বিনোদন

Poila Baisakh | ১লা বৈশাখে 'বসুশ্রী'র জলসায় আসতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্ররা! ডুয়েট গেয়ে মন জিতেছিলেন উত্তম-সন্ধ্যাও!

Poila Baisakh | ১লা বৈশাখে 'বসুশ্রী'র জলসায় আসতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্ররা! ডুয়েট গেয়ে মন জিতেছিলেন উত্তম-সন্ধ্যাও!
Key Highlights

হালখাতা হোক অথবা বাংলা ক্যালেণ্ডার, আপামোর বাঙালির কাছে পয়লা বৈশাখ মানেই জলসা, গান বাজনার আসর। বসুশ্রী সিনেমা হলে বসতো এমন আড্ডা যেখানে যোগ দিতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মন্টু বসু, শ্যামল মিত্র, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অজিত চট্টোপাধ্যায়ের মতো তারকারা।

সামনেই নববর্ষ (nababarsha)। বর্ষবরণের আনন্দে গা ভাসাতে প্রস্তুত আট থেকে আশি সকলেই। ইতিমধ্যে সকলের কেনাকাটা, ঘর গোছানো সব প্রায় শেষ। পয়লা বৈশাখ (poila baisakh) নিয়েই কমবেশি সকল বাঙালিরই স্মৃতি-টান অমলিন।পয়লা বৈশাখ মানেই ষোল আনা বাঙালিয়ানা। আর বাংলা-বাঙালি যেখানে সেখানে আড্ডা বা জলসা থাকবে না এ যেন কল্পনাতীত। নববর্ষ (noboborsho) এর সঙ্গে যেমন বাংলা তথা বাঙালির রীতি, ঐতিহ্য, পরম্পরার যেন এক প্রাচীন সম্পর্ক। হালখাতা হোক অথবা বাংলা ক্যালেণ্ডার, আপামোর বাঙালির কাছে পয়লা বৈশাখ মানেই জলসা, গান বাজনার আসর। তবে আজ কথা বলা যাক এমন এক আড্ডার কথা যেখানে যোগ দিতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মন্টু বসু, শ্যামল মিত্র, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অজিত চট্টোপাধ্যায়ের মতো তারকারা। বসুশ্রী সিনেমা হল (basusree cinema hall) এর এই আড্ডাকে টালিগঞ্জ পাড়ার অভিনয় ও সঙ্গীত জগতের নক্ষত্র সমাবেশ বললে খুব ভুল হবে না। প্রতি বছর বসুশ্রীর মন্টু বসু এই জলসা আয়োজন করতেন। আর দীর্ঘ সময় এই জলসার প্রধান আকর্ষণ ছিল মহানায়ক উত্তমকুমারের (Uttam Kumar) উপস্থিতি।

বসুশ্রীতে তারকাদের জলসা!

পয়লা বৈশাখ (poila baisakh) এর জলসা আর বসুশ্রী সিনেমা হল (basusree cinema hall) এর মধ্যে যোগসূত্রটা দীর্ঘদিনের। বছরের প্রথম দিনে জলসা দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন হাজারে হাজারে মানুষ। এমনকি এই জলসার সাক্ষী থাকতে ভিন রাজ্য থেকেও মানুষজন ভিড় করত বসুশ্রী হলে। এদিকে এই জলসার টিকিটের বালাই ছিল না বললেই চলে। তাই জলসা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তা হাউসফুল! আর এই জলসায় অংশ নিতেন তাবড় তাবড় গুণী শিপ্লীরা। শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এমনকী লতা মঙ্গেশকর, সূচিত্রা সেনও অংশ নেন সেই জলসায়।

জলসার প্রাণপুরুষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যার একান্ত প্রচেষ্টাতেই শুরু হয় বসুশ্রী’র এই জলসা। আর বসুশ্রীর আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন, সুশীল মজুমদার, অসিতবরণ, বিকাশ রায়রা। মাঝে মাঝে আসতেন ছবি বিশ্বাস, উত্তমকুমার। বলে  রাখা ভালো উত্তমকুমারের ছোটবেলার বন্ধুরা প্রায় সবাই বসুশ্রীতে আড্ডা মারতেন। ফলে উনি মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরার পথে ওখানে এসে দেখা করে যেতেন। মেগাফোনের কমল ঘোষ আসতেন। আর ছিলেন শ্যামল মিত্র। এদিকে কলকাতায় থাকলে আসতেন কিশোর কুমারও। বসুশ্রীর কর্ণধার ছিলেন মন্টু বসু। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে প্রতিবছর নববর্ষ (nababarsha) এর সকালে বসত জলসা। এই জলসায় একবার নিজের কণ্ঠে গান গেয়ে শ্রোতাদের মন জুড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং মহানায়ক উত্তম কুমার।

বসুশ্রীর আড্ডায় গান গেয়ে মন জুড়িয়েছিলেন মহানায়ক!

এক নববর্ষতে (noboborsho) বসুশ্রীর জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকতে পারেননি। বিশেষ কাজে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কলকাতার বাইরে গেছেন। পয়লা বৈশাখের দিন কলকাতায় থাকলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই অনুষ্ঠানে নিয়মিত এসেছেন। কিন্তু সে বার তিনি নেই। ফলে জলসার মঞ্চে চলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একক সঙ্গীত পরিবেশন। তবলায় সঙ্গত করনে লেজেন্ডারি তবলাশিল্পী রাধাকান্ত নন্দী। যে কোন জলসায় বড় আকর্ষণ ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান আর রাধাকান্ত নন্দীর তবলার যুগলবন্দি। ফলে দর্শকরা তো একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ।

সেসময় বসুশ্রী সিনেমাহলে শিল্পীদের জন্য আলাদা কোনও গ্রিনরুম ছিল না। গ্রিনরুম পরে তৈরি হয়। শিল্পীরা যাঁরা গাইবেন, মঞ্চের সামনেই বসতেন। যাঁর যখন ডাক পড়ত, সোজা মঞ্চে উঠতেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর একক প্রোগ্রাম শেষ করে হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, মহানায়ক উত্তমকুমার এসেছেন। তাঁকে দেখে প্রেক্ষাগৃহে রীতিমতো গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। মন্টু বসু, ইম্প্রেসারিও বারীন ধর আরও অনেকে উত্তমকুমারকে কীসব যেন হাত-পা নেড়ে বোঝাতে শুরু করেন। আর মহানায়কও তাঁদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন। তখনই মন্টু বসুরা মঞ্চে বসা সন্ধ্যাকে ইশারায় বললেন, 'তুমি স্টেজ থেকে এখন নামবে না।' আর এরপরই ঘটল ইতিহাস। মন্টু বসুরা জোর করে ঠেলে উত্তমকুমারকে স্টেজে তুলে দিলেন! ঘোষণা হল, 'এই পথ যদি না শেষ হয়' গাইবেন উত্তম-সন্ধ্যা! ডুয়েটে! তখন  তখন 'সপ্তপদী'র এই গান মানুষের মুখে মুখে। ফিল্মে গেয়েছিলেন উত্তমের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সুচিত্রার লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গানের সংগীত পরিচালক হেমন্ত নিজেই। কিন্তু গান মুখস্ত না থাকায় ঘোর বিপদে পড়েন মহানায়ক। তবে ভাগ্যিস সেদিন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মোটা গানের খাতাটায় গানটা লেখা ছিল! তা দেখেই গেয়ে উঠলেন উত্তম। হারমোনিয়াম বাজান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। উত্তম কুমারের তো গানের গলা বেশ সুন্দর ছিল। প্রথম যৌবনে গান শিখিয়েওছেন উত্তম। যখন ‘তুমি বলো, না তুমিই বলো’ ওই জায়গাগুলো আসছে, গোটা প্রেক্ষাগৃহের দর্শক-শ্রোতারা আনন্দে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। বসুশ্রী হল যেন ফেটে পড়ে সেদিন।

১৯৮০-তে উত্তমকুমার মারা যাওয়ার পরেও এই জলসা থেমে থাকেনি। তবে ১৯৮৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মারা যাওয়ার পর আর এই জলসা চালিয়ে যেতে চাননি বসুশ্রীর কর্ণধার মন্টু বসু। ১৯৭৮ সাল থেকে জলসার সঙ্গে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তোচন ঘোষ। ২০১৪ সালের পয়লা বৈশাখের পর ঠিক পরপর মারা যান মন্টু বসু। ফলে জলসা সামলানোর দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে তোচন বাবুর কাছে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি পয়লা বৈশাখের জলসা চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে।

 হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর নেই, নেই মহানায়ক উত্তম কুমার, কিন্তু বসুশ্রী হল তো রয়েছে। রয়ে গিয়েছে হলের সঙ্গে বাঙালির আবেগ, নস্ট্যালজিয়া।  এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে তোচন ঘোষ বলেন, অতীতের দিনগুলো স্মৃতির পাতায় আজও অমলিন। বসুশ্রী’র এই জলসা ছাড়া যেন পয়লা বৈশাখ আজও সম্পুর্ণ নয়। পয়লা বৈশাখ মানেই বসুশ্রী হলের জলসা। তবে কেবল নববর্ষের অনুষ্ঠানের জন্যই নয়, 'কাবুলিওয়ালা’র জন্য সংবর্ধনা, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার পাওয়ার পরে শচীন দেব বর্মণের সংবর্ধনা, এ সবও বসুশ্রীতেই। ১৯৫৫-য় ‘পথের পাঁচালী’ রিলিজ়  সবই ছিল বসুশ্রীতে।