International Mother Language Day | 'আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'..পড়ুন ৩০ কোটি মানুষের ভাষা 'বাংলা'র জন্য সংগ্রাম সম্পর্কে!
বিশ্বের ১৮৮ টি দেশে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস! ৩০ কোটি মানুষের ভাষা বাংলা। জানুন ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের গুরুত্ব ও ইতিহাস সম্পৰ্কে।
ঐতিহাসিক দিন একুশে ফেব্রুয়ারি! বিশ্বজুড়ে এদিন পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day)। এই দিনটি ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। সারা বিশ্বে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ নানা ভাবে আয়োজন করে একুশে ফেব্রুয়ারি। তবে বাংলা ও বাঙালির জন্য এই দিনটির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এক রক্তাক্ত ইতিহাস। যার ফলে ভারত ও বাংলাদেশে বড় করে পালন করা হয় মাতৃভাষা দিবস (Mother Language Day)।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৪!
প্রতি বছর, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (21st Feb International Mother Language Day) পালন করা হয়। এই বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে এই বিশেষ দিনটি বুধবার পড়েছে। ২০১০ সালের ২১সে অক্টোবর জাতিসংঘের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাব আনে বাংলাদেশ, যা সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়। ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’- ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে লেখা শপথকে নতজানু হয়ে প্রণাম করার দিন। এই দিনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা ও বাঙালির একরাশ স্বপ্ন, আবেগ, আত্মত্যাগ, নিরলস সংগ্রাম এবং হার না মানা মনোভাবের কাহিনি।
'আ-মরি বাংলা ভাষা'!
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে সরকারি ভাষা করার দাবিতে রাজপথে নামা কিছু তরুণের বুকের তাজা রক্তে লাল হয় ঢাকার রাজপথ। বাঙালি জাতির সেই সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ-সহ সারা বিশ্বে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (21st Feb International Mother Language Day) এর দিন জীবন উৎসর্গকারী শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করা হয়।
মাতৃভূমিকে ত্রিখন্ডিত করে স্বাধীনতা আসে। এর পর দেশে দেশে তৈরী হয় সংবিধান। ইংরেজ নিদানকে ও তৎকালীন দেশীয় নেতৃবৃন্দের প্রবল ইচ্ছায় বেশিরভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মূল অঞ্চল হল ভারত, আর তার দুই পাশে অধিকাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত বসতি অঞ্চল হল যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। শাসনতান্ত্রিক নিয়মে ভারত বিভক্ত হল বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে - যেখানে মাতৃভাষা পেল প্রাধান্য। অন্যদিকে, পশ্চিমে পাকিস্তানের ঊর্দুভাষীরা উপনিবেশবাদী ভাবধারায় পূর্ব পাকিস্তানকে করায়ত্ত করতে চাইল ঐ ভাষাকে আশ্রয় করেই। ওদিকে, পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্যুত এক অনাথ শিশুর মতো- যার শেষ সম্বল বলতে মাতৃভাষা - ব্যাথা-বেদনায়, বিষাদ ও অশ্রুতে। সেই সম্বলটুকু হারানোর আশঙ্কায় মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা, স্বীকৃতি এবং আত্মপ্রতিষ্ঠায় শুরু হল আরেক যুদ্ধ।
দ্বিজাতিতত্ত্ব ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্যে দিয়েই ভাষা আন্দোলনের বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল। ভাষা বিক্ষোভ ১৯৪৭'র নভেম্বর-ডিসেম্বরেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো। এরপর ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (বাংলা ৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮) অধুনা বাংলাদেশের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়ে রইল এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় ছাত্রসমাবেশের কর্মসূচি ছিল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা নিয়ে ২০ই ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রনেতাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়ায় ২১ শেফেব্রুয়ারি ঢাবি আমতলার সমাবেশে এ বিষয়ে উপস্থিত ছাত্রদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে রাতেই অনেক ছাত্রনেতা পরের দিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের পুলিশ ঘেরাও করে রাখে। বেলা সাড়ে ৩ টের সময়ে মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় প্রথম ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। এতে ছাত্ররা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পরে বিকেল ৪টা নাগাদ মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন রফিকউদ্দিন আহমদ। রাত ৮টার পরে আহতদের মধ্যে মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত এবং গফরগাঁওয়ের আব্দুল জব্বার।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি? ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি? আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি?
১৯৫৪ সালের ৭ ই মে যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে পাকিস্তানের সরকার বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে তা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। পরে ১৯৫৬ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জাতীয় সংসদ বাংলা এবং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান পাস করে। ওই বছরের ৩ রা মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকারী পাকিস্তানের সংবিধান কার্যকর হয় এবং ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিশের মাধ্যমে মায়ের ভাষায় কথা বলার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার সাফল্য অর্জিত হয়। এরপর ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা, ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day) হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কারণ, বাংলা ভাষা কেবল আন্দোলন নয়, মায়ের ভাষা, গানের ভাষা, আবেগের ভাষা, সাহিত্যের ভাষা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা।
২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস (Mother Language Day) উদযাপন করা শুরু হয় ১৯৫৩ সাল থেকে।এদিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। সারা দিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে। এছাড়া আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। এছাড়া ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮ টি দেশে এই দিনটি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেই। উল্লেখ্য, বাংলা ভাষা রক্ষায় কেবলমাত্র বাংলাদেশের মানুষই নন, পরবর্তী সময়ে ১৯৬১ সালের ১৯শে মে'তে অসমের শিলচর শহরে অসম রাইফেলসের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১১ জন ভাষাবিপ্লবী। যার পরিণামে ঐ রাজ্যে এখন বাংলা দ্বিতীয় রাজ্য ভাষা।
বিশ্বের প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ আনুমানিক ৬০০০ ভাষায় কথা বলেন। যার মধ্যে বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের ভাষা হল বাংলা। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ, কমবেশি অসম, ত্রিপুরা, মণিপুর, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা রাজ্য, মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের রোহিঙ্গারাও বাংলা ভাষায় কথা বলেন। আবার, আফ্রিকার সিয়েরা লিয়েনে বাংলা হল দ্বিতীয় সরকারী ভাষা। তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্য এই নয় যে, অন্য ভাষাভাষীদের কাছে বাংলাভাষার গুরুত্ব বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। পরিবর্তে শুধু এই বিষয়টার প্রতি নজর দেওয়া যে, বিভিন্ন ভাষাভাষী এই ভারতে যত মাতৃভাষা রয়েছে সেগুলির গুণমান ও উৎকর্ষতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ।
- Related topics -
- সাহিত্য
- বাংলাদেশ
- ভারত-বাংলাদেশ
- অন্যান্য
- ইউনেস্কো