Rabindranath Tagore | ১৬৪তম জন্মবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ এবং মানবসভ্যতার সংঘাত!

রাজায় রাজায় যুদ্ধ বেঁধেছে। উলুখাগড়াদের প্রাণনাশের বদলা নেওয়া হবে উলুখাগড়াদের বাসভূমি উড়িয়েই। সেখানে রাজার ভূমিকা কী? রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন? রবিকবির জন্মের ১৬৪ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বলেন- 'সমস্ত ইউরোপে আজ এক মহাযুদ্ধের ঝড় উঠেছে-কতদিন ধরে গোপনে গোপনে এই ঝড়ের আয়োজন চলছিল। অনেকদিন থেকে আপনার মধ্যে আপনাকে যে মানুষ কঠিন করে বন্ধ করেছে, আপনার জাতীয় অহমিকাকে প্রচন্ড করে তুলেছে, তার সেই অবরুদ্ধতা আপনাকেই আপনি একদিন বিদীর্ণ করবেই করবে।'
রাজায় রাজায় যুদ্ধ বেঁধেছে। উলুখাগড়াদের প্রাণনাশের বদলা নেওয়া হবে উলুখাগড়াদের বাসভূমি উড়িয়েই। সেখানে রাজার ভূমিকা কী? রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন?
রবিকবির জন্মের ১৬৪ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। সিন্ধুতে গড়িয়েছে অনেক জল। তাঁর সময়কালে তিনি দেখেছেন রাশিয়া:ফ্রান্স:জার্মানি:অস্ট্রিয়া:ব্রিটেনের যুদ্ধের আবহ, জাপান চীন আক্রমণ। তার প্রেক্ষিতে তিনি লিখেছেন একাধিক কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস। আজ এই দুদেশের সীমারেখায় যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের লিপিকা কাব্যগ্রন্থের একটি ছোটগল্প খুব প্রাসঙ্গিক।
বিদূষক
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১
কাঞ্চীর রাজা কর্ণাট জয় করতে গেলেন। তিনি হলেন জয়ী। চন্দনে, হাতির দাঁতে, আর সোনামাণিকে হাতি বোঝাই হল।
দেশে ফেরবার পথে বলেশ্বরীর মন্দির বলির রক্তে ভাসিয়ে দিয়ে রাজা পূজো দিলেন।
পূজো দিয়ে চলে আস্চেন—গায়ে রক্তবস্ত্র, গলায় জবার মালা, কপালে রক্তচন্দনের তিলক—সঙ্গে কেবল মন্ত্রী আর বিদূষক।
একজায়গায় দেখ্লেন, পথের ধারে আমবাগানে ছেলেরা খেলা করচে।
রাজা তাঁর দুই সঙ্গীকে বল্লেন, “দেখে আসি, ওরা কি খেল্চে।”
২
ছেলেরা দুই সারি পুতুল সাজিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেল্চে।
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “কার সঙ্গে কার যুদ্ধ?”
তারা বল্লে, “কর্ণাটের সঙ্গে কাঞ্চীর।”
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “কার জিত, কার হার?”
ছেলেরা বুক ফুলিয়ে বল্লে, “কর্ণাটের জিৎ, কাঞ্চীর হার।”
মন্ত্রীর মুখ গম্ভীর হল, রাজার চক্ষু রক্তবর্ণ, বিদূষক হা হা করে হেসে উঠ্ল।
৩
রাজা যখন তাঁর সৈন্য নিয়ে ফিরে এলেন, তখনো ছেলেরা খেল্চে।
রাজা হুকুম করলেন, “একেকটা ছেলেকে গাছের সঙ্গে বাঁধো, আর লাগাও বেত!”
গ্রাম থেকে তাদের মা-বাপ ছুটে এল। বল্লে, “ওরা অবোধ, ওরা খেলা কর্ছিল, ওদের মাপ কর।”
রাজা সেনাপতিকে ডেকে বল্লেন, “এই গ্রামকে শিক্ষা দেবে, কাঞ্চীর রাজাকে কোনো দিন যেন ভুল্তে না পারে।”
এই বলে শিবিরে চলে গেলেন।
৪
সন্ধ্যে বেলায় সেনাপতি রাজার সমুখে এসে দাঁড়াল। প্রণাম করে বল্লে, “মহারাজ, শৃগাল কুকুর ছাড়া এ গ্রামের কারো মুখে শব্দ শুন্তে পাবে না।”
মন্ত্রী বল্লে, “মহারাজের মান রক্ষা হল।”
পুরোহিত বল্লে, “বিশ্বেশ্বরী মহারাজের সহায়।”
বিদূষক বল্লে, “মহারাজ, এবার আমাকে বিদায় দিন্।”
রাজা বললেন, “কেন?”
বিদূষক বললে, “আমি মার্তেও পারিনে, কাট্তেও পারিনে, বিধাতার প্রসাদে আমি কেবল হাস্তে পারি। মহারাজের সভায় থাক্লে আমি হাস্তে ভুলে যাব।”
---------
এই দুদেশের যুদ্ধের আবহে, জঙ্গি মনেদের হানাহানিতে, ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ খুনোখুনিতে, রাষ্ট্র বনাম হিংসার দুনিয়াতে মানবতার দোহাই দিয়ে আমরা কতদূর চলবো সেটাই বড়ো প্রশ্ন। এই প্রশ্ন বেজেছিল রবীন্দ্রনাথের বুকেও।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বলেন- সমস্ত ইউরোপে আজ এক মহাযুদ্ধের ঝড় উঠেছে-কতদিন ধরে গোপনে গোপনে এই ঝড়ের আয়োজন চলছিল। অনেকদিন থেকে আপনার মধ্যে আপনাকে যে মানুষ কঠিন করে বন্ধ করেছে, আপনার জাতীয় অহমিকাকে প্রচন্ড করে তুলেছে, তার সেই অবরুদ্ধতা আপনাকেই আপনি একদিন বিদীর্ণ করবেই করবে।...
আজ মানুষ মানুষকে পীড়ন করবার জন্য নিজের এই অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্রকে ব্যবহার করছে। তাই সেই ব্রহ্মাস্ত্র আজ তারই বুকে বেজেছে।...(প্রতিরোধ প্রতিদিন’, সম্পাদনা: দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ: ৩২২)