Madhyamik 2024 | কারুর বাবা দিনমজুর, কেউ আবার কৃষক পরিবারের সন্তান, আবার কেউ 'ফুটপাটবাসী'! জীবন সংগ্রামে লড়ে মাধ্যমিকে নজির গড়েছে এই পরীক্ষার্থীরা!
জীবন সংগ্রামে লড়াই করেও মাধ্যমিকে নজির গড়েছে বেশ কিছু পরীক্ষার্থী। এদের কারুর হয়তো রয়েছে আর্থিক অভাব, কারুর বাবা হয়তো দিন মজুর, কারুর হয়তো নেই মাথার ওপর ছাদ। তবে রয়েছে অদম্য জেদ ও ইচ্ছাশক্তি।
মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর বেশ কয়েকদিন ধরে হাইলাইটে থাকেন প্রথম স্থান অধিকারী এবং প্রথম দশে জায়গা করে নেওয়া পড়ুয়ারা। মাধ্যমিকের ফলাফল ২০২৪ (madhyamik result 2024) প্রকাশ হওয়ার পরেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ফলাফল প্রকাশ হতেই কৃতি ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে ছেঁকে ধরে সংবাদ মাধ্যম। প্রথম দশকে বাদ দিয়ে বাকি মেধাবী পড়ুয়াদের কথা খুব কমই সামনে উঠে আসে। এদের কারুর হয়তো রয়েছে আর্থিক অভাব, কারুর বাবা হয়তো দিন মজুর, কারুর হয়তো নেই মাথার ওপর ছাদ। তবে রয়েছে অদম্য জেদ ও ইচ্ছাশক্তি। প্রতি বছরই এরকম বহু ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষাতে পাশ করে বা ভালো ফলাফল করে। আজ এরকমই কিছু পরীক্ষার্থীদের সম্পর্কে কথা বলবো যারা জীবন সংগ্রামে নানান বাধা পেয়েও পাশ করেছেন মাধ্যমিক ২০২৪।
বাবা বাতাস বিক্রেতা, ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায় মথুরাপুরের সুমনা হালদার :
মথুরাপুরের সুমনা হালদার কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক দিয়েছে। মেয়ে ডাক্তার হতে চায়। তাই তার পড়াশুনার খরচ জোগাতে সাহায্যের আবেদন করেছেন তার বাবা। মাধ্যমিকে ৬৪৭ নম্বর পেয়েছে। সুমনার বাবা বাতাসা তৈরি করে সেটা ভ্যানে করে বাজারে বিক্রি করেন। সংসারে অভাব নিত্যসঙ্গী। এই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই সাতটি বিষয়ে লেটার নিয়ে পাশ করেছে ওই ছাত্রী। সুমনা কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুল থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। চিকিৎসক হয়ে গ্রামের মানুষদের সেবা করতে চায় সে। তার ফলাফলে খুশি স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতি বলেন, অভাবের মধ্যেও সুমনার ফলাফল অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে। সুমনার কথায়, আমার কোনও গৃহশিক্ষক ছিল না। বাড়িতে টিভি খারাপ হয়ে পড়ে আছে। অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে স্কুলের শিক্ষকদের সাহায্যে এই ফল করতে পেরেছি।
বাসন্তীর অভিসেন কয়ালকে ডাক্তারি পোড়ানোর জন্য জমি বন্ধক রাখবেন দিনমজুরি বাবা!
অভিসেন কয়ালের প্রাপ্ত নম্বরও ৬৪৭। অভিসেনেরও ইচ্ছা বড় হয়ে ভালো চিকিৎসক হবে। বাসন্তীর অভিসেন কয়াল নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র। ডাক্তারি পড়তে অনেক খরচ। তাই তার বাবা ভদ্রসেন কয়াল নিজের জমি বন্ধক রেখে অর্থের সংস্থান করছেন। বলে রাখা ভালো, অভিসেনের বাবা দিনমজুরের কাজ করেন। দিনে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ তাঁর। লক্ষ্য একটাই, ছেলের পড়াশুনায় যাতে অর্থ কোনও বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। তাই অনেক কষ্টে রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশুনা করিয়েছেন তিনি। এবারে দ্বিতীয় ধাপে সফল করতে ছেলেকে সেরার সেরা পড়াশুনার পরিষেবা দিতে উদ্যোগী ভদ্রসেনবাবু। তিনি জানিয়েছেন, জমি বন্ধক রাখবেন। ছেলের পড়াশুনাটাই আসল। অভিসেনের বক্তব্য, মিশনের সাহায্য ছাড়া এই ফল হতো না। বাবা অনেক কষ্টে আমায় লেখাপড়া শেখাচ্ছে। আমি ডাক্তার হয়ে গেলে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।
বস্তির আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হাওড়ার ইছাপুরের নন্দিনী দিন পনেরো পড়ে বসে পরীক্ষায়!
মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক দেড় মাস আগে আগুনের গ্রাসে চলে গিয়েছিল সব পাঠ্যবই ও খাতা। হাওড়া ইছাপুরের ড্রেনেজ ক্যানাল রোডের মাঝেরপাড়া বস্তির আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত নন্দিনী যাদবের পরীক্ষায় বসাটাই অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। তবে অবশেষে দিন পনেরো পড়ে পরীক্ষায় বসে নন্দিনী। পাশও করেছে সে। যদিও খুব ভালো ফল হয়নি বলে আফসোস করছে নন্দিনী। মাধ্যমিক পাশ পড়ুয়ার বাবা সাফাইকর্মী। তিনি বলেন, ১৯ ডিসেম্বর আগুন লাগার পর থেকে খোলা আকাশের নীচে রাস্তায় ছিলেন তারা। সে দিনের বিধ্বংসী আগুন নেভাতে যায় দমকলের ১০টি ইঞ্জিন। বস্তির ঘর ছাড়িয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশের বড় বড় গাছেও। সে দিন অনেক চেষ্টা করেও নন্দিনী বাঁচাতে পারেনি খাতা-বই। আগুন নেভানোর পরে সেখানে দেখা গিয়েছিল, ছাই সরিয়ে কিছু খুঁজে চলেছে কিশোরী। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিল বছর সতেরোর সেই মেয়ে। নন্দিনী জানায়, এক রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির থেকে পরীক্ষার কিছু দিন আগে নতুন বই-খাতা পায় সে। ওই ক’দিনই কিছুটা চোখ বুলিয়ে পরীক্ষায় বসে কিশোরী। তার কথায়, ‘‘তবে আমার স্কুলের শিক্ষকেরা আলাদা করে পড়িয়েছেন। স্কুলের পরেও তাঁরা আমাকে সময় দিয়েছেন।'
বাবা ডিম ব্যবসায়ী, বড় হয়ে শিক্ষিকা হতে চায় কোচবিহারের অঙ্কিতা সাহা :
কোচবিহারের কলাবাগান উচ্চ বিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্রীর নাম অঙ্কিতা সাহা। তাঁর মোট প্রাপ্ত নম্বর ৫৬১। শতাংশের নিরিখে তা প্রায় ৮০ শতাংশ। তবে তাঁর পারিবারিক আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। তাঁর বাবা বাদল সাহা পেশাগত ভাবে একজন ছোট মাপের ডিমের ব্যবসায়ী। একেবারেই টানাটানির সংসার তাঁদের। এক কথায় বলতে গেলে নুন আনতে, পান্তা ফুরোয়! তবে এর মাঝেও অঙ্কিতার সাফল্য যেন তাঁর বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। দরকার মতো বই, খাতা, পেন, পেন্সিল কিছুই পর্যাপ্ত ছিল না তাঁর। তাঁর বাবা অনেক কষ্ট করে তাঁকে যথা সম্ভব কিনে এনে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তবে অঙ্কিতা স্কুল শিক্ষকের থেকে অনেকটাই সাহায্য পেয়েছে। শিক্ষকরা তাঁকে পড়াশোনা সংক্রান্ত বিষয়ে দারুণ ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে ভবিষ্যতে সে একজন শিক্ষিকা হতে চায়।
প্রথম প্রচেষ্টাতেই মাধ্যমিক পাস সাদার্ন অ্যাভেনিউয়ের 'ফুটপাথবাসী' প্রিয়া প্রামাণিক!
মাথার উপরে নেই কোন ছাদ, নেই চার দেওয়াল। চরম অনটনের সংসার। দুবেলা খেতে পায়না। পড়াশোনার খরচ চালানোর মত ন্যূনতম রোজগার নেই পরিবারের।নেশায় আসক্ত বাবা। এরই মধ্যে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালো প্রিয়া প্রামাণিক। দক্ষিণ কলকাতার সাদার্ন অ্যাভেনিউ অঞ্চলে ফুটপাতেই বাস প্রিয়ার। লোকের বাড়ি কাজ করেন প্রিয়ার মা। এই পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালে প্রথম প্রচেষ্টাতেই মাধ্যমিক পাস করল প্রিয়া। ২১৯ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে প্রিয়া। এই যাত্রায় প্রিয়ার পাশে ছিল মিত্রবিন্দা ঘোষের রামধনু ফাউন্ডেশন। পথ শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা দেয় মিত্রবিন্দার রামধনু। কালিধন ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা প্রিয়ার। রাস্তার ধারে দোকানে বাসন মাজার কাজ করতো প্রিয়া। কাজের সঙ্গে পড়াশোনা করত সময়মতো। মাধ্যমিকের আগে মিত্রবিন্দা ঘোষ এবং অন্তরিপা বনিক ফুটপাতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে পড়িয়েছেন। বাবা মায়ের সাংসারিক ঝামেলার মধ্যে থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে কোনমতে পড়া চালিয়ে এই সাফল্যে প্রিয়া রীতিমতো খুশি। এরপর কলা বিভাগ নিয়ে পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে প্রিয়া। আগামীতে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের হয়ে কাজ করার কথাও বলেছে প্রিয়া।
এক ঘরে সংসার, বাবার ছোট্ট মুদির দোকান! মাধ্যমিকে ৯৩.৩ শতাংশ নম্বর পেয়েছে হাসনাবাদের রিয়াজ হোসেন মোল্লা!
মাধ্যমিকের মেধাতালিকায় স্থান না পেলেও চমকে দিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সুন্দরবন এলাকার হাসনাবাদের চকপাটলি হাইস্কুলের রিয়াজ হোসেন মোল্লা। প্রত্যন্ত এলাকায় থাকেন তিনি। এখানে না আছে কোনও লাইব্রেরি, ঠিক তেমনভাবে এলাকায় সাক্ষরতার হারও খুব বেশি নেই। এই প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৯৩.৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে এলাকায় রীতিমতো সাড়া ফেলেছে রিয়াজ। হাঁসনাবাদের পাটলিখানপুর এলাকায় এক ঘরে বসবাস রিয়াজের। বাবা লিয়াকাত হোসেন মোল্লার রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি মুদিখানার দোকান আছে। আর তা দিয়েই নিজের সামান্য উপার্জনে কঠোর পরিশ্রমে কোনও রকম দুই ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ বছর মাধ্যমিকে চকপাটলি হাইস্কুল (উঃ মাঃ) বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল রিয়াজ। রিয়াজের প্রাপ্ত নম্বর ৬৫৩। যার মধ্যে গণিতে ৯৮, ভূগোলে ৯৭, জীবন বিজ্ঞানে ৯৬, ভৌতবিজ্ঞানে ৯৪, বাংলা ও ইতিহাস উভয় বিষয়েই ৯২ এবং ইংরেজিতে ৮৪ নম্বর পেয়েছে সে। ছোট থেকেই গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়কে ভালবাসে রিয়াজ। পরবর্তীতে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করে সে চিকিৎসক হতে চায়। তবে আর্থিক অনটনের চিন্তাও রয়েছে মেধাবী ছাত্রের।
মাধ্যমিকে ষষ্ঠ স্থানাধিকারী কৃষক পরিবারের ছেলে শাহাবুদ্দিন হতে চায় ইঞ্জিনিয়ার!
মালদহ জেলায় মাধ্যমিকের প্রথম তথা রাজ্যে ষষ্ঠ শাহাবুদ্দিন কৃষক পরিবারের ছেলে। বাবা সৈফুদ্দিন আহমেদ পেশায় কৃষক। জমিতে চাষবাস তাঁর রুজিরুটি। বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় শাহাবুদ্দিন। কালিয়াচকেরই একটি আবাসিক মিশন থেকে মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিয়েছিল সে। শাহাবুদ্দিন জানিয়েছে, পড়াশোনার বাইরে তার পছন্দ গল্পের বইপড়া এবং ক্রিকেট খেলা।
মাধ্যমিকে নবম স্থানে কৃষক পরিবারের ছেলে আমিনুল হতে চায় চিকিৎসক!
আবাসিক মিশন এবং মোজমপুর স্কুলের পরীক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম মাধ্যমিকে ৬৮৫ নম্বর পেয়ে রাজ্যে নবম স্থানে রয়েছে। কৃষক পরিবারের ছেলে আমিনুল। বাবা নুরুল ইসলাম চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত। মা মেহবুবা আইসিডিএস কর্মী। আমিনুল চায় বড় হয়ে চিকিৎসক হতে।
শিক্ষক নাহলে প্রশাসনিক আধিকারিক হয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে চায় দিনমজুরের ছেলে চ্যাংরাবান্ধা দীপজয়!
চ্যাংরাবান্ধা (Changrabandha) গ্রাম পঞ্চায়েতের চৌরঙ্গী উচ্চবিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে দিনমজুর ঘরের ছেলে দীপজয় সরকার। লড়াই করে দীপজয় দেখিয়ে দিয়েছে লক্ষ্য ঠিক থাকলে বহু প্রতিবন্ধকতাকেই টপকে যাওয়া সম্ভব। তাঁর প্রাপ্ত নম্বর হল ৫৯৯। বাংলায় ৯১, ইংরেজিতে ৭০, অঙ্কে ৯০, ভৌত বিজ্ঞানে ৮৭, জীবন বিজ্ঞানে ৮১, ইতিহাসে ৮৬, ভূগোলে ৯৪ ও ঐচ্ছিক বিষয়ে ৮৫। বড় হয়ে শিক্ষক নয়তো প্রশাসনিক আধিকারিক হয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে চায় দীপজয়।
প্রসঙ্গত, ২রা মে প্রকাশ হয়েছে মাধ্যমিকের ফলাফল ২০২৪ (madhyamik result 2024)। মাধ্যমিকের পরীক্ষা ২০২৪ (madhyamik exam 2024) এর ৮০ দিনের মাথায় প্রকাশ হয়েছে রেজাল্ট। ২০২৪ এর মাধ্যমিকের ফলাফল (madhyamik 2024) অনুযায়ী, প্রথম হয়েছে কোচবিহারের রামভোলা হাই স্কুলের চন্দ্রচূড় সেন। মেধা তালিকার প্রথম দশে রয়েছেন ৫৭ জন। যার মধ্যে মাত্র ১ জন রয়েছে কলকাতার। এছাড়া এবছর পাশের হার ৮৬.৩১ শতাংশ। পরীক্ষায় নাম নথিভুক্ত করেছিল ৯,২৩,৬৩৬ জন। সাংবাদিক সম্মেলন থেকে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, মোট ৯,১০,৫৯৮ জন পরীক্ষা দিয়েছে, এর মধ্যে ৪,০৩,৯০০ ছাত্র এবং ৫,০৮,৬৯৮ ছাত্রী। মোট ৭ লক্ষ ৬৫ হাজার ২৫২ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় পাস করেছে।
- Related topics -
- রাজ্য
- পশ্চিমবঙ্গ
- মাধ্যমিক ফলাফল
- মাধ্যমিক