Rabindranath Tagore | ' মৃত্যু-চেয়ে বড়ো'! ২২ শে শ্রাবণে 'মৃত্যুঞ্জয়ী' রবি ঠাকুরের স্মরণ! নানান অনুষ্ঠান শান্তিনিকেতনে!
ভোরে বৈতালী, সকাল ৭ টায় মন্দিরে বিশেষ উপাসনা সহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে ২২শে শ্রাবণ পালন করছে শান্তিনিকেতন। ছেলেবেলা থেকেই একের পর এক নিজের কাছের মানুষদের হারিয়েছেন রবিঠাকুর। মুখে প্রকাশ না করলেও লেখনীতে প্রকাশ করেছেন শোক, দুঃখ।
আজ বাইশে শ্রাবণ! রবীন্দ্র তিরোধান দিবস। আজ ভোরের আলো ফোটা থেকে শুরু করে গোটা দিন জুড়ে বাংলায় রবি ঠাকুরের স্মরণে নানান অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। প্রত্যেক বছরের মতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) প্রয়াণ দিবস পালন করা হচ্ছে শান্তিনিকেতনেও (Santiniketan)। ভোরে বৈতালী, সকাল ৭ টায় মন্দিরে বিশেষ উপাসনা সহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে ২২শে শ্রাবণ পালন করছে শান্তিনিকেতন। মঙ্গলবার সকাল থেকেই শান্তিনিকেতনের আকাশ ছেয়েছে ঘন কালো মেঘে। শ্রাবণের বৃষ্টি, লাল মাটি ভিজে স্যাঁতস্যাতে পরিবেশ যেন শান্তিনিকেতনকে করে তুলেছে ভারাক্রান্ত হৃদয়ের মতো। ১৯৪১ সালে ২২শে শ্রাবণ দিনটিতে নিজের সৃষ্ট অসংখ্য সুর, লেখা, কবিতা ফেলে রেখে চিরদিনের মতো রবি ঠাকুর চলে গেলেও, এই দিনটিকে কিন্তু মনে দুঃখ নিয়ে নয় বরং তাঁর স্মরণে সুরের মধ্য দিয়ে, নাচের মধ্য দিয়ে, কবিতার মধ্য দিয়ে বিশ্ব কবিকে স্মরণ করে পালন করা হয়।
বাঙালির প্রিয় কবি, লেখক, নাট্যকার, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে মানুষটার অবদান অনস্বীকার্য, বাঙালি বলতেই যার নাম উঠে আসবেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির রক্তে, বর্ণে, গন্ধে যেন মিশে রয়েছেন কবিগুরু। ছোটবেলার থেকেই প্রকৃতির প্রতি ছিল এক ব্যাখ্যাতীত টান। যার সাক্ষ্য পাওয়া যায় তাঁর সৃষ্টি থেকেই। কবিতা হোক বা গল্প হোক বা চিত্রকলা, কোথাও না কোথাও প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র পাওয়া যায়। কবিগুরুর প্রত্যেক সৃষ্টিই যেন এক মায়ার জালে আবৃত। সে প্রকৃতি হোক কিংবা ভালোবাসা অথবা মৃত্যু!
মৃত্যুর শোক কবিগুরুকে স্পর্শ করেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। বলা যেতে পারে যেমন আগুনের শিখায় লোহা আরও শক্ত হয়ে ওঠে, তেমনই জীবনে একাধিকবার মৃত্যুর শোকযাত্রা এলেও আরও যেন শক্ত হয়ে উঠেছিলেন রবি ঠাকুর, তাঁর লেখনী। ছেলেবেলাতেই ১৮৭৫ সালে হারিয়েছিলেন মা-কে। এরপর প্রথম যৌবনে প্রিয় বউঠান কাদম্বরীদেবীর মৃত্যু (১৮৮৪)। তার কয়েকবছর পরেই অতি প্রিয় ভাইপো বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু (১৮৯৯)। ১৯০৩ সালে হারান স্ত্রী মৃণালিনীদেবীকে। স্ত্রীকে হারানোর তিন বছর পর, ১৯০৫ সালে পরলোক গমন করেন কবি গুরুর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। একের পর এক মৃত্যু শোক যেন রবি ঠাকুরের জীবনের সঙ্গে জড়িত ছিল কোনও অভিশাপের মতো। নিজের প্রিয়জনের একটি মৃত্যুশোক সামলে উঠতেই আরেক মৃত্যুশোক!
পাঁজর উঠিল কেঁপে / বক্ষে হাত চেপে / শুধালেম, "আরো কিছু আছে নাকি, আছে বাকি/ শেষ বজ্রপাত?'/ নামিল আঘাত।
তবে এতো মৃত্যু শোকের মধ্যে রবি ঠাকুরকে সবথেকে বেশি আঘাত দিয়েছিলো ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু। এগারো বছরের ছেলেকে হারানোর পর শান্তিনিকেতনে ফিরে একটি ঘরে চুপ করে বসে থাকতেন কবিগুরু। তাঁর এহেন শোকস্তব্ধতা দেখে রীতিমতো চিন্তায় পরে গিয়েছিলেন দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি যেন তাঁর ভাইয়ের শোক উপলব্ধি করে নিজেই শিউরে উঠছেন। বারবার ভাই রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর পিঠে হাত রেখে এক আর্তিতে ডাকতেন 'রবি রবি'। কিন্তু কোনও সারাই দিতেন না রবি ঠাকুর। তখনও নিজের মনকে মৃত্যুশোকের আগুনের লেলিহান শিখা দিয়ে শক্ত করে তুলছিলেন নিজের মন। মুখে,আচরণে শোক প্রকাশ না করলেও, তা ফুটিয়ে তুলেছিলেন লেখনী দ্বারা। ছেলে শমীর মৃত্যুর বহু বছর পরে এক চিঠিতে তাঁর লেখা কয়েকটি লাইনেই ফুটে ওঠে কবি গুরুর ব্যথা, যন্ত্রনা, শোক। অবশেষে বিশ্ব কবি হলেও, সন্তানের পিতাও তিনি।
শমী যে-রাত্রে চলে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলাম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েচে তার লক্ষণ নেই। মন বললে, কম পড়েনি। সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তার মধ্যে।
পুত্র শমীর পরেও কবিগুরু হারান বড়মেয়ে মাধুরীলতাকে। ১৯১৮ সালে আবারও সন্তানহারা হন রবি ঠাকুর। কিন্তু তখনও রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ধরে রেখেছিলেন। মৃত্যুর এই লীলার জন্য কাঁদেননি তিনি। শোক সহ্য করেছেন। কবিগুরুর কাছে যেন মৃত্যুও হয়ে উঠেছিল তুচ্ছ। মৃত্যুর থেকে বড় কিছু নেই, তবুও এতগুলো মৃত্যুশোক সহ্য করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কাছে যেন কোনও কিছুই আর ভয়ঙ্কর বা বড় ছিল না।
ছোটো হয়ে গেছ আজ। / আমার টুটিল সব লাজ। যত বড়ো হও,/ তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও।
পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের বেদনা হয়তো বা কখনও তাঁকে পীড়িত করে থাকতে পারে, কিন্তু মৃত্যুভয়ে ভীত হওয়ার মতো কোনও নিদর্শন কবিগুরুর জীবনের চালচিত্রে কোথাও কখনও ধরা পড়েনি। জীবন তরী যে ঘাটের শেষ সীমানায় উপস্থিত তা হয়তো আগেই বুঝতে পেরেছিলেন কবিগুরু। কিন্তু তাতেও মৃত্যুর সামনে মাথা নত করেননি তিনি। তিনি যেন মৃত্যু চোখে চোখ রেখে হেসেছিলেন মুচকি। তিনি যে নিজেই মৃত্যুঞ্জয়ী তা কেবল মৃত্যুশোক সহ্য করেই নয়, তাঁর লেখাতেও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে / যাব আমি চলে।
১৯৪১ সালে ২২ শ্রাবণ অস্তমিত রবি। ‘শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্’ মন্ত্র, ‘ওঁ পিতা নোঽসি’ শ্লোক, ব্রহ্মসঙ্গীতে মুখর কবির ঘর। বারোটার ঠিক আগে ডান হাতখানা কাঁপতে কাঁপতে উপরে তুলে কপালে ঠেকানোর আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবিগুরু। মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা বাংলা। শান্তিনিকেতনে পৌঁছয় কবি বিদায়ের বার্তা। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ মতো শান্তিনিকেতনে মন্দিরের উপাসনায় গাওয়া হয় এক অমোঘ সঙ্গীত।
মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা তোমার দয়া / হবে চির পাথেয় চিরযাত্রার । হয় যেন মর্তের বন্ধনক্ষয়, বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়–পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয় মহা-অজানার।।
বলা হয়ে থাকে শিল্পীদের মৃত্যু হয়না। তারা অমর হয়ে থাকেন তাদের শিল্পের মাধ্যমে। আর যেখানে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ ওঠে, সেক্ষেত্রে কখনোই তাঁর মৃত্যু ২২ শে শ্রাবণে হতে পারে না। তিনি আজও বেঁচে আছেন। তাঁর লেখা, কবিতা দ্বারাই নয়, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনচর্যাতেও তিনি মৃত্যুকে বারবার অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, অতিক্রম করেছেন। আর সেখানেই হয়তো তিনি প্রকৃত মৃত্যুঞ্জয়ী।