দেশ

Indian Hero - Nambi Narayanan | নাম্বি নারায়ণনের অবদান ছাড়া হতো না ইসরোর 'বিকাশ'!

Indian Hero - Nambi Narayanan | নাম্বি নারায়ণনের অবদান ছাড়া হতো না ইসরোর 'বিকাশ'!
Key Highlights

'বিকাশ ইঞ্জিন' আবিষ্কার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন নাম্বি নারায়ণন। তবে মিথ্যা অভিযোগে যেতে হয়েছিল জেক হেফাজতে। জানুন ভারতের মহাকাশ যাত্রার নেপথ্যে থাকা এই বিজ্ঞানী নাম্বি নারায়ণন সম্পর্কে।

ভারতের সাফল্য বর্তমানে গোটা বিশ্বে চর্চিত। ২৩ সে অগাস্ট, সন্ধে ৬টা ২ মিনিটে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সর্ব প্রথম অবতরণ করে ইতিহাস গড়েছে ইসরোর চন্দ্রযান-৩ (ISRO's Chandrayaan-3)।  সফলভাবেই চাঁদের মাটিতে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ এবং নানান পরীক্ষা চালাচ্ছে রোভার 'প্রজ্ঞান'। চন্দ্রযান-৩ এর ইতিহাস গড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিরোনামে উঠে এসেছে এই প্রজেক্টের নেপথ্যে থাকা বিজ্ঞানীদের অবদানও। ইসরো প্রধান এস সোমনাথ (ISRO chief S. Somnath), প্রজেক্ট পরিচালক ডাঃ এস. উন্নীকৃষ্ণন নায়ার (Dr. S. Unnikrishnan Nair)-এর মতো চন্দ্রযান-৩ এর সঙ্গে যুক্ত বহু বাঙালি-অবাঙালি বিজ্ঞানীদের নামও এই চন্দ্রাভিযানের সাফল্যের সঙ্গে অতঃপ্রোতভাবে জড়িত। কেবল ইসরোর সঙ্গে জড়িত বর্তমান বিজ্ঞানীরাই নন, ইসরোর সাফল্যের প্রসঙ্গ আসতেই উঠে আসে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার নেপথ্যে থাকা বিক্রম সারাভাই (Vikram Sarabhai), হোমি ভাবা (Homi Bhabha), এপিজে আব্দুল কালাম (APJ Abdul Kalam), কে সিভান (K Sivan) প্রমুখদের নামও। তবে একটি নামই খুব বেশি প্রকাশ্যে আসে না, নাম্বি নারায়ণন (Nambi Narayanan)।

ইসরোর সঙ্গে জড়িত হলেও খুব একটা বেশি তাঁর নাম উঠে আসেনা শিরোনামে। ইনি ভারতের অন্যতম প্রবীণ মহাকাশবিজ্ঞানী, নাম্বি নারায়ণ। ইসরোর ক্রায়োজেনিক বিভাগের বিজ্ঞানী ছিলেন নাম্বি নারায়ণ। বহু বিতর্কের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত হলেও ইসরোয় তাঁর অবদান অসীম। জেনে নেওয়া যাক 'পদ্মভূষণ' প্রাপ্ত নাম্বি নারায়ণন কে এবং ইসরোয় তাঁর অবদান কী।

নাম্বি নারায়ণনের পটভূমি । Background of Nambi Narayanan :

তামিলনাড়ুর নাগেরকোয়েলের (Nagercoil, Tamil Nadu) একটি সাধারণ পরিবারে ১৯৪১ সালে ১২ই ডিসেম্বরে জন্ম নাম্বি নারায়ণনের। তিনি নাগেরকোয়েলের এক বিদ্যালয়ে পঠনপাঠন শেষ করেন। এরপর মাদুরাইয়ের থিয়াগারাজার কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং (Mechanical Engineering from Thiagarajar College of Engineering) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছোট বেলার থেকেই  গণিতের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। মেধাবী ছাত্র ছিলেন নাম্বি। ইঞ্জিনিয়ারিং সমাপ্তির পর তিনি একটি চিনি কারখানায় শিক্ষানবিশ সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করেন এবং দ্রুত পদে উন্নীত হন। তবে পারিবারিক জরুরী অবস্থার জন্য তাঁকে সেই কাজ ছেড়ে দিতে হয়। তবে এরপরই অন্য দিকে মোড় নেয় নাম্বি নারায়ণনের জীবন। সেই সময় তাঁর নজরের আসে সংবাদপত্রের একটি বিজ্ঞাপন। সেই বিজ্ঞাপনে প্রথম শ্রেণীতে পাশ করা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের TERLS (Thumba Equatorial Launch Station) অর্থাৎ কেরালার রাজধানী তিরুবনন্তপুরমে থুম্বা নিরক্ষীয় লঞ্চ স্টেশনে কাজের জন্য যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। অতপর ১৯৬৬ সালে তৎকালীন ইনকোসপারে (INCOSPAR) যোগদান করেন নাম্বি। ১৯৬৯ সালে ইনকোসপারের নাম বদলে রাখা হয় 'ইসরো' (ISRO)। ভারতের প্রথম মহাকাশ বিজ্ঞান দলের সঙ্গে কাজ করেন নাম্বি নারায়ণন।

ইসরোতে নাম্বি নারায়ণনের অবদান । Contribution of Nambi Narayanan to ISRO :

পিএসএলভি (PSLV), জিএসএলভি (GSLV) এবং জিএসএলভি মার্ক ৩ (GSLV Mark 3), ভারতের তিনটি অপারেশনাল স্পেসফারিং রকেটেরই একটি প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই সবকটিই 'বিকাশ' ইঞ্জিন (Vikas Engine) দ্বারা চালিত। তরল-জ্বালানিযুক্ত বিকাশ ইঞ্জিন হল সমস্ত ভারতীয় রকেটের একটি প্রধান ভিত্তি, যা এখনও পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। এই ইঞ্জিন তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি পিএসএলভি রকেট মিশনের নেপথ্যে অবদান রয়েছে নাম্বি নারায়ণনের।

'বিকাশে'র গল্প -বিক্রম এ সারাভাই ইঞ্জিন । Story of 'Vikash' - Bikram A Sarabhai Engine :

১৯৬০ এবং ৭০ এর দশকে, কঠিন-জ্বালানি ইঞ্জিন বা তরল-জ্বালানি ইঞ্জিন তৈরি নিয়ে ইসরোর বিজ্ঞানীদের প্রযুক্তিগত ভিত্তিতে মতভেদ ছিল। তৎকালীন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ISRO) একটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের শক্তি এবং সংস্থানগুলিকে শক্ত ইঞ্জিনের দিকে মনোনিবেশ করতে বিশ্বাস করেছিল। প্রযুক্তিগতভাবে বলতে গেলে, তরল-জ্বালানিযুক্ত ইঞ্জিনগুলি বেশি জ্বালানী-দক্ষ। কারণ সেগুলি চালু এবং বন্ধ করা যায়, ওজনে ভারী পেলোড তুলতে পারে। তরল ইঞ্জিনেও কম কম্পন থাকে এবং কঠিন পদার্থের তুলনায় বেশি সময় ধরে জ্বলতে পারে। একটি শক্ত জ্বালানিযুক্ত ইঞ্জিন ব্যবহারের পরে পুড়ে যায়, সেখানে তরল জ্বালানিযুক্ত ইঞ্জিনে পরীক্ষা করা যেতে পারে, পরিষ্কার করার পরে পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে এবং পুনরায় সমাবেশ করা যেতে পারে। বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত রকেট প্রাথমিকভাবে তরল-জ্বালানি ইঞ্জিনের উপর নির্ভরশীল।

১৯৬৬ সালে ইসরোতে থুম্বা নিরক্ষীয় রকেট লঞ্চিং স্টেশনে প্রযুক্তিগত সহকারী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন নাম্বি নারায়ণন। এরপর ১৯৬৯ সালে ভারত সরকারের খরচে তাকে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে (Princeton University) ডেপুটেশনে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি অধ্যাপক লুইগি ক্রোকোর (Professor Luigi Croce) অধীনে রাসায়নিক রকেট প্রপালশনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তরল চালনার দক্ষতা নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন নাম্বি।

১৯৭৩ সালে ৬০০ কেজি  থ্রাস্ট লিকুইড ইঞ্জিন ব্যবহার করে একটি পরীক্ষামূলক রকেট (LP-006) উৎক্ষেপণ করে ইসরো। ৬০০ কেজির এই থ্রাস্ট ইঞ্জিনটি আমেরিকান এবং রাশিয়ানদের বিশালাকার ৬০ টন ইঞ্জিনের এর তুলনায় খুবই ছোট ছিল। নাম্বির পরীক্ষামূলক ফ্লাইটে এই তরল ইঞ্জিন সাফল্য পায়। ৬০-টন থ্রাস্ট লিকুইড-ফুয়েল ইঞ্জিন-সহ-'বিকাশে'র জন্য ফরাসিদের সাথে একটি চুক্তি করার জন্য ইসরোকে আরও অনুপ্রেরণা দেয়। যদিও ইঞ্জিনটি সম্পূর্ণ নতুন মডেল ছিল না, এটি ছিল 'ভাইকিং' (Viking) সিরিজের একটি ছোট ফরাসি ইঞ্জিনের একটি উন্নত সংস্করণ। ফরাসিরা তাদের ইঞ্জিনের নাম দিয়েছিল 'ভাইকিং'। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ, নাম্বি নারায়ণনের নেতৃত্বে, যে চুক্তিতে আলোচনা করেছিল, তারা ইঞ্জিনের একটি ভারতীয় নাম দেয়- 'বিকাশ' (Vikash)। অনেকের মতে সংস্কৃতে বিকাশ অর্থের জন্যই এই নামকরণ করা হয়, তবে নাম্বি জানান, 'বিক্রম এ সারাভাই'-র (Bikram A Sarabhai) জন্য এই ইঞ্জিনের নাম 'বিকাশ' রাখা হয়।

১৯৭৪ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত, নাম্বি নারায়ণনের নেতৃত্বে ১০০ জন ভারতীয় বিজ্ঞানীর একটি দল, ভার্ননের একটি ফরাসি সুবিধায় যৌথভাবে ৬০-টন থ্রাস্ট ভাইকিং-৩ ইঞ্জিন (Viking-3 engine) তৈরি করতে শিখেছিল। ভারতীয় দল যখন ইঞ্জিন তৈরি করতে শিখেছিল, তখন তাদের কাছে এমন প্রকল্পের অনুমোদন ছিল না। তবে ১৯৮২ সাল নাগাদ হবে, ইসরো এই ইঞ্জিনগুলি তৈরি করার এবং ইঞ্জিনগুলিকে একটি প্রকল্প-পিএসএলভি-তে (PSLV) অন্তর্ভুক্ত করার অনুমোদন পায়। ৮০ এর দশকের শেষের দিকে পিএসএলভি-র বিকাশের সময়, ফরাসিদের সাথে বিকশিত ৬০-টন থ্রাস্ট ইঞ্জিন দ্বিতীয় পর্যায়ে ফিট হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পিএসএলভি হল একটি চতুর্থ-পর্যায়ের রকেট যা একটি কঠিন-তরল-সলিড-তরল কনফিগারেশন দ্বারা চালিত হয়েছিল।

অবশেষে, ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের জন্য পিএসএলভি যাত্রা শুরু করলেও তা সফল হয়নি। উড়ানের মাঝখানে একটি ত্রুটির সম্মুখীন হয়। মিশন ব্যর্থ হলেও রকেটটিতে থাকা বেশিরভাগ সমালোচনামূলক সিস্টেমগুলি বৈধ করা হয়েছিল। এর প্রায় এক বছর পরে, ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে, পিএসএলভি মহিমান্বিতভাবে উৎপেক্ষেপন করে এবং কক্ষপথে হাজার কেজি ওজন তোলার ক্ষমতা প্রমাণ করে। এরপর প্রায় ৫০ বারেরও বেশি পিএসএলভি-কে উৎপেক্ষেপন করা হয়। যার মধ্যে কেবল ২ বারই এই যাত্রা ব্যর্থ হয়। নাম্বি নারায়ণন এবং তার দল দ্বারা তৈরি করা 'অবরোধী বিকাশ ইঞ্জিন' সমস্ত রকেটেই ত্রুটিহীনভাবে উড়েছিল। যার ফলে পরবর্তীতে, 'বিকাশ ইঞ্জিন' জিএসএলভি (GSLV) এবং জিএসএলভি এমকে৩ (GSLV Mk3) রকেটেও ব্যবহার করা হয়েছিল।

 নাম্বি নারায়ণনের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ।  Espionage charges against Nambi Narayanan :

১১৯৪ সালের ৩০সে নভেম্বর নারায়ণনকে কথিত গুপ্তচরবৃত্তির তদন্তের অংশ হিসাবে, কেরালা পুলিশ এবং ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (Kerala Police and the Intelligence Bureau) কর্মকর্তাদের একটি দল দ্বারা গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁরই একজন সহকর্মীর ভিডিওগ্রাফ করা বিবৃতির ভিত্তিতে নাম্বিকে গ্রেফতার করা হয়। নাম্বির বিরুদ্ধে রকেটের অঙ্কন এবং নথি স্থানান্তর করার অভিযোগ ওঠে। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে, মামলাটি সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন অর্থাৎ সিবিআই-এর কাছে স্থানান্তর করা হয়। এই মামলার জন্য নাম্বিকে ৫০ দিনের জন্য জেল হেফাজতে থাকতে হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৬ সালে সিবিআই একটি ক্লোজার রিপোর্ট জমা দেয় এবং জানায়, এই মামলায় কোনও গুপ্তচরবৃত্তি ছিল না। এমনকি সন্দেহভাজনদের সাক্ষ্য নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক করা হয়েছিল।

ভারতের মহাকাশ গবেষণা এবং ইসরোর সাফল্যের নেপথ্যে নাম্বি নারায়ণনের অবদানের জন্য তাঁকে ২০১৯ সালে পদ্মভূষণে সম্মান জানানো হয়। তবে চির বিতর্কিত নাম্বি স্যারের নাম সেভাবে কখনোই আলোকিত হয়না। নাম্বি নারায়ণনের অবদান, তাঁর ওপর হওয়া অত্যাচার তাঁর জীবনী নিয়ে ২০২২ সালে প্রকাশিত হয় একটি চলচিত্র 'রকেট্রি: দ্য নম্বি ইফেক্ট' (Rocketry: The Nambi Effect)। ছয়টি ভাষায় প্রকাশিত, আর. মাধবন (R Madhavan) দ্বারা রচিত, প্রযোজিত এবং পরিচালিত এই চলচ্চিত্র নাম্বি নারায়ণনের জীবনীর ওপর ভিত্তি করে তৈরী করা। ৬৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা ফিচার ফিল্ম পুরস্কারও যেতে এই চলচ্চিত্র।

'বিকাশ ইঞ্জিন' তৈরিতে অবদান, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা তথা ইসরোর মহাকাশ যাত্রার পথে অবদান, গোটা দেশের জন্য অবদান থাকলেও আজ নাম্বি নারায়ণনের নাম সকলের কাছে পরিচিত নয়। ইসরোর সাফল্যের নেপথ্যে আর বাকি 'সুপরিচিত' বিজ্ঞানীদের মতো নাম্বি নারায়ণনের অবদান ছাড়া হয়তো ইসরোর এতো সাফল্য লাভ করতো না। কম চর্চিত নাম্বি নারায়ণন 'ইন্ডিয়ান হিরো'ই বটে। কেবল নাম্বি নারায়ণনই নন, বেঙ্গল বাইট আপনার জন্য তুলে ধরবে এরকম বহু 'কম চর্চিত দেশের নায়ক'দের কথা।