Hypertension | ভারতের প্রায় ১৯ কোটি জনই আক্রান্ত হাইপারটেনশনে! জানুন সুস্থ্য থাকতে লাইফস্টাইল কী কী বদল আনবেন?
অনেকের ধারণা রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে শুধু হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকই হবে। কিন্তু, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা না করালে ক্ষতি হতে পারে কিডনি-সহ অন্যান্য অঙ্গেরও।
হাইপারটেনশন উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। কেবল বয়স্কদেরই নয় এই সমস্যা এখন গ্রাস করছে কম বয়সীদেরও। এই রোগ এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে জীবনযাত্রায় হাইপারটেনশনের সমস্যা এখন হয়ে উঠেছে খুবই সাধারণ। তবে সতর্কতা অবলম্বন না করলেই উচ্চ রক্তচাপ থেকে নানান ভয়াবহ রোগ এমনকি প্রাণহানিও হতে পারে। তাই হাইপারটেনশন সম্পর্কে সমাজকে আরও সজাগ করে তুলতে প্রতি বছর ১৭ই মে পালন করা হয় বিশ্ব হাইপারটেনশন দিবস (World Hypertension Day)।
বিশ্ব হাইপারটেনশন দিবস । World Hypertension Day :
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। তাই প্রতি বছর ১৭ই মে পালন করা হয় বিশ্ব হাইপারটেনশন দিবস। এই দিনটির শুরু বিশ্ব হাইপারটেনশন লিগের হাত ধরে। ৮৫টি দেশ জুড়ে রয়েছে এই বিশেষ সংস্থা। হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের বিপদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে ওয়াকিবহাল করাই এর মূল কাজ। তাদের উদ্যোগেও শুরু হয় এই দিন। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এমনই নানা লিগ ও সোসাইটি গড়ে তোলা হয়েছে দেশে। তাদের প্রধান সংস্থা বিশ্ব হাইপারটেনশন লিগ ২০০৫ সালে প্রথম এই দিনটি পালন করে। সেই বছর ১৪ মে পালন করা হয়েছিল বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবসবা ওয়ার্ল্ড হাইপারটেনশন ডে। তবে পরের বছর অর্থাৎ ২০০৬ সাল থেকে পাল্টে যায় তারিখটি। ১৪ মে-এর বদলে ১৭ মে এই বিশেষ দিন পালন করা শুরু হয়। সেই বছর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রতি বছর ১৭ মে তারিখেই পালন করা হয় বিশ্ব হাইপারটেনশন দিবস।
নীরব ঘাতক হাইপারটেনশন । The Silent Killer Hypertension :
হাইপারটেনশন কার্ডিও-ভাসক্যুলার স্বাস্থ্য ভাল রাখার অন্যতম প্রধান সূচক। আবার হাইপারটেনশনকে নীরব ঘাতকও বলা হয়ে থাকে। আসলে বছরের পর বছর ধরে যদি না ধরা পড়ে, তাহলে তা নীরবে রক্তবাহী ধমনীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দিতে পারে হাইপারটেনশন। যা পরবর্তীকালে হৃদরোগ, স্ট্রোক বা পক্ষাঘাত এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতার ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। অতি উচ্চ রক্তচাপ ধীরে ধীরে হৃদযন্ত্রকে বিকল করতে থাকে। এই অসুখ বর্তমান দিনে গোটা বিশ্বেই মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কেবল হার্ট নয়, হার্ট থেকে মস্তিষ্ক, যে কোনও কিছুর ভয়ংকর পরিণাম ডেকে আনে বিনা চিকিৎসা হাই ব্লাড প্রেসারের সমস্যা। তবে হাইপারটেনশন বা উচ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর জন্য চিকিৎসকরা দৈনিক জীবনে ও খাদ্যাভাসে কিছু পরিবর্তন আনতে বলে থাকেন।
স্বাভাবিক রক্তচাপ কত থাকা উচিত?
প্রাপ্তবয়স্কদের সিস্টোলিক প্রেশার ১২০ মিমি এইচজি এবং ডায়াস্টোলিক প্রেশার ৮০ মিমি এইচজি বা তার কম হওয়া উচিত। যদি আপনার রক্তচাপ ১২০/৮০ mm Hg হয়, তাহলে তা স্বাভাবিক। ব্লাড প্রেশার যদি ১৩০-৮০ mm Hg হয়, তাহলে তা বর্ডারলাইন। আর যদি তা ১৪০-৯০ অতিক্রম করে বা তার বেশি উঠে গেলে বুঝতে হবে রক্তচাপ অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। দীর্ঘদিন এটা চলতে থাকলে হার্টের অসুখ বাঁধা অবধারিত।
সুস্থ্য থাকতে লাইফস্টাইল কী কী বদল আনবেন?
ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোজকার জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে যা যা করবেন-
- বাড়তি ওজন কমানো প্রথম কাজ। হাইপারটেনশনের ঝুঁকি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য মেটাবোলিক ডিজিজ যেমন ডায়াবিটিস, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড, হার্টের অসুখের ঝুঁকি বাড়ে। তাই নিয়মিত এক্সারসাইজের পাশাপাশি সঠিক ডায়েট করে ওজন কমাতে হবে।
- কোলেস্টেরল বাড়ে এমন সব খাবার না খাওয়াই ভাল। রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএল যাতে বেড়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- নুন খাওয়া কমানোই ভাল। জাঙ্ক ফুড, অতিরিক্ত তেলমশালাদার খাবারে রুচি বদলানো দরকার।
- ঝুঁকিপূর্ণ উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের নিয়মিত মনিটরিং দরকার। ওষুধ ও লাইফ স্টাইল মডিফিকেশন করে রক্তচাপ কমিয়ে রাখা উচিত। প্রত্যেক ছয় সপ্তাহ অন্তর চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
- সুস্থ্য থাকতে তামাক জাতীয় জিনিস ছাড়তে হবে।
- দৈনিক নিয়ম করে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। কম ঘুম রক্তচাপ বাড়ানোর পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়।
- করতে হবে শরীর চর্চাও। ব্লাড প্রেশারের মতো জটিল অসুখকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতেই হবে। শরীরচর্চা না করলেও প্রতিদিন নিয়ম করে ঘাম ঝরিয়ে হাঁটতে, সাইকেল চালাতে বা সাঁতার কাটতে পারেন।
হাইপারটেনশন ডায়েট চার্ট :
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, হাইপারটেনশনের রোগীদের হাইপারটেনশন ডায়েট চার্ট (Hypertension Diet Chart) বা ড্যাশ ডায়েট (Dietary Approaches to Stop Hypertension) মেনে চলা উচিত। অর্থাৎ, যেখানে শাকসবজি, ফল, গোটা শস্যের উপর জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে যা যা খাবেন-
- উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে বিভিন্ন ধরনের ফল ও শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে। যে মরশুমে যে সব শাকপাতা, আনাজপাতি, ফল-মূল পাওয়া যায়, সেগুলোই খান। এতে রক্তচাপের পাশাপাশি অন্যান্য ক্রনিক অসুখের ঝুঁকিও কমবে।
- হাইপারটেনশন ডায়েট চার্ট (Hypertension Diet Chart)-এ প্রতিদিন তাজা ফল যেমন লেবু, জাম্বুরা, পেয়ারা, আমলকী, আপেল, কমলা, মাল্টা, ডালিম, কলা, নাশপাতি, পেঁপে ইত্যাদি খেতে হবে।
- প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকতে হবে সবুজ শাকসবজি যেমন পালংশাক, কলমিশাক, মুলাশাক, পাটশাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, শসা, মুলা, লাউ, মটরশুঁটি, ঢ্যাঁড়স, বেগুন, কুমড়া। এই সব্জিগুলি উচ্চ রক্তচাপের জন্য সেরা আয়ুর্বেদিক ওষুধ (best ayurvedic medicine for high blood pressure) হিসেবে কাজ করে।
- খাদ্যতালিকায় পটাশিয়াম–জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়াতে পারলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সাধারণত ডাবের জল, কলা, টমেটোসহ কিছু সবজিতে পটাশিয়াম রয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ কমাতে বাদাম, শালগম, তিসি, ডার্ক চকলেট ও কালিজিরা ভালো কাজ করে।
- চিয়া ও তিসির বীজ খুবই ছোট হয়। তবে এই খাবারের পুষ্টিগুণ কিন্তু কম নয়। এটিও উচ্চ রক্তচাপের জন্য সেরা আয়ুর্বেদিক ওষুধ (best ayurvedic medicine for high blood pressure) হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ফাইবার। এই সমস্ত বিষয়গুলি প্রেশার নিয়ন্ত্রণের জন্য দারুণ উপকারী।
- পেস্তা হল একটি ড্রাইফুট। এই বাদাম কমাতে পারে প্রেশার। এর মধ্যে ভালো হার্ট ভালো রাখার নানা উপাদান রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রেশারে আক্রান্ত মানুষ যে কোনও উপায়ে খেতে পারেন পেস্তা বাদাম।
- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপি কমাতে চাইলে আপনাকে স্যালমন ও ফ্যাটি ফিস খেতে হবে। এক্ষেত্রে এই মাছে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি (Omega 3 Fatty Acid) অ্যাসিড। এটা হার্টের জন্যও ভালো।
রক্তচাপ মাপার সময়ে যে বিষয় মাথায় রাখেবন :
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে সময় মতো তা পরীক্ষা করাও জরুরি। সব সময় বাইরে গিয়ে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই এখন অনেকেই বাড়িতে রক্তচাপের মেশিন (blood pressure machine) রাখেন। সেখানেই রক্তচাপ মেপে থাকেন। রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। যেমন -
- রক্তচাপের মেশিন (blood pressure machine) এর কাফ সাইজটি আপনার উপযুক্ত কি না দেখা দরকার। জামা বা কাপড়ের উপর কাফটি রাখবেন না। ত্বকের উপর রাখুন।
- নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে শুরু করার আগে যন্ত্রটি ঠিক পরিমাপ দেখাচ্ছে কি না বুঝতে একজন চিকিৎসকের সাহায্য নিন।
- দিনে দু’বার রক্তচাপ মাপুন। প্রথমবার সকালে উঠে রক্তচাপের ওষুধ খাওয়ার আগে। পরের বারটি সন্ধেবেলা।
- রক্তচাপ পরীক্ষা করার অন্তত আধঘণ্টা আগে থেকে খাবার, ধূমপান, অ্যালকোহল বা চা-কফি এড়িয়ে চলুন।
- রক্তচাপ মাপার সময় শান্ত হয়ে বসুন। বিশেষ করে রক্তচাপ মাপতে শুরু করার আগে মিনিটপাঁচেক চেয়ারে এমনি বসে নিন। তারপর রক্তচাপ মাপুন।
- ৩ মিনিট না হলে একই হাতে আবারও রক্তচাপ মাপবেন না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র প্রকাশিত সাম্প্রতিকতম তথ্য বলছে, প্রায় ১৯ কোটি ভারতীয় উচ্চ রক্তচাপের রোগী। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ মানুষ এ বিষয়ে সচেতন এবং মাত্র ৩০ শতাংশ হাইপারটেনশনের চিকিৎসা করান। অনেকের ধারণা রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে শুধু হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকই হবে। কিন্তু, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা না করালে ক্ষতি হতে পারে কিডনিরও। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা চোখ, হার্ট থেকে শুরু করে শরীরের নানান গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। উচ্চ রক্তচাপে ভোগা ব্যক্তি সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি, নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম না করলে কম বয়সে মৃত্যুও হতে পারে। বর্তমানে কম বয়সিদের মধ্যেও কর্মক্ষেত্রের চাপের কারণে রক্তচাপের অসুখ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে সুস্থ্য থাকতে হলে সঠিক চিকিৎসা, জীবনশৈলীতে ও খাদ্যাভাসে কিছু পরিবর্তন আবশ্যিক এবং ওষুধ খাওয়াও প্রয়োজন।