধুমধাম করে। এই গ্রামের রথযাত্রায় অংশ নিতে ভিড় করেন অগুনতি ভক্তরা। গ্রামের জমিদার পরিবারের দেবতা হলেন রাধামাধব। সেই রাধামাধবকে নিয়েই হয় রথযাত্রা। এদিন তাঁর পুজো করা হয় গ্রামেরই এক প্রাচীন মন্দিরে। রথযাত্রার দিন সকালে প্রথমে রাধামাধবকে মা দুর্গার মন্দির বা দুর্গাবাড়িতে এবং পরে গোটা গ্রামে ঘোরানো হয়।

 রাধামাধবকে নিয়েই রথযাত্রা হয় আমাদপুরে 
 রাধামাধবকে নিয়েই রথযাত্রা হয় আমাদপুরে 

গুপ্তিপাড়া । Guptipara:

পশ্চিমবঙ্গের আরেক প্রাচীন ও খ্যাত নাম রথযাত্রা হলো গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা। ১৭৪০ সালে মধুসূদানন্দ দ্বারা সূচনা হয় গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা। এখানকার রথযাত্রার রয়েছে এক আলাদা বৈশিষ্ট্য। প্রথমত, গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রায় রথের উচ্চতা হয় ৩৬ ফুট। এমনকি আগে গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির থেকে ১২ চাকার রথে চেপে যাত্রা করতেন জগন্নাথ দেব। তবে ১৮৭৩ সালে এক দুর্ঘটনার  পরে কমিয়ে দেওয়া হয় রথের  চাকার সংখ্যা। এছাড়াও গুপ্তিপাড়ার রথ যাত্রায় ছে। ৪০ কুইন্টাল খাবার লুঠ করার প্রথা রয়েছে।

 ১৭৪০ সালে মধুসূদানন্দ দ্বারা সূচনা হয় গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা
 ১৭৪০ সালে মধুসূদানন্দ দ্বারা সূচনা হয় গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা

রাজবলহাট । Rajbalhat:

হুগলির রাজবলহাট খুবই বিখ্যাত জায়গা। এই জায়গা তাঁত কাপড়ের জন্য পরিচিত হলেও, রথযাত্রার জন্যও বিখ্যাত রাজবলহাট। আমাদপুরের মতোই এখানেও রথে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা থাকেন না। এই রথে থাকেন এলাকার বিখ্যাত মন্দিরের পূজ্য দেবতা রাধাকৃষ্ণ।

ভিন্ন উচ্চতার ভিন্ন রকমের রথ নিয়ে খুদেরা 
ভিন্ন উচ্চতার ভিন্ন রকমের রথ নিয়ে খুদেরা 

রথ মানেই সন্ধ্যে হতেই পাঁপড় ভাজা বা রথের মেলায় ঢু মারা। ছোটোবেলায় সকলেরই অপেক্ষা থাকতো কবে রথযাত্রার দিন আসবে। কারণ সেদিন সকাল হতে না হতেই শুরু হতো রথ সাজানো। এরপর বিকেল নামতেই এক এক করে নিজের সুসজ্জিত রথ নিয়ে রাস্তায় নামার পালা। কারুর একতলা রথ তো আবার কারুর দুই তলা, তিন তলা রথ। ছোটবেলায় কার রথ কত লম্বা সেই নিয়ে যেন থাকতো একটা রেশারেশি পরিস্থিতি। রথের উচ্চতার সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে রথের সাজসজ্জা। যার রথ সব থেকে বেশি সুন্দর সাজানো, সেই যেন হতো সেদিনের রাজা। তবে রথের দৌড় নিয়ে তো কোনো কথাই হবেনা। পর পর সারিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অনেকেই রথ নিয়ে করতেন রেস (Race)।

যেখানে যেখানে রথযাত্রা আয়োজন করা হয় তার পাশেই আয়োজন করা হয় রথের মেলারও
যেখানে যেখানে রথযাত্রা আয়োজন করা হয় তার পাশেই আয়োজন করা হয় রথের মেলারও

রথের দিন আট থেকে আশি সকলেরই আনন্দের দিন। রথযাত্রা, রথ টানার সঙ্গে এদিনটা আরও সুন্দর করতে তুলতে বহু মন্দির কর্তৃপক্ষ থেকে বা সরকারের তরফ থেকে আয়োজন করা হয় রথের মেলার (Rath Yatra Mela)। এখানে নানারকম দোলনা, দোকানের সঙ্গে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকে পাঁপড় ভাজার স্টল ও জিলাপির দোকান। মাহেশ, ইসকন, গুপ্তিপাড়া,রথতলা প্রায় যেখানে যেখানে রথযাত্রা আয়োজন করা হয় তার পাশেই আয়োজন করা হয় রথের মেলারও।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File