World No Tobacco Day | কেবল সরাসরি ধূমপানেই নয় 'প্যাসিভ' স্মোকিংয়ের জন্যও হয় মৃত্যু! জানুন কীভাবে নিজের এবং কাছের মানুষের ধূমপানের আসক্তি ছাড়াবেন?
তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে কেবল ভারতেই ৩১২ বিলিয়ন মূল্যের তামাক বিক্রি হয়েছে। ২০২৪ সালে সেই মূল্য ১৩,৩৭০.০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তামাকই পৃথিবীর একমাত্র বৈধ পণ্য, যা অবধারিতভাবে তার ভোক্তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
ধূমপান বা তামাক আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য যে ক্ষতিকর সেই বিষয়ে সকলেই অবগত। তামাক যে প্রাণ কেড়ে নিতে পারে তার উদাহরণও বিশ্ব দেখছে রোজ। সিনেমা, সিরিজের শুরুতে হোক, রাস্তাঘাটে পোস্টারে হোক, সর্বত্রই তামাক সেবন ত্যাগ করা নিয়ে চলছে প্রচার-বিজ্ঞাপন। এমনকি তামাকজাত পণ্যের প্যাকেটেই আটকানো থাকে তামাক ত্যাগের বার্তা। তবুও রমরমা করে চলছে তামাকের ব্যবসা, তামাক সেবন। স্কুল পেরোতে না পেরোতেই পড়ুয়াদের হাতে চলে আসছে সিগারেট! বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের গেটের গায়েই খুলছে তামাক-গুটখার দোকান। সুস্থ্য সবল জীবন পরিচালনা করার জন্য কাজ করেন, কিন্তু সেই কাজের চাপেই চলছে মারণ 'সুখটান'! যারা নিজ ইচ্ছায় ধূমপান করছেন, তামাক সেবন করছেন তারা নিজের হাতেই নিজের আয়ু কমাচ্ছেন। কিন্তু যারা তামাক সেবনই করেন না, ধূমপান করেন না তাদেরও কিন্তু 'প্যাসিভ স্মোকিংয়ে'র জন্য হচ্ছে ক্ষতি! প্রত্যেক বছরই তামাক সেবন নিয়ে সচেতন করতে ৩১সে মে পালন করা হয় বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস (World No Tobacco Day)। এদিন চলে নানান প্রচার, নানান কর্মসূচি। কিন্তু তাতে কি সতর্ক হচ্ছে সমাজ?
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ও সতর্কতা । World No Tobacco Day and Warning :
তামাক সেবন এবং এর কারণে মৃত্যু ও রোগ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অর্থাৎ হু-র সদস্য রাষ্ট্রগুলি ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস (No Tobacco Day) পালন করার প্রস্তাব তোলে। এরপর ১৯৮৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ ডাব্লুএইচএ৪০.৩৮ (WHA40.38) রেজোলিউশন পাস করে এবং ৭ই এপ্রিলের দিনকে তামাক বিরোধী দিবস (Anti Tobacco Day) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যদিও পরে ১৯৮৮ সালেই দ্বিতীয় রেজোলিউশন ডাব্লুএইচএ৪২.১৯ (WHA42.19) পাস করার পর প্রতি বছর ৩১সে মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস (No Tobacco Day) পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তামাক সেবনের কারণে দেশে প্রতি বছর মৃত্যু হয় ১কোটি ৩৫ লাখ মানুষের। যাঁরা দিনে ২০টি সিগারেট খান তাঁদের আয়ু গড়ে ১৩ বছর কমে যায়। তাঁদের মধ্যে ২৩ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় ৬৫ বছর বয়সের আগেই। হু-এর এক শীর্ষ কর্তা সায়মা ওয়াজেদ বলেন, ১০ জন ধূমপায়ীর মধ্যে নয়জনই ১৮ বছর বয়সের আগে ধূমপান শুরু করে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বোঝার পরও ধূমপানের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা।
প্যাসিভ স্মোকিং ও ই-সিগারেট । Passive Smoking and E-Cigarettes :
যে কোনও রূপেই তামাক সেবন শরীরের পক্ষে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। PSRI ইনস্টিটিউট অফ পালমোনারি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড স্লিপ-এর মেডিসিন ডিরেক্টর ডাঃ খিলনানির কথায়, ইলেকট্রনিক সিগারেট যেগুলি সিগারেটের অভ্যাস ত্যাগ করতে সাহায্য করে বলে প্রচার করা হয় সেগুলিও আসলে ধূমপানের প্রতি আসক্তি বাড়ায়। ইউরোপীয় দেশগুলিতে, ১২.৫% কিশোর-কিশোরীরা ইলেকট্রনিক সিগারেট ব্যবহার করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল পড়ুয়াদের অবস্থা একই রকম। তরুণদের মধ্যে ইলেকট্রনিক সিগারেটের (ভেপিং) প্রতি আসক্তি দ্রুত বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ২১ বছর বয়সের আগেই যারা তামাকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন তাঁদের মধ্যে নিকোটিন নির্ভরতা এবং আমৃত্যু তামাক ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে আরেক জিনিস হলো প্যাসিভ ধূমপান! এটি সেকেন্ডহ্যান্ড ধূমপান হিসাবেও পরিচিত। প্যাসিভ ধূমপান বলতে সক্রিয় ধূমপায়ীর কারণে তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসাকে বোঝায়। শরীরে প্যাসিভ ধূমপানের প্রভাবগুলি তাৎক্ষণিক প্রকৃতির। করোনারি হার্ট ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং স্ট্রোক প্যাসিভ ধূমপানেরই কুপ্রভাব। যে মহিলারা ধূমপানের সংস্পর্শে আসেন, কম ওজনের সন্তান জন্ম দেওয়া থেকে প্রতিকূল প্রজনন স্বাস্থ্যের প্রভাবেরও মুখোমুখি হতে পারেন।
শরীরে তামাকের প্রভাব । Effects of Tobacco on The Body :
তামাক সেবনে একবারে বা সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষতি হয়না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে শরীরে নানা রোগের সৃষ্টি করে, শরীরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নষ্ট করে দেয়।
- হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক সহ কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, ধমনীর অভ্যন্তরীণ আস্তরণের ক্ষতি করে, রক্তনালীগুলিকে সংকুচিত করে এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।
- পাকস্থলী এবং অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে পাচনতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। এটি আলসার, অ্যাসিড রিফ্লাক্স এবং অন্যান্য হজমের ব্যাধিও তৈরী করতে পারে।
- ধূমপান রক্ত প্রবাহ হ্রাস করে ত্বকের বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, যার ফলে ত্বকের বলিরেখা, শুষ্কতা এবং ত্বক ঝুলে যায়। পাশাপাশি এটি ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ায়।
- ধূমপান মুখের ক্যান্সার, মাড়ির রোগ এবং দাঁতের ক্ষতির একটি প্রধান কারণ। এতে নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধও হয় এবং দাঁতে দাগ পড়ে।
- ধূমপান ছানি এবং ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের ঝুঁকি বাড়ায়, যা অন্ধত্বের কারণ হতে পারে।
- ধূমপান ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়, যার ফলে শরীরের পক্ষে সংক্রমণ এবং রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন ওঠে। এটি অস্ত্রোপচার বা আঘাতের পরে নিরাময় বিলম্বিত করে।
- ধূমপান উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও স্মৃতিশক্তি হ্রাসও হতে পারে।
তামাকের আসক্তি ছাড়ানোর উপায় । Ways To Get Rid Of Tobacco Addiction :
তামাক সেবন একবার শুরু করলে সেখান থেকে পিছু পা হওয়া খুব সহজ বিষয় নয়। তামাক ধূমপান একটি শারীরিক আসক্তি এবং একটি মানসিক অভ্যাস। তবে মন থেকে অদম্য ইচ্ছা থাকলে এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এর জন্য যা যা করতে পারেন-
- ধূমপান ত্যাগ করতে হলে সব থেকে প্রধান কাজ হল আপনার আশেপাশের থেকে সমস্ত টোব্যাকো বা তামাকজাত ও তামাক সম্পর্কিত পদার্থ সরিয়ে দেওয়া। এর অর্থ হল আপনার বাড়ি, গাড়ি, অফিস থেকে সিগারেট, অ্যাশট্রে, লাইটার প্রভৃতি তামাকজাত ও তামাক সম্পর্কিত পদার্থ সরিয়ে দিন। এর ফলে এই সকল পদার্থগুলি দেখে আর তামাকের জন্য আসক্তি জাগবে না।
- গবেষণায় দেখা গেছে যে চুইংগাম তামাকের প্রতি আসক্তি কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যারা ধূমপান ছাড়তে চান, তাদের যখনই ধূমপানের ইচ্ছা হবে তখনই চুইংগাম বা অন্য কিছু রাখতে। এতে তামাক সেবনের আসক্তি চলে যায়। চুইংগামের পরিবর্তে মিছরি, স্ন্যাকস, ফল বা অন্য কিছুও ব্যবহার করতে পারেন।
- তামাকের আসক্তি ছাড়ার জন্য আগে আপনাকে বুঝতে হবে আপনার কখন তামাক সেবন বা ধূমপানের জন্য ইচ্ছা জাগছে। এতে আপনার যখনই নেশার জন্য মনে ইচ্ছা জাগবে তখন সেই বুঝে আপনি নিজেকে কোনও কাজে ব্যস্ত করে নিতে পারবেন বা চুইংগামের মতো বা কোনও স্ন্যাকসের মতো অন্য কোনও খাবার খেতে পারবেন। এতে ধীরে ধীরে তামাক সেবনের ইচ্ছা অনেকটা চলে যাবে।
- তামাক সেবন বা ধূমপানের নেশা ছাড়া সহজ নয়। তবে অবশেষে এটি একটা অভ্যাস। যা মনের ইচ্ছা বা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে নেওয়া যায়। ধূমপানের নেশা ছাড়লে কেবল শরীর, মনের স্বাস্থ্য ভালো হওয়াই নয়,সাশ্রয় হয় বহু টাকা।
প্রসঙ্গত, তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে কেবল ভারতেই ৩১২ বিলিয়ন মূল্যের তামাক বিক্রি হয়েছে। ২০২৪ সালে সেই মূল্য ১৩,৩৭০.০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তামাকই পৃথিবীর একমাত্র বৈধ পণ্য, যা অবধারিতভাবে তার ভোক্তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। মোহনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে যে কিশোর-কিশোরী আজ ঠোঁটে তামাকপণ্য তুলে নিচ্ছে, কাল সেই পরিণত হচ্ছে কোম্পানির আমৃত্যু খদ্দেরে। বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের মতে, নিজেকে এবং কাছের মানুষদের সচেতন করার পাশাপাশি আইন শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে তামাক কোম্পানির ছোবল থেকে এই প্রজন্মকে সুরক্ষা প্রদান করতে হবে।