World Haemophilia Day | রক্তের এই বিরল রোগ হয়েছিল রানি ভিক্টোরিয়ার! মৃত্যু হয়েছিল ব্রিটিশ রাজ পরিবারের অনেকের!আজও নেই 'রয়্যাল ডিজিজের' স্থায়ী চিকিৎসা!
![highlight](/img/target.png)
হিমোফিলিয়া একটি গুরুতর রক্তের ব্যাধি। যার স্থায়ী চিকিৎসা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে, হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সচেতন ও সতর্ক থাকা উচিত। বিশ্বে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতেই ১৭ই এপ্রিল বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস পালন করা হয়।
হিমোফিলিয়া একটি বিরল এবং গুরুতর রক্তের ব্যাধি। যা সময়মতো চিকিৎসা না-হলে এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা ও যত্ন না-নিলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়তে পারে। এই রোগের স্থায়ী চিকিৎসা এখনও সম্ভব নয়। তাই এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সারাজীবন তাদের স্বাস্থ্যের আরও যত্ন এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। আর এই রোগ সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রতিবছর ১৭ই এপ্রিল পালন করা হয় বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস (World Hemophilia Day)।
হিমোফিলিয়া | Haemophilia :
এমন অনেক জন্মগত রোগ রয়েছে, যেগুলির সময়মতো চিকিৎসা না হলে পরে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এরকম একটি মারাত্মক রোগ হল হিমোফিলিয়া। সময়মতো চিকিৎসা না করালে তা পরবর্তী কালে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, হিমোফিলিয়া নামের মারাত্মক রোগটি শিশুর জন্মের পর থেকেই ৮ এবং ৯ ফ্যাক্টরের অভাবের কারণে ঘটে। এমতাবস্থায় প্রাথমিক পর্যায়ে এটি শনাক্ত এবং চিকিৎসা না করা হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে। এমনকী এই রোগ মৃত্যুর কারণও হয়ে উঠতে পারে। যার ফলে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হিমোফিলিয়া দিবস (Hemophilia Day) পালন করা হয়।
![হিমোফিলিয়া একটি বিরল এবং গুরুতর রক্তের ব্যাধি](https://media.bengalbyte.in/photo/1713353438459-hemophilia 2.webp)
হিমোফিলিয়া কী?
রক্তের এই ব্যাধিতে রক্ত জমাট বাঁধার জিনের গোলযোগের কারণে রক্তে জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া কমে যায় বা জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া খুব ধীর হয়ে যায়। আসলে রক্ত জমাট বেঁধে শরীরের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অঙ্গে রক্ত চলাচল বন্ধ করে এবং রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তে ফ্যাক্টর এইট এবং ফ্যাক্টর নাইনের অভাবেই মূলত এ রোগ হয়ে থাকে। আর এই ফ্যাক্টর এইট এবং ফ্যাক্টর নাইন রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। যাদের শরীরে এই ফ্যাক্টর থাকে না, তাদের শরীরে দেরিতে রক্ত জমাট বাঁধে বা কখনো রক্ত জমাট বাঁধে না। এ কারণে রক্তপাতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। হিমোফিলিয়া রোগের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একটি ‘এক্স ক্রোমোজম লিংকড ডিজঅর্ডার’। মানে, এ রোগের বাহক নারী, কিন্তু নারীরা এ রোগে আক্রান্ত হন না। নারীরা এ রোগ বংশানুক্রমিকভাবে পুরুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। তখন পুরুষেরা এই রোগে আক্রান্ত হন। প্রসঙ্গত, ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া (Queen Victoria) ছিলেন হিমোফিলিয়ার বাহক। এমনকি তাঁর সন্তান প্রিন্স লিওপোল্ডের মৃত্যু হয় রক্তপাতে।
কারণ এবং উপসর্গ :
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, পিতামাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বংশগতি বা ত্রুটিপূর্ণ জিনকে হিমোফিলিয়ার জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় । অর্থাৎ হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত এই রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই রোগ জন্মের পর জেনেটিক ব্যাধির কারণেও হতে পারে। এই অবস্থাগুলিকে স্পোরাডিক হিমোফিলিয়া বলা হয় ৷ কখনও কখনও জন্মের পরে, অটোইমিউন ডিসঅর্ডার, ক্যানসার, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কখনও কখনও গর্ভাবস্থায়, ক্লোটিং ফ্যাক্টর প্রোটিন তৈরিকারী জিনটির সমস্যা হতে শুরু করে। যা এই রোগের কারণ হতে পারে। যদিও এই ধরনের ঘটনা খুব কম সংখ্যায় দেখা যায় । পরিসংখ্যান অনুসারে, মোট আক্রান্তের মাত্র ৩০% তারা যাদের মধ্যে হিমোফিলিয়া জিনগত কারণে হয় না।
রক্তপাতজনিত সমস্যাই এ রোগের মূল উপসর্গ। যেমন সদ্যোজাত নবজাতকের নাড়ি কাটার পর রক্ত বন্ধ হতে দেরি হওয়া। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে হামাগুড়ি বা হাঁটা শেখার সময় যেকোনো অস্থিসন্ধি বিশেষত হাঁটু ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা। কাটাছেঁড়া বা টিকা দেওয়ার স্থানে রক্তপাত বন্ধ না হওয়া। খতনা করার পর বা দাঁত তোলার পর রক্তপাত বন্ধ না হওয়া। সাধারণত এ রোগে হাঁটু ও কনুইয়ের অস্থিসন্ধি বেশি আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া মাংসপেশি, মুখগহ্বর, মাথার খুলি, পেটেও রক্তপাত হতে পারে। অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে রক্তশূন্যতা ও অস্থিসন্ধির ক্ষয়, ব্যথা কিংবা মৃত্যু হতে পারে। এ–জাতীয় উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তের ফ্যাক্টরের পরিমাণ নির্ধারণ করে রোগনির্ণয় করতে হবে।
![রক্তপাতজনিত সমস্যাই এ রোগের মূল উপসর্গ](https://media.bengalbyte.in/photo/1713353488508-hemophilia symptoms.webp)
হিমোফিলিয়ার প্রকারভেদ :
যদিও কারণগুলির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরণের হিমোফিলিয়া বিবেচনা করা হয়েছে ৷ তবে তাদের মধ্যে হিমোফিলিয়া টাইপ এ এবং হিমোফিলিয়া টাইপ বি এর ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। হিমোফিলা এ (Haemophilia A) এবং বি (Haemophilia B) সবচেয়ে সাধারণ। হিমোফিলিয়া এ/বি হল একটি এক্স-লিঙ্কযুক্ত রিসেসিভ জেনেটিক ডিসঅর্ডার।
চিকিৎসা :
এটি লক্ষণীয় যে হিমোফিলিয়া একটি দূরারোগ্য ব্যাধি যার স্থায়ী চিকিৎসা এখনও সম্ভব নয় ৷ তবে ওষুধ এবং কিছু থেরাপির সাহায্যে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির উচিত শৃঙ্খলার সঙ্গে তার ওষুধ ও থেরাপি অনুসরণ করা । এছাড়াও, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বা থেরাপি বন্ধ না করা। হিমোফিলিয়ার কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই। রক্তপাত শুরু হলে শিরাপথে ফ্যাক্টর ইনজেকশনের মাধ্যমেই মূল চিকিৎসা করা হয়। এ ছাড়া অনেক সময় ফ্যাক্টর না পাওয়া গেলে ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, ফ্রেশ ব্লাড, ট্রানেকজামিক অ্যাসিড দিয়ে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। অস্থিসন্ধি ফুলে গেলে বা ব্যথা হলে ফিজিওথেরাপির সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়।
![হিমোফিলিয়া একটি দূরারোগ্য ব্যাধি যার স্থায়ী চিকিৎসা এখনও সম্ভব নয়](https://media.bengalbyte.in/photo/1713353514338-hemophilia treatment.webp)
বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস । World Haemophilia Day :
ফেডারেশন অফ হিমোফিলিয়া (Federation of Hemophilia) অনুসারে, হিমোফিলিয়া একটি বিরল এবং গুরুতর রোগ। এই রোগটি মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায় । ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজির ওয়েবসাইটে পাওয়া একটি রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে প্রতি ১০,০০০ জন্মে ১ জন হিমোফিলিয়ায় ভুগে থাকেন। এই রোগের স্থায়ী চিকিৎসা এখনও পাওয়া যায়নি। যার ফলে সমাজে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রতি বছর ১৭ই এপ্রিল পালন করা হয় বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস (World Haemophilia Day)।
বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস পালনের ইতিহাস :
বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস (World Hemophilia Day) ১৯৮৯ সালে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ হিমোফিলিয়া (WFH) দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ফ্র্যাঙ্ক শ্নাবেলকে (Frank Schnabel) সম্মান জানাতেই মূলত প্রতি বছর ১৭ এপ্রিলকে হিমোফিলিয়া দিবস (Hemophilia Day) হিসেবে পালন করার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। ফ্র্যাঙ্ক শ্নাবেল হিমোফিলিয়া সম্পর্কে সচেতনতা এবং চিকিত্সার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং এই ব্যাধিতে আক্রান্তদের জীবন উন্নত করার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। হিমোফিলিয়া শব্দটি 'হেমোরাফিলিয়া' দ্বারা এসেছে যা জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ শোনলেইন এবং তাঁরছাত্র ফ্রেডরিখ হপফ দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল।
বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবসের তাৎপর্য :
হিমোফিলিয়া এমন একটি বিরল জেনেটিক রোগ যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। হিমোফিলিয়ার সঠিক সময়ে নির্ণয় না করা হলে, এটি অস্ত্রোপচার বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই এই রোগ নির্ণয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে এমন একটি শিশুর জন্ম হয়, যার মধ্যে হিমোফিলিয়া রোগ দেখা যায়। হিমোফিলিয়ায় সতর্কতাই মূল অস্ত্র। এই রোগ হলে শরীরে আঘাত লাগতে পারে, এমন কোনো কাজে অংশগ্রহণ না করা, মাংসপেশিতে ইনজেকশন না নেওয়া, যেকোনো অস্ত্রোপচারের আগে রক্তের ফ্যাক্টরের পরিমাণ পরিমাপ করা, যেকোনো ব্যথানাশক ওষুধ পরিহার করার ক্ষেত্রে নজর রাখতে হবে। যেহেতু এটি একটি বংশগতির রোগ, পরিবারে এ–জাতীয় রোগের ইতিহাস থাকলে সচেতন থাকা। সচেতনতাই এ রোগের ঝুঁকি কমায়। তাই হিমোফিলিয়ার সম্পর্কে সচেতন থাকা একান্ত জরুরি। যার জন্য সমাজকে এই রোগ সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন করতেই বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস পালন করা হয়।
![এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রতি বছর ১৭ই এপ্রিল পালন করা হয় বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস](https://media.bengalbyte.in/photo/1713353537454-world haemophilia day.webp)
হিমোফিলিয়ার সঙ্গে রানি ভিক্টোরিয়া যোগ । Queen Victoria's Connection with Haemophilia :
রানি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে ছিল এই রোগের যোগ। রানি ভিক্টোরিয়া (Queen Victoria), ব্রিটেনের রানি যিনি শাসনকালে বিশ্বের এক চতুর্থাংশ শাসন করেছিলেন তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন হিমোফিলিয়াতে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, রানি ভিক্টোরিয়াই এই রোগের প্রথম শিকার হন, তারপরে এই রোগটি রাজ পরিবারের আরও অনেকের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। এই রোগ সম্পর্কে প্রথম জানা যায় যখন ব্রিটেনের রাজপরিবারের একের পর এক সদস্য ধীরে ধীরে এই রোগের শিকার হতে থাকে। ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার পর ব্রিটেনের রাজপরিবারের অনেক সদস্যই হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হন এবং এই রোগেই তাঁদের মৃত্যু হয়। রানি ভিক্টোরিয়া ছাড়াও তাঁর দুই মেয়ে এবং এক ছেলেও হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই রোগের ফলে ভিক্টোরিয়ার ছেলে প্রিন্স লিওপোল্ডেরও মৃত্যু ঘটে। একটি দুর্ঘটনার পর প্রিন্স লিওপোল্ডের রক্তপাত বন্ধ করা কঠিন করে তোলে এই রোগ। তখন যুবরাজের বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর। পরবর্তীতে, রানি ভিক্টোরিয়ার দুই মেয়ে যখন বিভিন্ন দেশের রাজাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তখন এই রোগটি বংশগতভাবে বিভিন্ন দেশের রাজপরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
![রানি ভিক্টোরিয়াই এই রোগের প্রথম শিকার হন, তারপরে এই রোগটি রাজ পরিবারের আরও অনেকের মৃত্যুর কারণ হয়েছে](https://media.bengalbyte.in/photo/1713353590847-queen victoria hemophilia.webp)
যদিও অনেকে বলে থাকেন, প্রাচীন মিশরে হিমোফিলিয়ার প্রথম আবির্ভাবের হদিশ পাওয়া গিয়েছিলো।যার জন্য এই রোগটি একটি 'রাজকীয় রোগ' (royal disease) হিসাবে পরিচিত পায়। তবে বর্তমানে অনেক দেশেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জন্ম নেওয়া প্রতি ২৫,০০০ জনের মধ্যে ১ জন হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হন।
- Related topics -
- লাইফস্টাইল
- স্বাস্থ্য
- রোগ
- ব্রিটিশ রাজ পরিবার