Satipith । কোথায় পড়েছিল দেবীর ত্রিনয়ন ? কোথায়ই বা দেবী পুজো পান মহিষাসুরমর্দিনী রূপে? পশ্চিমবঙ্গের ১৫টি সতীপীঠের অজানা কাহিনী, পুরাণের জবানীতে
পৃথিবীর বিভিন্নপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ৫১টি সতীপীঠ। হিন্দু ধর্মে এই পীঠগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র জায়গা বলে বিবেচিত। ৫১টি সতীপীঠের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ১৫টি সতীপীঠ (মতান্তরে ১৩টি)। কিন্তু এই সতীপীঠ আসলে কী ? কেনই বা হিন্দু ধর্মে এই পীঠের এতো গুরুত্ব ? তাদের নেপথ্যে রয়েছে কোন অজানা ইতিহাস? জেনে নিন পশ্চিমবঙ্গের কোথায় রয়েছে কোন সতীপীঠ এবং এই পীঠস্থানগুলির মাহাত্ম্য ও ইতিহাস।
পৃথিবীর বিভিন্নপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ৫১টি সতীপীঠ। হিন্দু ধর্মে এই পীঠগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র জায়গা বলে বিবেচিত। ৫১টি সতীপীঠের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ১৫টি সতীপীঠ (মতান্তরে ১৩টি)। কিন্তু এই সতীপীঠ আসলে কী ? কেনই বা হিন্দু ধর্মে এই পীঠের এতো গুরুত্ব ? তাদের নেপথ্যে রয়েছে কোন অজানা ইতিহাস? জেনে নিন পশ্চিমবঙ্গের কোথায় রয়েছে কোন সতীপীঠ এবং এই পীঠস্থানগুলির মাহাত্ম্য ও ইতিহাস।
পিতা রাজা দক্ষের অমতে চালচুলোহীন মহাদেবকে বিয়ে করেছিলেন রাজকন্যা সতী। এই ঘটনায় রেগে যান হিমালয়রাজ দক্ষ। জামাইকে অপমান করতে এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেন তিনি,কিন্তু সেখানে সতীকে নিমন্ত্রন করেননি দক্ষ। এই ঘটনায় রেগে গেলেন মহাদেব ঘরণী। স্বামীর বারণ সত্বেও গিয়ে হাজির হলেন যজ্ঞের জায়গায়। পিতা দক্ষ যারপরনাই অপমান করলেন তাঁকে, মহাদেবকেও ব্যঙ্গ করতে ছাড়লেন না। স্বামীর অপমান সইতে না পেরে যজ্ঞের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ ত্যাগ করলেন দেবী সতী।প্রিয় পত্নীর মৃত্যুতে ভীষণ রেগে গেলেন মহাদেব। সতীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে তান্ডব নৃত্য শুরু করলেন তিনি। তাঁর নাচের তোড়ে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার জোগাড় হলে, প্রলয় থামাতে ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর দেহ ৫১ খণ্ডে বিভক্ত করেন।এই খণ্ডগুলি যেসব জায়গায় পরে সেখানে একটি করে তীর্থস্থান তৈরী হয়। এই জায়গাগুলিকেই বলা হয় সতীপীঠ । ভারত সহ বাংলাদেশ,পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় এই ৫১ সতীপীঠ অবস্থিত। হিন্দু ধর্মে এই জায়গাগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র জায়গা বলে বিবেচিত।এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ১৫টি সতীপীঠ ( মতান্তরে ১৩টি ), আজ জানব সেগুলির নেপথ্যের কাহিনী।
বর্গভীমা: পুরান অনুযায়ী সতীর ৫১ পীঠের প্রথম পীঠস্থান হল বর্গভীমা। পশ্চিম মেদিনীপুরের তমলুকে অবস্থিত এই মন্দির। এখানে দেবীর বাঁ পায়ের গোড়ালি পড়েছিল বলে জানা যায়। এই পীঠের কথার উল্ল্যেখ আছে ভারতচন্দ্রের ' অন্নদামঙ্গল' কাব্যেও। দেবী এখানে পূজিত হন 'বর্গভীমা' রূপে, মহাদেব পূজিত হন 'সর্বানন্দ' রূপে।
রত্নাবলি: হুগলি জেলার খানাকুলে অবস্থিত এই সতীপীঠ। পুরাণমতে দেবী সতীর ডান কাঁধ পড়েছিল এই পীঠে। এখানে দেবী পূজিত হন ' কুমারী ' রূপে , মহাদেব ভৈরবকে বলা হয় 'ঘন্টেশ্বর'। পুজোর ক্ষেত্রে এই পিঠ ব্যতিক্রম , এখানে দেবীর থেকে বেশি পুজো পান ভৈরবই।
ত্রিস্রোতা: জলপাইগুড়ি জেলায় তিস্তা নদীর পাড়ে এই সতীপীঠ অবস্থিত। পুরান অনুযায়ী দেবীর বাঁ পা পড়েছিল এই পীঠে। এখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন দেবী 'ভ্রামরী' এবং ভৈরব হলেন 'ঈশ্বর'। কথিত আছে,দেবী দুর্গা অরুণাসুরকে পরাজিত করতে অসংখ্য ভ্রমরের রূপ ধারণ করেন, সেখান থেকেই এই ভ্রামরী নামের উৎপত্তি।
অট্টহাস বা ফুল্লরা: এটি বীরভূম জেলার লাভপুরের কাছে অবস্থিত। অনেকের মতে, এটি একটি উপপীঠ। পুরাণমতে, দেবীর ওষ্ঠ পড়েছিল এই স্থানে। দেবী এখানে 'ফুল্লরা' রূপে পূজিত হন, ভৈরব 'বিশ্বেশর' রূপে।
উজানি: বর্ধমান জেলার কোগ্রামে অবস্থিত এই সতীপীঠ মঙ্গলচন্ডী' নামেও পরিচিত। দেবীর ডান হাতের কনুই পড়েছিল এই স্থানে। এখানে দেবী পূজিত হন 'মঙ্গলচণ্ডী' রূপে, ভৈরব পুজো পান 'কপিলেশ্বর' বা 'কপিলাম্বর' রূপে।
কিরীটেশ্বরী: এই সতীপীঠ অবস্থিত মুর্শিদাবাদের কিরীটকণা গ্রামে । দেবী সতীর মাথার মুকুটের একটি অংশ পড়েছিল এই পীঠে , কেউ কেউ বলেন, এখানে পড়েছিল দেবীর করোটির অংশ। এখানকার অধিষ্ঠাত্রী হলেন দেবী 'বিমলা' এবং ভৈরব এখানে পুজো পান 'সংবর্ত' রূপে।
নন্দিকেশ্বরী: এই মন্দিরটি অবস্থিত বীরভূমের সাঁইথিয়ার কাছে। কথিত আছে, সতীর গলার হাড় পড়েছিল এখানে । দেবী এখানে পূজিত হন 'নন্দিনী' রূপে এবং ভৈরব পূজিত হন 'নন্দিকেশ্বর' রূপে।
কঙ্কালীতলা: বীরভূম জেলার কোপাই নদীর তীরে অবস্থিত এই সতীপীঠটি । বলা হয়, এখানে দেবীর কাঁকাল বা কোমরের অংশ পড়েছিল। অধিষ্ঠিত দেবী এখানে অধিষ্ঠিত 'দেবগর্ভা' রূপে এবং ভৈরব হলেন 'রুরু'। কারো কারো মতে, দেবী এখানে অধিষ্ঠিতা 'রত্নাগর্ভি' নামে ।
বহুলা: বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে অজয় নদের ধারে এই সতীপীঠ অবস্থিত । পুরাণ বলে, এখানে দেবীর বাঁ হাত পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিতা দেবীর নাম 'বহুলা' এবং ভৈরবের নাম 'ভীরুক' ।
যোগাদ্যা: বর্ধমান জেলার ক্ষীরগ্রামে অবস্থিত এই পীঠে সতীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছিল বলে কথিত আছে। দেবীর নাম এখানে 'যোগাদ্যা' বা 'যুগাদ্যা', ভৈরব এখানে পূজিত হন 'ক্ষীরকণ্ঠক' নামে।
জয়ন্তী: ভুটান সীমান্তে, আলিপুরদুয়ার জেলায় অবস্থিত এই সতীপীঠ। পুরাণ মতে, এখানে সতীর বামজঙ্ঘা পড়েছিল। অধিষ্ঠিত দেবীর নাম এখানে 'জয়ন্তী' এবং ভৈরব 'ক্রমদীশ্বর'।
নলহাটেশ্বরী: বীরভূমের নলহাটিতে নলহাটেশ্বরী মন্দির বেশ বিখ্যাত। একে কেউ কেউ উপপীঠ বলে থাকেন। বলা হয়, সতীর গলার নলি বা কণ্ঠনালী পড়েছিল এখানে। দেবী এখানে 'শেফালিকা' এবং ভৈরব 'যোগীশ' নামে পরিচত।
বক্রেশ্বর: বীরভূম জেলায় পাপহরা নদীর তীরে অবস্থিত বক্রেশ্বর মন্দির উষ্ণ প্রশ্রবণের জন্যে খ্যাত। পুরাণ মতে , দেবীর দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী অংশ পড়েছিল এখানে। এখানকার অধিষ্ঠিত দেবী 'মহিষাসুরমর্দিনী', ভৈরব 'বক্রেশ্বর' বা 'বক্রনাথ'।
তারাপীঠ: বীরভূমের রামপুরহাটের কাছে এই সতীপীঠ ভক্তদের মধ্যে বেশ খ্যাত। তবে অনেকেই এই পীঠস্থানকে সতীপীঠ হিসেবে মানেন না। দেবীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল এখানে। এখানকার পীঠরক্ষক হলেন শিব, যিনি 'চন্দ্রচূড়' নামে পুজো পান।
কালীঘাট: শহর কলকাতার বুকে এই সতীপীঠকে আদি সতীপীঠ হিসেবে মান্য করা হয়। বিখ্যাত এই পীঠে শয়ে শয়ে মানুষ আসেন পুজো দিতে। কথিত আছে, দেবীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছিল এখানে। এখানকার অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন 'দক্ষিণাকালী' এবং ভৈরবের নাম 'নকুলেশ্বর'।
এছাড়াও ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র সতীপীঠ, যেমন, অমরনাথ, প্রয়াগ , বারাণসী ইত্যাদি। স্থানমাহাত্ম্যে এই পীঠস্থানগুলিতে শয়ে শয়ে ভক্ত আসেন নিজের মনকামনা জানাতে। বিশেষ তিথি অনুসারে বিশেষ পুজোয় নাকি ফললাভও হয় ভাগ্যবানের।হাতে যদি সময় থাকে, তবে ঘুরে আসতেই পারেন এই পুণ্যস্থানগুলিতে। দেবীদর্শন ও ভ্রমণে প্রফুল্ল হবে মন।